-খেয়েছো দুপুরে? সকালে অফিসে এসেই শুনি শফিক ভাই আজও ভাবীর সাথে রাগারাগি করে এসেছে। বরাবরের মতো ফেসবুক থেকে সবাই জেনে গেছে। শফিক ভাইর ফেসবুক একাউন্টা ভাবী চালায়। রাগারাগির পর ভাবি ভাইয়ের একাউন্টে মনের শান্তনার জন্য পোস্ট করে যে, “আজও আমার ভুলে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে। কিছু মনে করোনা লক্ষ্মীটা। আজ আসার সময় তোমার জন্য লালরঙ্গা চুড়ি নিয়ে আসবো। এসেই চুড়িগুলো পরিয়ে দিয়ে বলবো, সরি আমার লক্ষ্মী বউটা”
এটা করে ভাবী নিজেই শান্তনা নেন। সবাই ভাবে শফিক ভাই নিজেই বউ-এর রাগ ভাঙ্গানোর জন্য এসব পোস্ট করেন কিন্তু আসলে ভাবী নিজেই যে এসব পোস্ট করেন এটা কেউ জানেন না। ভাবী জানে যে শফিক ভাইকে নিয়ে সবাই এসবে হাসাহাসি করে তবে এই শাস্তিটা দিতে তার নিজেরও ভালো লাগে। বউ পাগল স্বামী করে নিতে চায় উনি।
আজও বরাবরের মতো এই পোস্টটা সবাই দেখেছে আর শফিক ভাইকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। কিন্তু শফিক ভাই নিজের ডেস্কে বসে আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে। শফিক ভাইর পাশের ডেস্কেই আমি কাজ করি। সবার নানান কথাবার্তা শুনতে শুনতে আমি মুচকি হেসে ডেস্কে এসে বসলাম। শফিক ভাই একমনে কাজ করে যাচ্ছে। তার দিকে হাসিমুখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আমিও কাজ শুরু করলাম। ঘন্টাখানেক পরে শফিক ভাই দুকাপ কফি নিয়ে এসে আমার ডেস্কে হেলান দিয়ে দাড়ালেন। কফির কাপটা দিতে দিতে বললেন, “মজা না? অনেক মজা। মানুষের কিছু হলেই এতে মজা নিতে হবে?” আমি কফির কাপটা নিতে নিতেই হেসে ফেললাম। বললাম, ‘ভাই ভালো আছেন?’
কপট রাগ দেখিয়ে জলদি করে কফিতে চুমুক দিয়ে আমায় বললেন, “ঠাটায়া একটা লাথি মারার পর যদি জিজ্ঞেস করি ভালো আছিস কিনা, কেমন লাগবে তখন?” কফিতে চুমুক দিয়ে আমিও বলি, ‘তাতে কি পোস্টটা সরিয়ে ফেলতে পারবেন। যা জানার তাতো হয়েই গেছে।’ এটা বলে আবারও হাসি চলে এলো আমার। আমার হাসি দেখতে দেখতে একসময় উনিও হেসে ফেললেন। বললেন, “সবকটাই ফাজিল হয়েছিস তোরা। বিয়ে কর তখন বুঝবি, কতো ধানে কতো চাল।” ‘বিয়ের দিনে যখন আমিই স্বাক্ষী হিসেবে ছিলাম তখনও বলেছিলাম যে জীবিত থেকে কেনো বিবাহিত হচ্ছেন? তখন তো কথা কানেই নেন নি। ভাবীর আঁচল ধরে বিয়ে করে ফেলেছিলেন। আর এখন তো ভালই হচ্ছে। ঐ বলে না, অকর্মার কথা বাসী হলে ফলে।’
একটু মুচকি হেসে শফিক ভাই বললেন, “আরে তুই তো জানিস না কাল কি হয়েছে। কয়েকদিন ধরেই তোর ভাবী কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে। এই সময় অফিসে ছুটিও দিবে না। এটাই ও বুঝলোনা। তাই রাগ করে সেদিন রাতে তোর ভাবী কিছু খেলো না। আমারও আর খাওয়া হলো না। সকালে উঠে দেখি তোর ভাবী একা একা নাস্তা করছে। মেজাজটা কেমন হবে বল? তাই কাল বিকেলে বাজার থেকে ছোট মাছ নিয়ে গেছিলাম যেনো কাটাধোয়া করতে কষ্ট হয়। আর এজন্যই টুকটাক কথায় ঝগড়া হয়ে গেলো। শেষে বিরিয়ানি নিয়ে এসে খেতে হয়েছে৷ আর আজ তো কথা না বলেই চলে এসেছি। বুঝুক কেমন মজা।”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘আপনারা পারেনও বটে। এতো অশান্তি তৈরী করছেন কেনো? একটু বুঝে শুনে থাকলেই তো হয়।’ “হয়না রে ভাই, হয় না। বিয়ে কর একবার, অনেক কিছু মনে মনে ঠিক করে রাখবি কিন্তু কিছুই বলতে পারবি না৷ এই মেয়ে নামের জিবন্ত বস্তুগুলো কখন যে কিভাবে ভালবাসবে আবার অভিমানে নিজেকে রাঙ্গিয়ে তুলবে সেটা বলা বড় দায়। তবে কি জানিস, আমার অভিজ্ঞতা বলছে আজ তোর ভাবী অফিসে দুপুরের খাবার নিয়ে আসবে। দেখিস।”
আমি একটা হাসি দিয়ে কফিটা শেষ করে আবার কাজে মন দিলাম। কাজ করতে করতে কত সময় পেরিয়ে গেছে জানিনা তবে হঠাৎ করেই শফিক ভাইয়ের বউ আমার ডেস্কের সামনে এসে হাজির৷ এতো সুন্দর করে সেজেগুজে এসেছে যে কি বলবো? শফিক ভাই অবশ্য এখনো কাজ করেই যাচ্ছেন। যদিও উনি বুঝতে পেরেছেন যে ইশিতা(শফিক ভাইর বউ) ভাবী এসেছে। ডেস্ক থেকে ওয়েট পেপারটা নিয়ে ইশিতা ভাবী আমার দিকে ছুড়ে মারলো।
খুব কষ্টে সেটা ধরলে উনি দুষ্টুমি হাসি নিয়ে বললো, “যাক ধরতে পেরেছিস তাহলে। শোন, এই টিফিন বক্সে কয়েক পদের ভর্তা আর খিচুড়ি আছে। সাথে তোর পছন্দের ভূনা মাংস। শুধু তোর জন্য রেঁধেছি। একটু পরেই তো লাঞ্চের সময় হবে। তুই আর আমি একসাথে খাবো। আর কেউ না।’ আমি হাসতে হাসতে টিফিন বক্সটা নিলাম। একটু মজা করে বললাম, “আজকে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে ভাবী। দুপুরে ছুটি নেই কি বলেন? তারপর আপনি আমি একসাথে হারিয়ে যাই যেদিকে দুচোখ যায়।” এমন সময় শফিক ভাই উৎসাহিত করে বললেন, “আরে যা যা। যতো খরচ লাগে আমার থেকে নিস। একেবারে কয়েকদিন পর আসিস। খুব বেশি সমস্যা না হলে আসারই দরকার নাই, হাহাহাহা।” ইশিতা ভাবী একটু রেগেই তাকালো শফিক ভাইর দিকে৷ মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে তার হাসিটা একদমই সহ্য হচ্ছে না। হাতের টিফিন বক্সটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “কাউকে নিয়ে খেয়ে নিস। দুজনের খাবার আছে।”
এটা বলেই একগাদা অভিমান নিয়ে উনি চলে যাচ্ছিলো। আমি ডেস্ক থেকে উঠে উনার কাছে দৌড়ে গেলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি শফিক ভাই ভাবীর দিকে পেঁচার মতো মুখ করে তাকিয়ে আছে। ভাবীর হাতটা ধরতেই দেখলাম ভাবী আড়ালে চোখের পানিটা মুছে এদিক ওদিক তাকালো। বুঝলাম উনি অভিমানের সাথে একটু কষ্টও পেয়েছে। কি করবো ভেবে না পেয়ে অফিস ক্যান্টিনে ভাবীকে নিয়ে এসে বসালাম। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে তার। হয়তো অফিস বলেই কাঁদতে পারছে না। অথচ একটু আগেই তার মুখে রাগ আবার দুষ্টুমি হাসিও দেখেছি। আমি মৃদু হাসলাম আর সাথে সাথেই ঠাস করে একটা থাপ্পর মেরে দিলো আমায়। বুঝলাম হাসাটা উচিৎ হয় নি। তাই আবারও হেসে উঠি। উনি জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে আর আমি টিফিন বক্সটা খুলে এক পিস মাংস হাত দিয়ে নিয়েই মুখে দিলাম।
অসাধারন হয়েছে রান্নাটা৷ টিস্যু দিয়ে হাতটা মুছতে মুছতে বললাম, ‘একটু বসুন, আমি আসছি।’ শফিক ভাইর সামনে এসে দাড়াতেই দেখলাম উনি করুন চোখে তাকিয়ে আছে৷ বামপাশের গালে হাত রেখেই বললাম, ‘নাটক না করে ক্যান্টিনে যান। এরপর বাইরে কোথাও৷ বসকে আমি দেখছি। নতুন করে কাহিনী করবেন না বলে দিলাম।’ উনি হাসতে হাসতে বললেন, “থাপ্পরটা লেগেছে? কি আর করার বল, তোরই তো ভার্সিটির একমাত্র বড় বোন। একটা দুটো থাপ্পর তো চলেই তাই না?” আমি উনার দিকে একটু চোখ বড় করে তাকাতেই উনি বললো, “ আচ্ছা যাচ্ছি যাচ্ছি। এতো রেগে যাচ্ছিস কেনো? আমরা ভাই ভাই না?” বলেই মাথায় হাত বুলিয়ে হাসতে হাসতে উনি ভাবীর কাছে গেলো।
বসকে বলে শফিক ভাইয়ের জন্য অর্ধদিনের ছুটি নিয়ে আমি ডেস্কে এসে কাজ করছি। সমস্যাটা হলো বস আমাকে শফিক ভাইর কাজটাও দেখতে বললেন। বুঝলাম আজও দুপুরে খাওয়া হচ্ছে না। “”দীর্ঘদিনের সময়ের বিবর্তনে সস্তা হয়েছে পন্য আমার কেউ নেই তাতে কি, আমি তো সবার জন্য। তুমি আমি মিলে আমরা, সাথে একটুখানি আবদার যথেষ্ট নয় কি হতে, একে অপরের প্রতি অধিকার। এটাই যদি ভালবাসা হয় তবে বিরহ কিসের জন্য আমিতো একা তবুও কেনো আমিই সবার জন্য?””
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামবে ভাব সাথে এখনো কিছু কাজ বাকি। নিজের কাজ শেষ করে শফিক ভাইর কাজটা করছিলাম ঠিক তখনি একটা ফোন আসলো। অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসায় ধরবো আবার ধরবো না এরকম ভাবতে ভাবতে ফোনটা ধরলাম। ফোন ধরে হ্যালো বললাম না। ওপাশ থেকেও কোন কথা আসছে না। একটু পরেই কেউ বললো, খেয়েছো দুপুরে?
ছোটবেলা থেকে যতদুর দেখেছি নিজের ভাগ্য বলতে কিছু দেখিনি। কখনও লটারিতে কিছু পাইনি। একবার তো এমনও হয়েছে যে ২০ জনের মধ্যে ১৯ জনের কিছু না কিছু পুরস্কার আছে। হিসেব মতো খুব খুশি ছিলাম যে, এবার তবে কিছু একটা পাবো। কিন্তু সৌভাগ্যবশত আমি ছিলাম ওই বিশতম মানুষটা। এরপরে স্কুল-কলেজ এসবে বিভিন্ন ধরনের স্কলারশিপ এ আবেদন করে কখনও কিছু পাই নি। তবে আমি আমার বন্ধুদের আবেদন গুলো করে দিয়েছিলাম এবং আশ্চর্যজনক ভাবে তাদের সবার স্কলারশিপ হয়েছিলো। তবে নিজে যখন পরিশ্রম করে কিছু পাওয়ার চেষ্টা করেছি তখন উপরআলা আমাকে নিরাশ করে নি। প্রতিটা পরিশ্রমেই সফলতা দিয়েছেন। তাই নিজের ভাগ্যকে কখনও পরিশ্রম ছাড়া দেখতে চিন্তাটাও করি না। তবে এদিক দিয়েও নিজেকে কখনও কম ভাগ্যবান মনে করি না। বলতে গেলে আমার কেনো যেনো মনে হয় যে আমার সাথে উপরআলার একটা সুনির্দিষ্ট মাধ্যম আছে যেটাতে শুধু একটাই তথ্য আছে। আর সেটা হলো তুমি পরিশ্রম কর সৎ উপায়ে, আমি তোমাকে তার প্রতিফল দিব। হয়তো এটা সবার জন্যই তবে এর জন্য নিজেকে অনেক বিশেষ কেউ মনে হয়। নিজের কাছে ভাবতে তো অসুবিধে নেই তাই ভালই লাগে আমার।
কলেজ জীবনে একবার প্রেম এসেছিলো আমার। বলা যায় বিনা পরিশ্রমে। বিনা পরিশ্রমে বলার উদ্দেশ্য হলো এটা কিভাবে এসেছিলো আর চলে গিয়েছিলো এখনো বুঝতে পারিনি। তবে সমাধান হিসেবে যা ভেবেছি তা হলো ওই যে নিজের কোন হস্তক্ষেপ ছিলো না তাই হয়তো। আচ্ছা এই প্রেম জিনিসটাতেও কি ভাগ্য থাকতে হয়? হয়তো হয়। তা নাহলে আমার সাথেই কেনো এমনটা হয়েছিলো?
আমি তখন ভার্সিটির প্রথম বর্ষের শেষের দিকে। ফাইনাল পরিক্ষা হবো হবো ভাব। এক অষ্টাদশীর প্রেমে পরেছিলাম আমি। ভার্সিটির কেউ নয়। তবে এক স্যারের ছোট বোন। নিপুন স্যার। আমাদের ভার্সিটিতে নিপুন চৌধুরী অনেক দাপুটে শিক্ষক ছিলেন। তবে মানুষ হিসেবে উনি অনেক বড় মানের ছিলেন যদিও সেটা পরে যেনেছিলাম। উনার সাথেই ভার্সিটিতে দেখেছিলাম তৃনাকে। তৃনা চৌধুরী। তাকে দেখে আসলে চৌধুরীদের কোন বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই নি।
নিপুন স্যারও অনেকটা ওরকমি তবে তাদের মাঝে সবসময় একটা ব্যাপার থাকতো। মানে হলো তারা সবসময় পরিস্কার কাপড় পরতেন। সবসময় গোছানো এবং আয়রন করা কাপড় পরতেন। নিজেদেরকে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে তারা সবসময়ই তৎপর। তবে এর মাঝেও দেখা যেতো তৃনা এবং নিপুন স্যার একসাথে ফুচকা খাচ্ছেন আবার বাচ্চাদের সাথে মাটিতে বসেও খেলছেন। বলা যায় তাদের দেখলে পুরো একটা প্যাকেজ মনে হতো। সবি করতো তবে তাদের মাঝে কখনও অহংকার দেখিনি আমি। ঠিক একারনেই হয়তো ভালোবেসেছিলাম তৃনা কে। বলতে গেলে নিজের মাঝেই জীবনকে গড়তে শুরু করেছিলাম তাকে নিয়েই৷ বুঝিনি জীবন আমার সাথে থেকেছে জীবনের প্রয়োজনে। কারও পুর্নতা আর অপুর্নতা জীবনের ধার্য নয়।
তৃনার সাথে প্রথম কথা হয় হাসপাতালে। নিপুন স্যার একবার দুর্ঘটনার স্বীকার হলে আমি হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম। সেই হাসপাতালেই তৃনা এসেছিল। এর কিছু পরেই এসেছিলো শফিক ভাই। উনার সাথে আগে থেকেই অনেক ভাল সম্পর্ক ছিলো৷ সেদিন জানতে পারি শফিক ভাইর কাছে তৃনা প্রাইভেট পড়ে। শফিক ভাই যখন ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন নিয়ে ঔষুধ আনতে গেলো তখন তৃনা পাশে এসে বলেছিলো, “আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি না।” আমি একটু হেসে বলি, ‘আপনি হলে করতেন না?’ উনি নিজেও একটু হেসে বললো, “সেটা তো আপনার হলে বোঝা যেতো। এখন যেহেতু হয়নি তবে কিভাবে বলি?”
আমি তার দিকে একটু ভ্রূ কুচকে তাকালে সে হেসে ফেললো৷ আমিও মাথা নাড়িয়ে হাসছিলাম। হাত বাড়িয়ে ও বলেছিলো, “বন্ধু হতে পারি আমরা?” আমিও মজার ছলে বলেছিলাম, ‘আমি আপনার সিনিওর, এটা ভুলে গেলেন?’ সে এবার আমার দিকে মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে থাকলে আমি হেসে হাত নাড়িয়ে চলে আসি। বলে আসি, ‘দেখা হবে চাইলে কথাও হতে পারে তবে সেটা ইচ্ছাশক্তির পরিধি অনুযায়ী। যদি আমরা চেয়ে থাকি তবেই আমরা পারি নয়তো অপেক্ষার প্রহর গুনে পেরিয়ে যাবে সময়।’
এরপর ভার্সিটিতে তার আনাগোনা বেরে যায়। এক পর্যায়ে এই ভার্সিটিতেই ভর্তি হয় সে। শফিক ভাই একদিন ডেকে নিয়ে বললো, “কিছু চলছে তোদের মাঝে?” একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলি, ‘এখনও তো শুধুই বন্ধু থেকে গেলাম। কবে যে নিজের করে নিতে পারবো তাকে সেটাই বুঝতে পারছি না।’ শফিক ভাই একটু রসিকতা করেই বলেছিলো, “নিপুন চৌধুরী তোকে জুতা পেটা করবে জানতে পেলে। তখন বুঝবি ঠেলা।” আমি হেসে বলেছিলাম, ‘কিছু অযাচিত মুহুর্ত প্রেমে থাকা উচিৎ। তা নাহলে প্রেম জমবে কি করে? কি নিয়ে আমরা একে অপরের প্রতি আবেগে আপ্লুত হয়ে প্রেমের গল্প করবো। আমার জন্য তার চোখে পানি, আহা, ভাবতেই কতটা ভালবাসা জন্মায় ভেবে দেখেছেন কি?’ শফিক ভাই হেসে বললেন, “আসছে আমার উত্তম কুমার। গল্প শোনায়।”
একটু বাঁকা মুখ করে বলি, ‘আমার প্রেম যদি না হয় তাহলে ইশিতা আমার আপুই থেকে যাবে, ভাবী আর হবে না বলে দিলাম।’ তখন ইশিতা ভাবী আর শফিক ভাইর প্রেমের স্বর্নযুগ চলছিলো৷ তাই এই কথা বলাতে সে একটু থতমত হয়ে বললো, “ভাই তোর কোন সাহায্য লাগলে বলিস, আমি আছি। শুধু এসব কথা বলিস না। জানি ইয়ার্কি করছিস, তবুও ভয় লাগে ভাই।”
আসলে আমার সাথে ইশিতা ভাবীর অনেক ভাল সম্পর্ক ছিলো। আমার হাত ধরেই যে তাদের মাঝে প্রেমের সুত্রপাত হয়েছিলো। যাক সে কথা। তবে সেদিন থেকেই তৃনা আর আমার মাঝে একটি যোগাযোগের মাধ্যম তৈরী হয়েছিলো। এই আধুনিক যুগেও চিরকুট আদান প্রদান। আমিই প্রথমে দিয়েছিলাম শফিক ভাইকে দিয়ে। উনি পড়াতে গিয়ে তৃনাকে দিতো। পরে আবার তৃনাও কিছু লিখতো। মাঝে শফিক ভাইকে দেখে বড় মায়া হতো। বেচারা। কিছু বলতেও পারছে না আবার না করে থাকতেও পারছে না।
এরকম টুকিটাকি কথা নিয়ে বেশ কয়েকদিন চিঠির দেয়া নেওয়া হলে একদিন ইশিতা ভাবী সব জেনে যায়। তখন সে আমার ওপর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। বলেছিলো, “তোর এতো ভালো বুদ্ধি, জানতাম না তো রে। তুই তোরই বড় ভাইকে নিজের প্রেমের জন্য কাজ করাচ্ছিস। কয়জনে পারে বল? যাই হোক, তা কতদুর এগোলি?” ঠিক তখনি মাথায় একটা টোকা মেরে শফিক ভাই বলে, “হুর এটাতো গাধা। এখনো কিছুই করতে পারে নি। ওদিকে কথাই টানতে পারে না।” এটা শুনে ইশিতা ভাবী সেদিন জোর করে প্রপোজ করিয়েছিল তৃনা কে। তৃনা সেদিন সামনে আসলে ইশিতা ভাবীর চাপে প্রপোজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। বেশি কিছু বলতেও পারিনি। শুধু বলেছিলাম, ‘ভালবাসতে দেবে তোমায়? অনেকদিন তোমায় না জানিয়েই ভালোবেসেছি। এবার একটু জানিয়ে ভালবাসতে চাই যেনো একটু ভালবাসা পেতেও পারি। ভালবাসবে তো?’
তৃনা তাকিয়ে ছিলো এক দৃষ্টিতে। কিছু পরেই আমার হাতটা ধরে ভার্সিটির পুকুর পাড়ে নিয়ে আসে আমায়। আমার দিকে তাকিয়েই সে বলেছিলো, “ভালবাসাটা অনেক কঠিন একটা জিনিস জানো। এটাতে একবার ঢুকলে তাতে বের হওয়ার কোন অবকাশ থাকে না। হয় ভালবেসে যাও নয়তো বের হয়ে যাও তবে পরবর্তীতে আর কোন সম্পর্ক থাকে না। আর সবাই আমরা ভালবাসার একটা পরিনতি চাই। সারাজীবন একসাথে থাকার জন্য নিজেকে তৈরী করি। আর যদি সেটা নাহয় তবে একে অপরকেই দোষ দেই স্বার্থপর অথবা বেইমান বলে। ভেবে দেখেছো, ভালবাসার যে পরিনতি আমরা চাই সেটা কি স্বার্থপরতার প্রমান নয়? আমরা কি অনির্দিষ্ট কিছুর পেছনেই ছুটছি না যেটা আমাদের হাতে নেই? সবকিছু ভেবেই বলতো, এখন কি তুমি এরকম একটা সম্পর্কে যেতে চাচ্ছো?”
আমি কিছু বলতে পারিনি তাকে। আসলে তাকে হয়তো ভালবাসতাম তবে তখন আমি নিজেই ছাত্র। সেরকম ভরসা নিয়ে তাকে বলতেও পারছিনা কিছু। বলা যায় ভালবাসা ছিলো তবে তাতে জোর ছিলো না। এরকম নিজের মাঝেই যখন সন্দিহান তখন আমার চুপ থাকতে দেখে তৃনা নিজেই হাত বাড়িয়ে দিলো। হাত মিলিয়ে ও বললো,
“এতো চিন্তার কিছু নেই। আমরা বন্ধু হয়েই ভালো আছি অনেক। দেখবে, ক্যাম্পাসে আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে অনেকে হিংসে করবে।”
আমি হেসে ফেলি তার কথায়। মনে মনে ভাবি, ঠিক আছে। সে যদি এটাই চায় তবে তাই হোক। এভাবেই হয়তো বন্ধু হিসেবে অনেকটা এগিয়ে যাই তবে তার সাথে থাকতে, কথা বলতে আর একে অপরের প্রতি যত্ন নেওয়া থেকে আমর তার প্রতি ভালবাসাটা প্রখর হয়। বুঝতে পারি জীবনে প্রথম কাউকে এতোটা ভালবেসে ফেলেছি আমি। তখন তার সবকিছুই আমার ভাল লাগতো। তার কথা শোনার জন্য মুখর হয়ে থাকতাম আমি। তবে তাকে বলতে পারিনি যে এবার আমার ভালবাসার প্রতি বিশ্বাস এসেছে৷ আমি তাকে ভালবাসি৷
দিন এতসবের মাঝেও চলে যাচ্ছিলো। আমিও ভার্সিটির শেষে এসে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিবো ভাবছি। তখনি একদিন কিছু একটা হলো। তৃনাকে কারও সাথে রিকশায় ঘুরতে দেখলাম আমি। ফোন দিলেও কেটে দিলো সে। কেমন যেনো অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো আমার সেসময়। রাতে ও ফোন দিলে ওকে বললাম, ‘ফোন কেটে দিয়েছিলে কেনো?’ “কাজ ছিলো, একটু ব্যস্ত ছিলাম।” ‘সত্যিই কি তাই নাকি রিকশায় আমি ভুল দেখেছি?’ “এভাবে বলছো কেনো তুমি? কি হয়েছে বলবে?” ‘সেটা তো আমি জানতে চাই কে তোমার সাথে ছিলো? তবে তোমাদের মানিয়েছে ভালোই। আমাকে কিছু জানালে না তো?’
“ঠিক করে কথা বলো মামুন। ভুলে যেওনা আমরা বন্ধু। এরকমটা তোমার থেকে কোনভাবেই আশা করিনি আমি”
এটা বলেই ফোন কেটে দেয় সে। আমিও আর ফোন দেই নি। কিন্তু নিজের মাঝেই অনেক কষ্ট হচ্ছিলো এসব নিয়ে। এরকম অদ্ভুত কষ্ট এর আগে আমার হয় নি। সত্যিই তো, আমরা তো শুধুই বন্ধু। ভুলটা আমারই। নিজের সীমাটা বুঝতে পারিনি। সে রাতে ঘুম হয় নি তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার ওপর আশা করবো না আর। তাকে আমি ভালবাসি, সে আমাকে নয়। তাই তার কথামত নাহয় নিঃস্বার্থ ভাবে একাই ভালবেসে যাবো যার কোন পরিনতি আমি আশাই করলাম না।
পরেরদিন নিজেকে সামলে ভার্সিটিতে আসলাম। তৃনা আসে নি। ফোনও দেই নি আমি। নিজেকে সামলানো অনেক কঠিন হয়ে পরছিলো যে তাকে হয়তো হারিয়ে ফেললাম৷ তখনি আবার কিছু কথা ভেবেই নিজেকে সামলাই৷ দুদিন পরে তৃনা ভার্সিটিতে এসে ফোন দেয়। ধরতে পারিনি। ক্লাস করছিলাম। আগে হলে ক্লাস চলার সময়ও ধরতাম তবে এখন আর ধরবো না। ক্লাস শেষে তাকে ফোন দিলে সে বকুলতলায় যেতে বললো। আমি সেখানে গিয়ে দেখি সেদিনের রিকশার সেই লোকটিও আছেন। আমি নিজের মাঝেই হাসলাম। সামনে যেতেই তৃনা বললো, “পরিচিত করে দেই, আমার দূরসম্পর্কের কাজিন রেহান। আর রেহান ও আমার ভার্সিটির বন্ধু মামুন।”
আমরা দুজনে হ্যান্ডশেক করলাম। তৃনা আবারও বললো, “মামুন তোমাকে বলা হয় নি, ও লন্ডন থেকে গত শুক্রবার এসেছে। এখানে তেমন কেউ নেই তাই আমিই ওকে এই শহরটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি। আমার চাচ্চু তো আমেরিকায় একেবারেই রেসিডেন্স পেয়ে গেছে তাই রেহানও এবার আমেরিকায় উঠবে। ভাবছি আমিও ওখান থেকেই মাস্টার্স টা করবো।” আমি হাসিমুখে বললাম, ‘এতো ভালো খবর। শুভ কামনা তোমার জন্য। এখানে উনাকে ভালোমতো যত্ন নাও তাহলে ওখানে তুমিও তার থেকে যত্ন পাবে। বলতে গেলে উনিও তোমাকে ঘুরে দেখাবে সব কিছু।’
ওরা দুজনি হাসলো সাথে আমিও হাসলাম। ঠিক তখনি শফিক ভাইর ফোন আসলো। ফোনটা ধরে শফিক ভাই কি বললো না শুনেই একটু থেমে বলি, আমি এখনি আসছি। চিন্তা করবেন না। ম্যানেজ হয়ে যাবে। রেহান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘আজ যেতে হচ্ছে। একজনের জরুরী রক্ত লাগবে তাই যেতে হবে৷ আপনার সাথে আর দেখা হবে কিনা জানি না তবুও বলে রাখি তৃনা ওখানে গেলে দেখে রাখবেন। ভালো রাখবেন, নিজের যত্ন নিবেন। দেখা হবে, আসি।’ তৃনাকে বলি, ‘ভালো থেকো, কথা হবে। শুভ কামনা তোমার জন্য।’ শফিক ভাইর কাছে আসতেই উনি বললো, “কিরে তোকে ডাকলামই বা কখন যে ফোনে রক্ত ম্যানেজ হয়ে যাবে, কিসব উল্টাপাল্টা বললি?”
একটু বিরতি নিয়ে সব কিছুই তাকে বলি আমি। মেনে নিতে পারছিলাম না। সে এমনভাবে রেহান আর তার কথা বলছিলো যে মনে হচ্ছিলে তারা একসাথেই অনেক ভালো আছে৷ আমি শুধুই একটা আগাছা। সেদিনই শফিক ভাইর সাথে প্রথম সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে আন্দোলিত করি। এর পরের সময় গুলোতে আমি ছিলাম না। শুধু ছিলো আমার চেষ্টা আর জেদ। রেহান সাহেব লন্ডনে ছিলো তাই গ্রাজুয়েশনের শেষের দিকে ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে আইইএলটিএস করি। ভার্সিটি থেকে বের হতে হতে এটা শেষ হয়ে যায় আর এরপরেই পারি জমাই লন্ডনে। অনেক অনেক পরিশ্রম করেছিলাম এটার জন্য। আর ভার্সিটিতে তৃনার সাথে দেখা হলেই কোন বাহানা দিয়ে কাটিয়ে দিতাম। বিনিময়ে সেও আর বিরক্ত করে নি। আরও বন্ধু বানিয়ে ফেলেছিল। শুধু একদিন কিছু কথা বলেছিলো যেটাতে তখন কানেই নেই নি কিন্তু এখন যখন মনে করি তখন শুধু হাসি বের হয়।
বলেছিলো, “তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো যে আমার প্রতি তোমার যে মোহ ছিলো সেটা আর যাই হোক ভালবাসা ছিলো না। হলে এখন আমাদের যে অবস্থা তাতে সম্পর্কটাই থকতে না৷ বন্ধুত্বটাই যা আছে একটু তবে তোমায় দেখে মনে হচ্ছে সেটাও থাকবে না। এবার বুঝলে তো আমরা স্বার্থপর কেনো বলি নিজেদের৷ তুমি নিজেই কত বদলে গেছো একটু দেখো। আর হ্যা, তোমার সাথে বোধহয় দেখা হবে না খুব একটা আর৷ আমি বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। হয়তো হয়েও যাবে সবকিছু। তবে আমার সাথে যেটা করছো সেটা আর কারও সাথে করো না। মানুষের খারাপ লাগে এটা বুঝতে চেষ্টা করো। আমি উপেক্ষা সহ্য করতে পারি না। ভালো থেকো।” আমি মৃদু হেসে বলেছিলাম, ‘কাউকে খুব করে যেদিন ভালবাসবে আর সেই ভালবাসা তাকে বোঝতে পারবে না, সেদিন মনে করো আমার কথা। স্বার্থপর কাকে বলে বুঝে যাবে। আর উপেক্ষা বলছো, সেটার জবাব এই জীবন তোমাকে দেবে, আমি নই।’
বলেই চলে আসি। সবকিছু শফিক ভাই আর ইশিতা ভাবী জানতো। বাইরে যাওয়ার দুদিন আগে নিপুন স্যার আমাকে ডেকে পাঠায়। তার কাছে গেলে উনি বলেন, “কি অদ্ভুত না আমাদের জীবনটা। কেউই বোঝে না যেটা বোঝাতে চাই।” আমি একটু ভ্রূ কুচকে তার দিকে তাকালে তিনি মৃদু হেসে বলেন, “আমি লক্ষ্য করেছি অনেক কিছুই। কেউ এখন দেখতে পারছে না তার সামনে কে আছে বা ছিলো। কেউ বোঝাতে চেয়েও সরাসরি বলতে পারছে না আবার কেউ তো সময়ের মোহে দেখতেই পাচ্ছে না উল্টো বিপরীতমুখী মানুষটাকেই খারাপ ভেবে বসে আছে৷ এসব গেলো জীবনের একটি অংশ। আজ তোমায় যেজন্য ডেকেছি তা হলো তুমি এরকমই থেকো। নিজের জীবনকে গড়ে তোলা তোমার দায়িত্ব। তুমি যা করার তার অনেকটাই করেছো। একটা সময় আমিও তোমার অবস্থানে ছিলাম। তাই বলছি তোমাকে নিজের জীবনে কখনও অপুর্নতা গুলোকে ভুলে যেও না। ওগুলোকে মনে নিয়েই নিজেকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলো। এটাই বলার।”
আমি একটু ইতঃস্তত করে বললাম, ‘এসব কেনো বলছেন স্যার?’ স্যার আাবারও হেসে বললেন, “কেউ হয়তো এখন বুঝতে পারছে না তবে একদিন বুঝবে। এখন কেউ তারুন্যের চিন্তায় বাস্তবতাকে হারিয়ে চলেছে। ঠিক হয়ে যাবে তবে ততোদিনে ঠোঁট কালো করে ফেলো না। একটু কমের মধ্যেই থেকো।” বুঝেছি স্যার কি বলতে চেয়েছেন। এরপর এটা কফি খেয়ে চলে আসি৷ এরপর তো লন্ডনে। যাওয়ার আগে একবার ইচ্ছে ছিলে তৃনার সাথে দেখা করার কিন্তু পারিনি। ওই বলা যায় একটু জেদ চেপেছিলো মনে। পুরনো কথায় ফিরে যেতে কোনো সময় লাগে না। চলে আসে। আমিও চলে গিয়েছিলাম। অফিস শেষে এখন অবশ্য হাতে বেনসন ধরিয়ে রাস্তায় হেঁটে চলেছি। তখন অফিসে তৃনাই ফোন করেছিলো। কিন্তু তার সাথে কথা বলতে ভয় হয় এখন। আবারও কি কষ্ট পাবো? আবার কেনোই বা পুরনো কিছু ফিরে আসছে?
মাস্টার্স শেষ করে ইন্টার্নশিপ করছিলাম তখন। সাথে একটা চাকরী খুঁজছিলাম। শফিক ভাই আমার বায়োডাটা উনার অফিসে দিলে অফিসের বস তখনি জয়েন লেটার পাঠিয়ে দেন। এরপর দেশে এসে অর্ধমাসের মতো জব করতেই একদিন শফিক ভাইর বিয়ের খবর এলো। স্বাক্ষী হিসেবে আমিই ছিলাম। ইশিতা ভাবীর ভাই ছিলো না তাই আমাকে মেয়ে পক্ষ থেকেই সবকিছু করতে হয়েছিলো। তবে শফিক ভাইর পক্ষ থেকে যখন তৃনা কে দেখি তখন নিজের মাঝে কেমন যেনো রাগ লাগছিলো। তাকে ভালোবাসি তাই রাগটাও যেনো খুব চাপা আমার৷ গত তিনবছর কতোটা যে তাকে মিস করেছি বলতে পারবো না। সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো আমরাও আজ একসাথে থাকতে পারতাম।
বিয়েতে আমাদের অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে কিন্তু কথা হয় নি। এরপর সে অনেকবার যোগাযোগ করেছিলো কিন্তু আমি সেভাবে যুক্ত হতে চাই নি। এদিকে নিপুন স্যার আমার সাথে দেখা করে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস শেষে বলেছিলো, “কেউ যদি তার ভুলটা বুঝতে পেরে তোমার কাছে ফিরে আসতে চায় তবে কি ফিরিয়ে নেবে? সে হয়তো তখন বুঝতে পারে নি তবে এবার একটু দেখতে পারো। আসলে সে তোমাকে অনেক মিস করে। তোমার প্রতি তার ভালবাসা অধিক আর সেকারনে গ্রাজুয়েশন শেষে আর কোথাও যায় নি সে। এটা গত তিন বছরে আমি নিজেও বুঝেছি। ভাই হয়ে নিজের বোনকে এতো কষ্ট পেতে দেখতে ভালো লাগছে না। আমি অপারক তার দুঃখের কারনের জন্য কিন্তু সুখ হয়তো তুমি ফিরিয়ে দিতে পারবে। তাই তোমার কাছে আসা। একটু ভেবে দেখবে কি?” সেদিন স্যার এর থেকে আরও অনেক কিছু শুনেছিলাম৷ শেষে শুধু এটুকু বলি, ‘আপনার গল্পটা আমাকে বলবেন না স্যার? আপনি বলেছিলেন আমার মাঝে নিজেকে দেখতে পান। তবে গল্পটা কি?’ স্যার হেসে বলেছিলো, “এই গল্পটা নাহয় আরেকদিন হবে।”
গতাকাল দুপুরে তৃনা এসেছিলো অফিসে। আমি ইছে করেই দেখা করিনি। দেখতে চাই কতোটা ভালবাসা জন্মেছে আমার প্রতি এবং তাতে জোর কতোটুকু। পরে শফিক ভাই তার সাথে কথা বলেছিলো। চলে যাবার সময় শুধু এটুকু বলেছিলো তৃনা, “আমি নাহয় বুঝিনি তবে তুমি কি আর একটাবার বলতে পারতে না। জানি তুমি কথা বলবে না তবে আমিও দেখবো তুমি কতোদিন উপেক্ষা করতে পারো। আমার ভালবাসার প্রতি বিশ্বাস আছে।” শফিক ভাই পরে আর এ বিষয়ে কথা বলে নি। তবে আজ ভাবীকে দেখে ভেবেছিলাম উনি বুঝি এসবের জন্যই এসেছে। তবে যাক জিনিসটা কাটানো গেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই যখন বাসার সামনে এলাম তখন দেখি বাইরে শফিক ভাই আর ইশিতা ভাবী দাড়িয়ে আছে৷ কাছে যেতেই একটা কার্ড আর টিফিন বাটিটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“খেয়ে নিস খবার গুলো। আর কার্ডে লিখা রেষটুরেন্টে কাল দুপুরে চলে আসবি।”
এটা বলেই ওরা চলে গেলো। রাতে খাবার টা খেয়ে যখন ঘুমোতে যাই তখন মোবাইলে মেসেজ দেখি তৃনার। বলেছে, খাবার টা কেমন হয়েছে এটুকু জানিও আমায় দয়া করে। আমি এটা দেখেই ঘুমিয়ে পরি। পরেরদিন সময়মতো রেষ্টুরেন্টে যেয়ে দেখি ওখানে ভাই ভাবী সহ তৃনাও ছিলো। আমি যেতেই ইশিতা ভাবী শফিক ভাইকে বললো,
“সামনেই এদের বিয়ে। স্বাক্ষী আমরা হবো।” এটা শুনতেই আমি ভাবীর দিকে তাকালে ভাবী আমার ডানহাত জড়িয়ে নিয়ে বললো, “আমি কিন্তু আমার ভাইয়ের পক্ষ থেকে আসবো। আমার ভাইয়ের বউকে নিজ হাতে সাজাবো।” শফিক ভাই এটা শুনে হাসলো। ভাবী তখন শফিক ভাইকে নিয়ে উঠে পরলো আর ভাই বললো, “সব কিছু ঠিক করে নে। রাতে আমাদের বাসায় দুজনেই আসবি। আর কিছু শুনছি না।”
বলেই ওরা চলে গেলো। তৃনা তখন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যেনো মায়া লাগলো। সাথে ভালবাসাটও বেড়ে যেতে লাগলো। ওকে নিয়ে রিকশা নিয়ে নদীর পাড়ে আসলাম। অনেকক্ষন হলো বসে আছি। ওকে বললাম,
‘চুপচাপ বসে আছো যে?’ এটা শুনতেই ও আমার হাত জড়িয়ে নিয়ে কাঁধে মাথা রাখলো। মৃদু শব্দে বললো, “আমি ক্লান্ত একটুখনি তোমার ভালবাসা পেতে। এবার একটু স্বস্তি চাই। তোমায় ছাড়া চলবে না আমার। এই ভালবাসায় আমিও যে স্বার্থপরের মত একটা পরিনতি চাই৷ তুমি আর যাই করো শুধু আমায় ছেড়ে চলে যেও না। তোমার মনের কনে একটু খানি জায়গা দিও। আমি ওখানেই কাটিয়ে দেবো সারাজীবন। তবুও আমায় আর ফিরিয়ে দিও না। ভালবাসি তোমায়।”
নদীর সাথে দিগন্ত মিলিয়ে ভালই লাগছে। পাশেই নিজের ভালবাসা। জড়িয়ে নিয়ে বললাম, ‘আমি পুরোটাই তোমার। শুধু একটুখানি ভালবাসা পেতে আমিও পথ চেয়ে আছি। ভরসা করতে ইচ্ছে করে কাউকে। সারাজীবন এভাবেই থাকবে তো সবসময়?’ সেও জড়িয়ে নিলো আমায়। ওর চোখের পানিটা মুছে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিলাম। আরও গুটিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো সে। সামনে বিশাল আকাশে কিছু কথা মনে পরছে, সুখ চলে যায় দুঃখের ছোয়ায়, সুখী যে নও তুমি দুঃখ কখনো যায় না ছেড়ে, দুঃখই আসল প্রেমী।