অনুরক্তি

অনুরক্তি

-“নবনীতা একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন?” কপালের সরে যাওয়া টিপ টা কপালে বসাতে বসাতে নবনীতা উত্তর দেয়,

-“নাহ, কারণ আপনি চাওয়ার আগেই পাওয়ার চিন্তা করছেন।”
-“ঠিক বুঝলাম না। ”
-“এইযে অনুরোধ করার আগেই রাখবো কিনা ভাবছেন।” ছেলেটা হো হো করে হেসে উঠে, অগত্যা আবারও প্রশ্ন করে,
-“আচ্ছা, চাঁদ দেখতে পাচ্ছেন?”
-“কই নাতো? আজ বোধহয় অমাবস্যা।”
-“আপনি কখনোই দেখতে পাবেন না।” মেয়েটা কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
-“কেন বলুন তো?”
-“চাঁদ কখনো নিজেকে দেখতে পায়? আপনি নিজেই তো চাঁদ।” নবনীতা বারান্দার গ্রিল মুঠোয় পুরে লাজুক চোখে হাসছে, দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগতে ভুগতে শাড়ির আঁচল টেনে সে বলে,
-“আপনি চাঁদ দেখুন, আমি আসছি।”
-“নবনী…!”

নাহ, আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নবনীতা রান্নাঘরে ছুটে গিয়েছে। অরণ্যের মুখে মুচকি হাসি, কফির মগটি হাতে নিয়ে চেয়ারে আরাম করে গা এলিয়ে বসে পরলো সে। কফি টা ঠোঁটে ছোঁয়াতেই ওয়াক করে উঠে অরণ্য, ঠান্ডা হয়ে কি বিচ্ছিরি স্বাদ হয়েছে কফি টার! কফি টা বিচ্ছিরি হলেও সন্ধ্যে টা যে অতুলনীয় ছিল তা ভাবতেই মুখটা হাসিতে প্রশস্ত হয়ে উঠে অরণ্যের।

মেয়েটার পুরো নাম নবনীতা সরকার, নবনীতা হলেও সকলে তাকে “নবনী” বলে ডাকতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করে, কিন্তু তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি কিনা জীবনে প্রথম বারের মত নবনীতা কে পুরো নাম নবনীতা বলেই ডাকেন। কবিরা বলেন প্রিয় মানুষদের ছোট খাটো নাম ধরে ডাকতে নাকি মধুর লাগে, অরণ্যের কাছে নবনীতা প্রিয় কিনা তা অরণ্যের মতো আমিও না জানলেও অপ্রিয় যে নয় এ সত্যে ছিঁটেফোটাও খাঁদ নেই।

রান্নাঘর থেকে চুড়ি আর পাতিলের টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে, অরণ্য বারান্দায় পায়চারি করছে, খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তার নবনীতা কে। বাহিরে বাতাস টা মনভোলানো, অন্ধকারে একটা অদ্ভুত সৌন্দর্যে সেজেছে আকাশ। এ সময়টায় কেউ একজন পাশে দাঁড়িয়ে গান শুনালে মন্দ হয় না। তার উপর নবনীতার গানের গলা খাসা। ইতস্তত করতে করতে ক্ষীণ গলায় ডেকেই বসলো অরণ্য,

-নবনীতা মেয়েটার কানে জোর আছে বলা চলে, আঁচল দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলো মুছতে মুছতে নবনীতা এসে সাড়া দেয়,

-“কিছু বলবেন?” অরণ্য ক্ষানিক অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
-“আসলে চিনি.. মানে চিনি আরকি। কফিতে কম হয়েছিল, দিয়ে খেতাম আরকি।” নবনীতা ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিহান চোখে উত্তর দেয়,
-“সে তো আপনার সামনেই ট্রে তে রয়েছে।” অরণ্য বোকাবনে গিয়ে ইতস্তত করে বলে,
-“ওহহ দুঃখিত খেয়াল করিনি, ধন্যবাদ।”

নবনীতা মুচকি হেসে ওপাশ ফিরে চলে যায়, এবার বেচারা অরণ্য লজ্জায় লাল হয়ে চেয়ারে বসে পরেন। অযথা অজুহাত দেখাতে গিয়ে ধরা পরার স্বাদ টা যে এতো দারুণ, তা আগে জানা ছিল না তার। নাহহ! আর গান শোনা হয়ে উঠলো না তার। তবে একারণে মোটেই অখুশি কিংবা আফসোস ও নেই তার। কারণ সব ইচ্ছে পূরণ করতে হয়না তাতে আশা বেড়ে যায়, ইচ্ছে গুলো মনের ভেতর পুষে রাখলে ক্ষানিক বাদে বাদে সেগুলো ঘন্টা হয়ে মনে আওয়াজ দেয়, পুলক জাগায়, শিহরিত করে।

অফিস শেষে অফিসের স্টাফ বাসেই বাড়ি ফিরেন অরণ্য, নবনীতা। আজও তার ব্যাতিক্রম কিছুই নয়। সহকর্মীদের সাথে এই সময় টা গল্প গুজবে বেশ দারুণ কাটে। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে বাসের দু’সারির দুই কোণে বসা দু’জন মানব মানবীর চোখে চোখে আলাপন টা খুব বেশি না হলেও সহকর্মীদের মশকরা, টিটকারি টা কখনোই কম হয়না৷ অনেকে আড়ালে আবডালে কিংবা ক্ষানিক প্রকাশ্যেই বলে বসে, “বয়স দু’জনেরই চল্লিশের কোঠায়, কিন্তু আচারে দেখো? সে কি প্রেম দু’জনার!! কেউ বা বলে, “নবনী ম্যাডাম ই বা কম কিসে, এ বয়সে বিয়ে করেছেন ভালো কথা, এখন এত আহ্লাদীপণা মানায়?”

কথা গুলোতে ভীষণ বিনদীত হয় নবনীতা, বয়সের সংখ্যায় সম্পর্কের সমীকরণ টা মিলাতে দেখে মাঝে মাঝে বেশ আফসোস ও হয় তার। চোখের সামনে একটা তরতাজা সম্পর্ককে বয়সের সাথে বলি দিতে এটুকু আফসোস ও মনে জাগেনা! নবনীতা হাসে, তবে এই হাসিটা তাচ্ছিল্যের। এবার ফাগুনে পরিচয়ের ছ’বছর পূর্ণ হলো তাদের। এইতো গেলো পাঁচ ফাগুন আগের কথা, অফিসের সব শাখার গেট টুগেদার অনুষ্ঠানে প্রথম পরিচয়। ধূসর রঙের তাঁত শাড়ী পরা নবনীতা কৃত্রিম লেকের রেলিং ধরে চোখ বুজে অনুষ্ঠানে গাওয়া রবীন্দ্র সংগীতের সাথে গলা মিলাচ্ছিল, পাশে দাঁড়িয়ে এক কাপ কফি তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অরণ্য বলেছিল,

-“বসন্তের হলুদ কে ছেদ করে ধূসর নিয়ে কেবল আপনি আমিই আবির্ভূত হয়েছি দেখছি!”

মিথ্যে বলেনি ধূসর রঙা পাঞ্জাবি পরিহিত আগন্তুক, বসন্তের এত হলুদ, গোলাপির ভিরে ধূসর রঙা কেবল তারাই ছিলেন। নবনীতা সৌজন্যবোধ থেকে কফি টা নিলেও কথা বাড়াতে চায়নি কোন কালেও। এরপর গোটা অনুষ্ঠানে কোথাও আর দেখা মিলেনি তার। তবে তাকে চমকে দিয়ে মাস দু’য়েক পর তাদের দ্বিতীয় বার দেখা হয়েছিল অফিসে, পাশাপাশি ডেক্সে। তারপর তৃতীয় দেখা, চতুর্থ দেখা, রোজ দেখা, পুরো সপ্তাহ দেখা এটা একটা রুটিনে পরিনত হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুত্ব টা কখনো হয়তো গড়ে উঠেনি, বা তার থেকে বেশি কিছুও কখনোই না। তবুও যেন বন্ধুত্ব আর প্রণয়ের গন্ডি কে ছাপিয়ে গিয়ে কিছু একটা গড়ে উঠেছিল দু’জনের মাঝে। যার রেশ ধরে সময়ের স্রোতে আরও পাঁচ টি বসন্ত পেড়িয়ে গিয়েছিল ।

“বিয়ে করতেই হবে” এ তাগিদ টা কখনো মনে না জাগলেও “সারাজীবন এক সাথে হাঁটা যায়” এ ধারনা টা তাদের মনে নাড়া দিতো প্রায়শই। তারপর “কখনো বিয়ে করবো না” বলে শপথ করা দু’জনের হুট করেই অনাড়ম্বর ভাবে দুই অক্ষরের একটা সম্পর্কে বাঁধা পড়া। যেখানে ইচ্ছে কম, আশা কম তবুও পূর্ণতা বিশাল! “কই? খারাপ ছিলাম নাতো?” নবনীতা আবারও হাসে, তবে এবারের হাসিটা স্বস্তির। “সজীব ভাই, গাড়িটা সাইড করে দাঁড়ান”। বাসের মাঝামাঝি সারি থেকে ড্রাইভার কে উদ্যেশ্য করে অরণ্যের গলা। এবার নবনীতার দিকে তাকিয়ে,

-” নবনীতা, আসুন।” নবনীতার ভাবনায় ছেদ পড়ে, মাঝ রাস্তায় নামা নিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে নবনীতা জিজ্ঞেস করে ,
-“এখানে..?”
-“হ্যাঁ, আসুন না।”

পুরো আকাশ টা সিঁদুরে মেঘে ঢাকা, গড়গড় আওয়াজ ও করছে বেশ। বাতাসের সাথে মিশে গিয়ে ভারী কুয়শার মত গুড়ি বৃষ্টিও রয়েছে। একটি খন্ড মেঘ কে কেন্দ্র করে পাশাপাশি একই সরল রেখায় দু’জন আনমনে হাঁটছে। মুখে সামান্য ‘রা’ টুকু ও নেই, তবুও যেন কত কথা মনে মনে।

মন পড়তে পারার এই এক সুবিধা, তাতে শব্দ খরচ করে অনুভূতি খন্ডিত হয়না। অরণ্যের হাতে একটি বকুল মালা, ঘরে ফিরে মালা টি স্থান পাবে বিছানার তলায়। হয়তো সাহস করে বলা হবেনা তার যে, “নবনীতা, এটা আপনার জন্য” তবুও তোষক নাড়িয়ে মালা টি হাতে নিয়ে নবনীতা ঠিক বুঝে যাবে এটি শুধু তার জন্যেই। কারন ঐ যে বলেছিলাম না মন পড়তে পারার সুবিধা? এটাও তার একটি। বাসি বকুল আর অপ্রকাশিত প্রেম দুটোই অমূল্য, কারন এরা পুরনো হলেও দারুণ সুবাস ছড়ায়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত