আমার রাগ একটু বেশি, আমার রাগ হইলেই আমি জিনিসপত্র ভেঙে ফেলি, আমি যখন ওকে এটা বলি, তখন আমাকে আমার হাসবেন্ড বলে সমস্যা নাই আমার আম্মা ও অনেক রাগী মানুষ, আম্মাও রেগে গেলে জিনিস ভাঙ্গে তুমি মনে হয় ভাঙ্গার মতো তেমন কিছু পাবে না। আর ইতিমধ্যে আম্মার রাগ হলে আম্মা দরজা বন্ধ করে আমার হাসবেন্ডকে যে পরিমান মারতো তাও শুনে ফেলেছি, এককথায় আমার শাশুড়ী মা অনেক রাগী মানুষ।
আজ আমি আমার শাশুড়ি মা’য়ের কথা বলবো। আমার হাসবেন্ডরা সাত ভাই এক বোন। আমার শ্বশুর বাড়ির সদস্য সংখ্যা প্রায় ত্রিশ জন। আমার বিয়ে হয় ঢাকাতে, কারন আমি ঢাকার মেয়ে। আর বিয়ের পর যখন প্রথম দিনাজপুর যাই, তার পরের দিনের কথা, আমার হাসবেন্ডের পরিবারের সেজো ভাবি আমার শাশুড়ী মাকে বলল, মা শারমিন কি রান্না করবে আজকে? কারন আমার শশুর বাড়ির নিয়ম নতুন বৌ আসলে নাকি পরের দিন কিছু একটা রান্না করে। আম্মা বলল শারমিন কিছু রান্না করবে না। আমিতো অবাক! মা তখন বলল ও ঢাকার মেয়ে এবং ওদের পরিবার ছোট, ও এত লোকের রান্না ও করতে পারবে না। আমার হাসবেন্ডরা সাত ভাই এক বোন, আর তাদের বাচ্চা, কাজের লোক সব মিলিয়ে প্রায় পঁচিশ জন সদস্য, যৌথ পরিবার।আমি মুগ্ধ! মা ঠিক মায়ের মতো কাজেই করলো। আমি আসলে কোনদিন কোন রান্নাই করি নাই বিয়ের আগে। আর এখন আমরা দু’জন মিলে একটু ছোট খাটো কাজ চালানোর মতো রান্না করি। এই যে মা বলেছে শারমিন রান্না করবে না আজও আমার বিয়ের উনিশ বছর হয়েছে আমাকে আমার শশুর বাড়ির কেউ কিছু রান্না করতে দেয় নাই।
পরের দিনের কথা, মা তার অনেক গুলো শাড়ি আমার সামনে দিয়ে বলল, শারমিন তোমার যেটা পছন্দ হয় নাও, আমি একটা সাউথ কাতান নিলাম, কি যে ভালো লাগলো।আমি বেড়াতে যাবো মাকে বললাম মা শাড়ি পরে যাবো? মা বলল কান্তজীর মন্দির দেখতে যাবে, সালোয়ার কামিজ পরে যাও, শাড়ি পরে হাটতে পারবে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম মা পাঞ্জাবি আর জিন্স পরে যাই? মা বলল যাও, সাথে আরো বলল আমার একটা আড়ংয়ের শাল আছে, সেটা পরবে? আমার হাসবেন্ড নাকি মাকে কিনে দিয়েছে শালটা,আহা্ মা কি ভাবে বুঝলো! আমি যে শালটা পরেছি তা আমার একটুও ভালো লাগছিল না। একেই বলে মা।
প্রথম বার শ্বশুর, বাড়ি গিয়েই আমি মুগ্ধ! আমার রাগী শাশুড়ীর নরম মন, আর তার বিচার বিবেচনা দেখে। তার পর কত’যে তার ভালোবাসা পেয়েছি, কি বলবো! মার ক্যান্সার হয়েছে চিকিৎসা করানোর জন্য আমার বাসায় এসেছে। আমরা দু’জনই চাকুরী করি। সকালে অফিসে যাই বিকালে ফিরি। বাসায় আসলেই মা কাজের মেয়েকে বলে নাস্তা দিতে, নাস্তার প্লেটে নানা রকম জিনিস। মা অসুস্থ থাকায় অনেক গেস্ট আসে মাকে দেখতে, তখন তাদেরকে যা-যা খেতে দেওয়া হয় মা তা আমার জন্যও তুলে রাখে। মা যখন একটু ভালো, দিনাজপুর চলে যাবে, তখন মা আমাকে বলল, চলো মার্কেটে যাই, আমি বললাম, মা কি কিনবেন? আমাকে বলেন, এনে দেবো, মা বলল না একটা জিনিস কিনবো তুমি আর আমি গিয়ে। গেলাম গুলশান ডি সি সি মার্কেটে, মা বলল একটা টিভি রাখার ট্রলি পছন্দ করো, আমি অবাক! ঢাকা থেকে দিনাজপুরের নিয়ে যাবে ট্রলি?
মা বলল এটা তোমার জন্য। তখন আমি বললাম মা আমি কিনে নেবো। মা বলল টিভি কেউ চেয়ারে রাখে? আমি অসুস্থ না থাকলে আরো আগেই কিনে দিতাম। মা আমার বাচ্চা হওয়ার পর দিনাজপুর থেকে খাট বানিয়ে পাঠায়েছে, আগের খাট ছোট বলে চাকুরীজীবি বৌকে খাটের সাথে চাটাই সহ কুরিয়ার করে পাঠায়েছে। আমার শাশুড়ি আমাকে এত আদর করতো কেন? আমি জানি না, কারন আমার ভেতরে তেমন কোন বিশেষ গুণ নাই। শুধু আমাকে কেউ ভালোবাসলে আমি তাকে তার চাইতেও বেশি ভালোবাসতে পারি এটা ছাড়া। আমার শাশুড়ি মারা গিয়েছে সতেরো বছর হলো। আমার মনে হয় মার প্রতি আমার ভালোবাসা দিনদিন আরো বেশি হচ্ছে।