বাসা থেকে বিয়ের জন্য এক মেয়ের সাথে দেখা করতে বলা হয়েছে। ক্যাফেতে বসে একের পর এক কফি খেয়ে যাচ্ছি! সে মেয়েটার আসার খবর নেই! আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করছে না! মনে হচ্ছে মেয়েটার আমাকে পছন্দ হয়নি,তাই আসেনি। সুতরাং এভাবে অপেক্ষায় বসে থাকার কোন মানেই হয় না! তাছাড়া আজকাল যেভাবে ফ্যামিলির লোকজন মেয়েদেরকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে এতে বাড়ছে নানা ধরণের দূর্ঘটনা! হয়তো মেয়ে বিয়ে ঠিক করা ছেলের সাথে মতবিনিময় করে ক্যাফে অথবা রেস্টুরেন্ট থেকেই বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছে! নয়তো বিয়ের পর স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে অন্যের ঘর সামলাতে পাড়ি জমাচ্ছে! আপাতত এ দু-ধরণের দূর্ঘটনার কোনটির জন্যই আমি প্রস্তুত নই!! যেই বাসার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠতে উদ্যত হলাম, পেছন থেকে একটি মিস্টি কণ্ঠ গেয়ে উঠল: ‘প্রণয়! আপনি কি চলে যাচ্ছেন?’ পেছনে তাকিয়ে দেখলাম নীল শাড়ি পড়া এক মেয়ে। কানের দুল জোড়া নতুন লাগছে। নতুন এই জন্যই বলছি,এমন লম্বা কানের দুল আমি কখনও দেখিনি! আজকাল মেয়েরা কি কি যে পরিধান করে!..
মেয়েটার কপালের টিপটি একটু বেঁকে আছে,হয়তো তাড়াতাড়ি করার ফল এটা! শয়তান না কি মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো তাড়াতাড়ি করিয়ে ফেলে,এতে কাজটি পঙ্গু হয়ে যায়,পারফেক্ট থাকে না! মেয়েটির টিঁপের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে কি না কে জানে! তবে মেয়েটিকে সুন্দরী না বলে উপায় নেই! মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকার মত রূপ তার রয়েছে! সে নিজেকে সুন্দরী বলে দাবী করলে কেউ দ্বিমত পোষণ করবে বলে মনে হয় না! বাঁকা টিঁপে তার সৌন্দর্যের এক টুকরোও কমেনি!! তাকে চিনতে কষ্ট হল একটু! কারণ,তার শাড়ির আড়ালে তার আসল চেহারা হারিয়ে গেছে! তাই কথা বলার মাধ্যমে পুনরায় আবার আমরা পরিচিত হলাম!
আমারা দুজন পাশাপাশি বসে আছি। কিছুটা ইতস্তত ভাব মেয়েটার! কোনকিছু বলছে না! হঠাৎ করে দেরী করে আসার জন্য সরি বলে উঠল! আমি কৃতঙ্গতা প্রকাশ করে বললাম :’ইটস্ ওকে!’ মেয়েটি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল!বেশিক্ষণ কথা হল না,মেয়েটি দু-এক কথা বলেই নিরবতা পালন করছে। একা আর কতক্ষণ কথা বলা যায়! তাই মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে এলাম!!
বাসায় ঢুকতেই সবাই আমার রুমে এসে হাজির। মেয়ে কেমন দেখলাম তা জানার জন্য সবাই উন্মুখ হয়ে আছে! কোনকিছু বলার আগে মা বলেই ফেললেন,মেয়েটাকে তার অনেক পছন্দ হয়েছে,ছেলের বউ হিসেবে বেশ মানাবে মেয়েটাকে! তাই আর কিছু বলতে পারলাম না। মায়ের ইচ্ছের মূল্য যে আমার কাছে আমার অস্তিত্ত্বের চেয়ে কম নয়! তাই কৃত্রিম হাসি পরিবেশন করলাম! মা খুশি হলেন। আমিও খুশি হলাম! বাবার খুশির কথা না হয় নাই বললাম!!
বিয়ের সব কেনাকাটা শেষ,আয়োজনের কাজ চলছে। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়েছে। বন্ধু-বান্ধব অনেকেই আনন্দ প্রকাশ করে পোস্ট দিচ্ছে টাইমলাইনে! সেখানে লাইক আর কমেন্টের বন্যা বয়ে যাচ্ছে! তবে আমার কেমন যেন সন্দেহ লাগছে,মেয়েটা আমাকে পছন্দ করেছে তো! না কি কোন দূর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে,কিছুই বুঝতে পারছি না! আর এসব কথা আমার মনে এ অসময়ে উদ্ভাসিত হওয়ার কারণও আমি চিহ্নিত করতে পারছি না! ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে বেশ!!
বড় ভাবিকে বিষয়টি শেয়ার করলাম। ভাবি বললেন,মেয়েটিকে না কি তাঁরও কেমন সন্দেহজনক লাগছে! কেমন যেন ছাড়া ছাড়া ভাব! হলুদ দিতে গিয়ে ভাবি এটা নোটিশ করেছে! তখন আরো ঘোলাটে হল বিষয়টি! এরপর আমি নিজেই মা-কে আকার-ইংগিতে কথাটি বললাম। মা বললেন: ‘বাবা তুই চিন্তা করিস না তো,মেয়ের বাবা-মার সাথে এ বিষয়ে আমি কথা বলেছি! মেয়ের কোন সমস্যার কথা তাঁরা বলেনি! আর হয়তো মেয়েটা নার্ভাস ফিল করছে তাই তোর কাছে এমন মনে হচ্ছে!!’
মায়ের কথাটি যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত মনে না হলেও একটা প্রবোধ মিলল! তাই অত চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে আগামি কালের বিয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার প্রতি মনোযোগী হলাম! কপালে যা থাকে তাই হবে!! পরিশেষে বিবাহের দিন এসে পড়ল। জীবনের গুরুত্ববহ এক ময়দানে পদার্পণের আগ মুহূর্তে আমি দাড়িয়ে আছি! সবাই কন্যার বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত! সবার মুখে হাসির ফোয়ারা! গাড়িতে আমার পাশে দুলাভাই বসেছে! আমাকে চুপচাপ দেখে দুলাভাই বলল:
–‘ কি রে তাহলে বিয়ে করতে যাচ্ছিস!’ আর হো.. হো..করে একটা হাসি দিল।
— ‘আমাকে দেয়া ওয়াদার কথা মনে আছে তো? লাল পানির বিষয়টি,হো হো হো!’
আমি মুখে হাসি রেখে চোখ দুটো বন্ধ করে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলাম,কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না! পরিশেষে গাড়ি কন্যাদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে। গেইটে ঢুকেই লক্ষ্য করলাম,বাড়িতে নীরবতা বিরাজ করছে! সবার চেহারায় হতাশার ছাঁপ! এতটুকু দেখা মাত্রই বুঝলাম তানিয়া ওর প্লানে সাকসেসফুল! হয়তো কিছুক্ষণ আগেই চলে গেছে, যার কারণে ওর পরিবার আমাদেরকে এ ঘটনা জানানোর সময় পায়নি! ততক্ষণে দুলাভাই গাড়ি থেকে নেমে আসল ঘটনা জেনে এসেছে! দুলাভাইকে আমার ভাল লাগার একটি কারণ এটাও,সাংবাদিকের মত সবসময় সবার আগে সংবাদ প্রদান করেন তিনি! দুলাভাই গাড়িতে এসে আমতা আমতা করে আমার জানা কাহিনীটাই বলতে চাইছে! আমি বললাম:
–‘দুলাভাই! তানিয়ার বাবা-মা ঠিক আছেন তো!’
তিনি মাথা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালেন! দুলাভাইয়ের চেহারায় বিস্ময়ের ছাঁপ! হা-করে করে তিনি আমাকে ভূত দেখার মত দেখছে! গতকাল রাতে তানিয়ার দেয়া মেসেজটা ওপেন করে দুলাভাইয়ের দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বললাম! মেসেজে তানিয়া লিখেছে:
“প্রণয়,কাল আমি চলে যাচ্ছি! যখন পুরো বাড়ি ব্যস্ত থাকবে তখন আমি সুযোগ বুঝে বের হয়ে যাবো! আর গাড়ি ঠিক করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ! আমি পরে এর টাকা পাঠিয়ে দেবো আপনাকে! ভাল থাকবেন!” ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে ড্রাইভ করতে লাগল। অন্য গাড়িগুলোও আমাদের গাড়িটিকে অনুসরণ করল! সবাই যে আসল ঘটনা জেনে গেছে! গাড়ি চলছে,আমরা তানিয়াদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি! কিন্তু দুলাভাইয়ের বিস্ময়তা এখনও কাটেনি! ড্রাইভারকে গাড়িতে তুলে রাখা ‘লাল পানি’র বোতলগুলো এগিয়ে দিতে বললাম! দুলাভাই একবার আমার দিকে একবার বোতলের দিকে তাকাচ্ছেন! মৌনতা ভেঙে এবার দুলাভাই বললেন:
–‘তোর জানা ছিল, তানিয়া পলাবে! আর এর সাহায্যও তো তুই করেছিস! সব ঠিকঠাক করে দিয়েছিস! তাহলে বর সেজে গাড়ি নিয়ে তানিয়াদের বাসায় আসলি কেন?’
আমি বললাম: ‘”জানো দুলভাই,তানিয়াদের বাসার গেইটে ঢোকার আগেও আমার মনে হয়েছে তানিয়া চলে যায়নি! বারবার মনে হয়েছে হয়তো কোন কারণে ও থেকে যাবে, বিয়ে হবে আমাদের! দু’পরিবার এক হবে! বাবা-মা তাঁদের পছন্দের বউ নিয়ে বাড়িতে ফিরবে! কিন্তু সেটা আর হল না! তানিয়া চলে গেল!” দুলাভাই কিছু বলতে চেয়েও বললেন না, চুপটি মেরে গেলেন! বিস্মিত চোখজোড়া দিয়ে আমাকে দেখতে লাগলেন! এমন বিস্ময় হতে তাকে কখনও দেখা যায়নি!