একটা অদ্ভুত রকম কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা আমার খাটের নিচ থেকেই আসছে- স্পষ্ট বুঝতে পারছি। খাটের সাথে লাগোয়া টেবিল থেকে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে দেখলাম রাত তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট। এখনও সেই অদ্ভুত শব্দটা শোনা যাচ্ছে খাটের নিচ থেকে। খাট থেকে নিচে নামতে সাহস পেলাম না। মোবাইলের টর্চের আলো জ্বেলে উপুড় হয়ে খাটের উপর থেকেই আস্তে-আস্তে মাথাটা সামনে এনে নুয়ে মোবাইলটা খাটের নিচে ধরতেই দেখলাম সেখানে খুব মিষ্টি চেহারার এক মেয়ে তার রক্তচক্ষু মেলে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে, আর তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে।
আমি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। নিশ্চয়ই ভুল দেখেছি। আবার ধীরেধীরে চোখ দু’টো খুলে সেই একই দৃশ্য দেখতে পেলাম। এবার আমি এক মুহুর্ত দেরী না করে খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড়ে মেইন দরজার দিকে যেতে শুরু করলাম। কিন্তু ঠিক তখনই হিমশীতল কিছু একটা এসে আমার একটা পা পেচিয়ে ধরতেই আমি উপুর হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম। ডিম লাইটের অল্প আলোতেও দেখতে পেলাম, খাটের নিচ থেকে একটা লম্বা হাত এতো দূরে এসে আমার একটা পা শক্ত করে ধরে রেখেছে। এরপর ডিম লাইটের আবছা আলোটুকুও আর দেখতে পেলাম না। ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এলো আমার চোখে।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে খাটের মধ্যে আবিষ্কার করলাম। জানালা দিয়ে কড়া রোদ এসে আমার চোখেমুখে পড়ছে। গতরাতের কথা মনে পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ভালো করে তাকালাম চারিদিক। ষ্টীলের আলমারির দিকে চোখ পড়তেই ভয়ে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললাম। এটা কি বাস্তবেই ঘটছে, নাকি আমি স্বপ্নের জগতে আছি? কিছুই বুঝতে পারলাম না। ধীরেধীরে হাত সরিয়ে চোখ খুলতেই সেই একই দৃশ্য দেখতে পেলাম। ষ্টীলের আলমারির উপরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে গতরাতে খাটের নিচে দেখা সেই তরুণী। আমার চোখে চোখ পড়তেই মিষ্টি হেসে বললো,
— এখন কেমন লাগছে নিলয়? আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,
— ভালো… কিন্তু আপনি কে? আমার প্রশ্নটি শোনার সাথে সাথে মেয়েটির চোখেমুখে বিষাদের ছায়া নেমে এলো। বললো,
— আমি কেউ না। তবে একসময় আমি আমার বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিলাম।
কথাটার মধ্যে এমন একটা কিছু ছিলো যে আমার ভিতর থেকে ভয়ের ভাবটা চলে গেলো। একটা তরুণী মেয়ের রাতের বেলা খাটের নিচে থাকা কিংবা সকাল বেলা আলমারির উপরে বসে থাকাটা যে একেবারেই অস্বাভাবিক ব্যাপার, আমি সেটা ভুলে গেলাম। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে তাকে আবারও প্রশ্ন করলাম, আমার কাছে কি চান? আর আপনি আমার নামই বা জানলেন কি করে? মেয়েটি এবার আলমারির উপর থেকে এক লাফে নেমে এসে খাটের পাশে রাখা চেয়ারটায় বসলো। বললো,
— আমি শুধু আপনার নামই না, আপনার সম্পর্কে আরো অনেক কিছুই জানি। যেমন, রিনি নামের একটি মেয়েকে ভালোবাসতেন আপনি। মেয়েটি আপনাকে একা করে দিয়ে এক মস্ত ধনী ব্যবসায়ীর হাত ধরে চলে গেছে। তাই আপনি নিজের ইচ্ছেতেই শহর, পরিচিত মানুষদের ছেড়ে এই মফস্বলে এসেছেন নিজের মতো করে একা থাকবেন বলে। আজই এই বাসাটি ভাড়া নিয়েছেন। আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,
— আপনি আমার সম্পর্কে এতো কিছু জানলেন কি করে? মেয়েটি এবার হা হা হা… করে এতো জোরে হেসে উঠলো যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো এই হাসির শব্দ যেন বহু দূর থেকে ভেসে এসেছে। এরপর বললো,
— ইচ্ছে হলে আমরা অনেক কিছুই করতে পারি।
এই ‘আমরা’ বলতে সে কি বুঝিয়েছে — সেটা আমি বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছি, তাই আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম কালই একটা নতুন বাসা খুঁজতে হবে। আমার মনের কথাটা যেন শুনে ফেললো সে। কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,
— প্লীজ বাসাটা ছেড়ে দিয়েন না। আমাকে একটু হেল্প করেন। মেয়েটি আমার কাছে কি হেল্প চাইতে পারে, ভাবতে লাগলাম। এবার মেয়েটি বললো,
— এর আগে এই বাসায় অনেক ভাড়াটিয়া এসেছিলো, কিন্তু তারা কেউ আমার রিকোয়েস্ট রাখেনি। সবাই ভয় পেয়ে পরের দিনই বাসা ছেড়ে চলে গেছে। আমার আসল ঠিকানা রেখে, এই জগতে থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি আমার কাজ শেষ না করে যেতেও পারছিনা। প্লীজ, একটু হেল্প করুন আমায় বলতে বলতে মেয়েটি দু’হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লো। খুব মায়া লাগলো মেয়েটির জন্য। ভয় কে দূরে সরিয়ে মায়াকে প্রাধান্য দিয়ে বললাম,
— বলুন, কি করতে হবে আমাকে?
মেয়েটি বললো, এই বাড়ির বাড়িওয়ালাকে একটা কল করে এখানে আসতে বলতে হবে আজ রাতে। ব্যস এইটুকুই…
এতো সহজ একটা কাজের জন্য মেয়েটার এতো কাকুতি মিনতি! ঠিক তখনই কল দিলাম বাড়িওয়ালার মোবাইলে।
— আজ সন্ধ্যায় চলে আসুন না প্লীজ আমার এখানে। আপনার সাথে তো ভালো করে আলাপ পরিচয়ও হয়নি। একটু গল্প-গুজব করা যাবে, আর চা খাওয়া যাবে একসাথে। এক কথাতেই রাজী হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। কথা শেষে তাকিয়ে দেখি চেয়ারে বসা মেয়েটি উধাও। বিকালে ছোট বোনের ফোন পেলাম- মা খুব অসুস্থ। সাথে সাথে রওয়ানা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলো। বাড়িতে ঢুকে দেখি মা সবাইকে রাতের খাবার বেড়ে খাওয়াচ্ছেন। আমি যেমন মা’কে সুস্থ অবস্থায় দেখে অবাক হলাম, তেমনি সবাই অবাক হলো হঠাৎ করে আমাকে দেখে।
ছোট বোনকে বললাম,
— তুই ই তো আমাকে ফোন করে বললি মায়ের অসুস্থতার কথা। ছোট বোন নীলা অবাক হয়ে বললো,
— কই দেখি, মোবাইলে দেখাও তো ভাইয়া, আমি কখন তোমাকে কল দিয়েছি? কল লিস্টে ঢুকে বিকালে ফোন এসেছে, এমন কোনো নাম্বারই দেখতে পেলাম না। ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি না করে খেয়েদেয়ে ঘুমাতে চলে গেলাম। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙলো নীলার ডাকে।
— ভাইয়া, ভাইয়া… শিগগির উঠে দেখো পেপারে কি বেরিয়েছে! চোখ ডলতে ডলতে উঠে দেখি নীলার হাতে একটা খবরের কাগজ।
— কি খবর বের হয়েছে রে?…
রিনি আপু মারা গেছে। নীলার মুখে আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড এর মারা যাওয়ার খবর শুনে চমকে উঠলাম। রিনি আমাদের গ্রামেরই মেয়ে, তাই সবাই ই ওকে চিনতো। যেই রিনি দুই বছর আগে আমাকে একা করে দিয়ে এক ধনী ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেছিলো, সেই রিনির মৃত্যু সংবাদ শুনে আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে দ্রুত পড়তে লাগলাম ঘটনাটা ঘটেছে আমার নতুন ভাড়া নেয়া বাসার ছাদে! এ তো দেখছি চমকের উপরে চমক!
গতরাতে তরুণ ব্যবসায়ী আতিক রহমান এবং তার স্ত্রী রিনি তাদের নির্মানাধীন বিল্ডিংয়ের তিন তলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন। দুই বছর আগে আতিক রহমানের প্রথম স্ত্রীও এই একই ছাদের উপর থেকে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন। আতিক রহমানের আগের বৌয়ের ছবি দেখে আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেলো! এই তো সেই মেয়ে যাকে আমি প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম আমার খাটের নিচে! সারাদিন একটা অপরাধ বোধ কাজ করছিলো মনে। আমি যদি আতিক রহমানকে ফোন করে সেখানে যেতে না বলতাম, তাহলে হয়তো তিনি মারা যেতেন না, আর রিনিও বেঁচে থাকতো। আগামীকাল সকালেই নতুন কর্মস্থলে ফিরে যাব, আর নতুন একটি বাসা খুঁজে বের করতে হবে থাকার জন্য।
রাতের বেলা ঘুমের আগে ওয়াশরুমে বেসিনের কাছে দাড়িয়ে টীথব্রাশ করছিলাম। হঠাৎ সামনের আয়নার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম সেখানে সেই মেয়েটি। যদিও আজ তাকে খুব শান্ত, স্নিগ্ধ আর মিষ্টি লাগছে দেখতে, তবুও খুব ভয় পেয়ে গেলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই সেখানে। ভয়ে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুম থেকে বের হতে যাবো, এমন সময় আয়নার ভিতরের মেয়েটি কথা বলে উঠলো,
— যাবেন না প্লীজ, আমার কথাটা শুনে যান। আমি থমকে দাঁড়ালাম। মেয়েটি বলতে থাকলো–
— খবরের কাগজ পড়ে নিশ্চয়ই জেনে গেছেন আমি কে! যেটা জানেন নি সেটা আমি বলছি- আমি মা হারা একমাত্র মেয়ে ছিলাম বলে বাবার আদরে আদরে বড় হয়েছি। ভালোবেসে ফেলেছিলাম গরীব ঘরের ছেলে আতিককে। একটি বারের জন্যেও বুঝতে পারিনি আতিক আমাকে ভালোবাসেনি, সে আমাকে ব্যবহার করে আমার বাবার সম্পত্তি পেতে চেয়েছিলো। আমি আতিকের ভালোবাসাকে সত্যি ভেবে বাবার অমতে পালিয়ে গিয়ে তাকে বিয়ে করলাম। আমার দেয়া কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বাবা হলেন শয্যাশায়ী। তখন আতিক আমাকে চাপ দিতে শুরু করলো বাবার সমস্ত সম্পত্তি তার নামে করে দেয়ার জন্য। কারন আমিই ছিলাম আমার বাবার একমাত্র সন্তান।
আমি না পারছিলাম সহ্য করতে, না পারছিলাম বাবাকে কিছু বলতে। এরই মধ্যে বাবা মারা গেলেন। আতিক জোর করে সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নিলো। আমি আমার মান সম্মান ধূলায় মিশে যাওয়ার ভয়ে কাউকে কিছু বললাম না। সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করে নিলাম। এতো কিছুর পরেও আমি আতিকের কাছ থেকে রেহাই পেলাম না। রিনি নামের এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করার জন্য সে আমাকে এই পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিলো। কারন, আমার চেহারা ছিলো একেবারেই সাদামাটা। সবাই জানলো আমি আত্মহত্যা করেছি। কিন্তু সত্যিটা হলো আতিক আমাকে ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলো। এতোগুলো কথা একসাথে বলে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে গেলো সে। এরপর একটু দম নিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসে বললো,
— এতোদিন আমি আমার জগতে না যেয়ে পৃথিবীতে থেকে গিয়েছিলাম শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। গতরাতে আমি প্রতিশোধ নিতে পেরেছি। আহ! কি শান্তি। এখন আমি নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারবো আমার জগতে।
আয়নার ভিতর থেকে মেয়েটির চেহারা হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গেলো।
আর আমি অবাক হয়ে আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড রিনির কথা ভাবতে লাগলাম। সে যখন আমাকে একা করে দিয়ে চলে গিয়েছিলো, আমি তখন যেনো এক জীবন্ত লাশ হয়ে গিয়েছিলাম। আর এতোদিন পরে আমি যখন একা একা বাঁচতে শিখে গেছি, তখন রিনি নিজেই একটা সত্যিকারের লাশে পরিনত হয়ে গেলো! একেই বোধহয় বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ !!