আবার দাঁড়াবে মানুষ

আবার দাঁড়াবে মানুষ

হাসপাতালের বিছানা থেকে বলছি, দয়া করে শুনবেন কি মানুষ?- আমি জুয়েল, তাগড়া যুবক, বয়স ছত্রিশ, ছিলাম নিরোগ, তরতাজা। ভেবেছিলাম, এই করোনাভাইরাস ঘটিত মহামারি আমার রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাঙতে পারবে না।

ষোলো দিন আগে, জ্বর হলো আমার; সাধারণ ফ্লু ভেবে চুপচাপ কাটিয়ে দিলাম দিনটা। পনেরো দিন আগে, শরীর ব্যথা; জ্বর কমে, বাড়ে; পেইনকিলার খেলাম দু’টো। চৌদ্দ দিন আগে, জ্বর আসে, যায়; শরীর ব্যথা বাড়ে তো বাড়েই; সিজন চেইঞ্জ হচ্ছে, আমি ফ্লুতেই থাকলাম, আমি পেইনকিলারেই থাকলাম। তেরো দিন আগে, সারাদেহে ব্যথা কমলো, এলো গলা ব্যথা। বারো দিন আগে, খুশখুশে কাশি, গলা ব্যথা বাড়ে, কমে; জ্বর ছিলো; আশঙ্কিত আমি ডায়াগনোসিসে গেলাম। এগারো দিন আগের ভোরে, জানলাম, আমি কোভিড-১৯ পজিটিভ; স্বাদ ও ঘ্রাণ এই দুই ইন্দ্রিয় ক্ষমতা হারাতে আরম্ভ করলো।

দশ দিন আগে, দু’কানের ভিতরে তীক্ষ্ণ ব্যথা; স্বাদ নেই, গন্ধ নেই; ব্যথা গলায়, কাশি, জ্বর দেহে। নবম দিন থেকে, বাকি সব উপসর্গের সাথে আরম্ভ হলো শ্বাসে কষ্ট। অষ্টম, সপ্তম, ষষ্ঠ দিন গেলো; সে কী প্রাণপণ চেষ্টা আমার, একটু বাতাস নিতে বুকের ভিতরে! হায়, এ-জগতে একমুঠো হাওয়া কি নাই! আজ থেকে ছয় দিন আগে ঘর থেকে বের করা হয়েছিলো আমাকে- পুলিশ ছিলো দু’জন, দু’জন স্বাস্থ্যকর্মী ছিলো, ছিলো একটি অ্যাম্ব্যুলেন্স। আমার মাকে উঠতে দেওয়া হয়নি অ্যাম্ব্যুলেন্সে, আমার বাবাকে আসতে দেওয়া হয়নি আমার সাথে, আমার ভাইকে আটকে দেওয়া হয়েছে ঘরের দুয়ারেই, আমার বোন তখন অজ্ঞান।

অ্যাম্ব্যুলেন্স চলে আসছিলো তার প্রিয় সাইরেন বাজিয়ে; ভেতরে চিৎ শোওয়া আমি, একটি শ্বাসের খোঁজে আথালিপাথালি আমি, মাথাটা একটু তুলে আমার দু’পায়ের ফাঁক গলে, অ্যাম্ব্যুলেন্সের পেছন-দরোজার ছোট্ট জানলা দিয়ে দেখেছিলাম- আমার বিদায়পথের দিকে অপলক তাকিয়ে ধুলায় শুয়ে আছেন আমার মা, দু’হাতে মাথাটা চেপে দু’হাঁটু ধুলায় গেঁথে অবিশ্বাসে তাকিয়ে আছেন আমার বাবা, আমার কাছে পৌঁছুবে বলে, ছুটছে… ছুটছে… ছুটছে… আমার ছোট দুই ভাই, আমার বোন তখন ঘরের মেঝেয় অচেতন। আমি শেষ দেখা দেখেছিলাম আজন্ম প্রিয়তম মানুষগুলোকে আমার। আজ ছয়দিন, হাসপাতালের আইসিইউ-কক্ষের ভিতরে, শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছি আমি; ওষুধ নেই এই জগতে এ-ব্যাধির; এই যে ছয়-ছয়টা দিন বেঁচে ছিলাম, রোগপ্রতিরোধী পথ্য খেয়ে, যদি মিরাকল হয়, যদি সেরে ওঠে পরাজিত দেহটা আমার! হাজারে-হাজারে তো এভাবেই ফিরে যেতে পেরেছে মায়ের কোলে, বাবার বুকে!

আমি না-ফেরার দলে; আজ, ডাক্তারের চোখের দিকে তাকিয়ে, বুঝতে অসুবিধে হয়নি, আমি মারা যাচ্ছি; নার্সের চোখে আমি জল দেখেছি গতকাল, জেনেছি এই জন্মভূমি, এই পৃথিবী, আমার মায়ের বুক, আর আমার নয়।
এখন আমি মারা যাচ্ছি। জানি, আমার লাশটাকে ছুঁতে দেওয়া হবে না আমার পরিজনদের কাউকেই, জানি, আমার জানাজা হবে পাঁচজন পুলিশের সামনে, জানি, আমাকে দাফন করা হবে চারজন অনাত্মীয়ের কাঁধে চড়ে; মা নিষিদ্ধ, বাবা নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ আমার ভাই ও বোন, আমার কাছে, আমার লাশেরও কাছে। আমি জুয়েল, তাগড়া যুবক ছিলাম এক, বয়স ছত্রিশ, করোনাভাইরাসের কাছে হেরে যাওয়া, কাবু।

পৃথিবীতে আজ বেঁচে থাকা হে প্রিয় মানুষেরা, হাসপাতালের বিছানা থেকে বলছি, দয়া করে শুনবেন প্লিজ?-
আজ থেকে সতেরো দিন আগে মায়ের নিষেধ না-শুনে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলাম আমি; আহার যোগাতে নাকি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে নাকি হাওয়া খেতে- আজ তা অর্থহীন হয়ে গেলো, চিরতরে। জানি না, আমার দেহতে বয়ে নিয়ে এ-মরণব্যাধি আমার মা, বাবা, ভাই কিংবা বোনের দেহে সংক্রমণ করে দিয়ে মরে যাচ্ছি কিনা। মানুষ, ঘরে থাকবেন প্লিজ? এ মৃত্যু জগতের নির্মমতম মৃত্যু।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত