ম্যাম, এটি আমার সিট। দয়া করে আপনি আপনার সিটে গিয়ে বসুন!
-আপনার সিট মানে? আমি তো টিকিট কেটেই উঠলাম। টিকিট মাস্টার তো আমাকে এই সিটটাই দিলো।
-কই দেখি, আপনার টিকিটটা একটু দিন তো।
চাইতেই মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে টিকিটটি বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘আপনারা আসলে পারেনও বটে, যেই দেখলেন মেয়েলোক বসা অমনি এসে গেলেন তর্ক করতে’। আমি কোনকিছু বললামনা। জানি, এই বয়সে মেজাজ একটু গরম আর খিটখিটেই হয়ে থাকে। টিকিটটা চেক করে দেখলাম উনার সিট বি-২ আর আমারটা বি-১ অর্থাৎ, জানালার পাশে মেয়েটি যে সিটে বসা সেটি আমার সিট। এবার আমি বললাম, ‘আপনার একটু ভূল হয়ে গেছে। আপনি আমার সিটকে আপনার সিট মনে করে বসে গেছেন। আসলে, এদিকের সিটটা আপনার’। মেয়েটি এবার বিষয়টি বুজতে পারলো এবং কিছুটা লজ্জাও পেলো। ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আসুন! আপনি বসুন এসে আপনার সিটে’। আমিও গিয়ে বসে পড়লাম নিজের সিটে আর মেয়েটি আমার পাশে। আমাদের দুজনের গন্তব্য একই জায়গায়- সিলেট। আর বাসে উঠেছি কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে। আমি উনার টিকিটের সিট নং দেখার সময় সেটা দেখেছিলাম। অবশ্য, সেটা চোঁখে পড়েছিল।
বাসের সিটগুলো বেশ বড় বড় হওয়ায় দুজনের মাঝখানে অনেকটাই ফাক রয়েছে। তবে, মেয়েটির নিষ্প্রাণ ওড়নাটা কিছুক্ষণ পর পরই বাসে থাকা ফ্যানের বাতাসে উড়ে আসছিল আমার নাকেমুখে! আমি তখন বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। অপেক্ষা করছি কখন বাসটি ছাড়বে। কিছুক্ষণ যেতেই বাসটি ছেড়ে দিল আর কয়েকমুহুর্ত পরেই গিয়ে থামলো সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর টোল প্লাজায়। সবকিছুই স্বাভাবিক চলছিল। হঠাৎ মেয়েটি নিরবতা ভেঙ্গে দিয়ে বললো;
-কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
-জ্বী অবশ্যই। বলুন কি জানতে চান!
-আসলে, আমার ফোনের টাকা শেষ হয়ে গেছে। কলেজ কাল খুলবে। আজ আপাতত এক বান্ধবীর বাসায় উঠবো। ওর কাছে ফোন দিব। জানতে চাচ্ছিলাম যে আপনার কি বিকাশ আছে? মানে, আপনার সিম বিকাশ করা আছে কিনা বা টাকা আছে কি.. না…
-জ্বী আছে। কত টাকা লাগবে?
-এই ধরুন পঞ্চাশ টাকা হলেই চলবে।
আমি আমার ফোনটা বের করে আনলক করে উনার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
-এই নিন, টাকা রিচার্জ করে নিন!
-আমি কি করে রিচার্জ করব? আমি তো পিন নম্বর জানিনা আপনার!
-অসুবিধা নেই। আমি বলে দিচ্ছি।
-কেন, আপমার পিন নম্বর আমাকে বলবেন কেন?
-আমি রিচার্জ করে দিলে তো আপনার ফোন নম্বর জেনে ফেলব। পরে যদি আবার বলেন, মেয়ে মানুষ দেখলেই ফোন নম্বর নেয়ার ধান্ধা করি! তারচেয়ে বরং আপনিই রিচার্জ করে নিন আর মেসেজও ডিলিট করে দিয়েন।
এটা বলতেই মেয়েটি হেসে উঠলো। ‘আসলে আপনি তো বেশ মজার মানুষ। সিট নিয়ে আমি আপনাকে কিনা কি বললাম আর সেটা নিয়ে এখন আমায় খোঁচা দিলেন তাইনা?’ আমিও খানিকটা হাসলাম উনার কথা শুনে। ততক্ষণে বাসটি আশুগঞ্জ পেরিয়ে গেছে। আমি পিন নম্বর বললাম আর মেয়েটি টাকা রিচার্জ করে নিল। আমি জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছি আর মেয়েটি ব্যস্ত মেসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ে। সেটা বুজতে পারি মেসেজ আসার টিংটং শব্দ শুনে। বাস চলেছে তার আপন গতিতে।
দীর্ঘক্ষণ পথ চলার পর আমাদের বহনকারী বাসটি মাধবপুর বাজারে এসে পৌঁছেছে। সেখানে থামতেই কিছু হকার ওঠে বাসে। একটি ছেলে বাদাম আর বুট নিয়ে এসে থামে আমাদের সামনে। বয়স দশ-বারো হবে। ‘আপা নেননা পাঁচ টাকার বাদাম। দুলাভাইকে নিয়ে বাদাম খেতে খেতে যাবেন খুব ভালো লাগবে। দিই পাঁচ টাকার বাদাম!’ -ছেলেটির মুখে এমন আজব কথা শুনে আমি রীতিমতো অবাক হলাম। ধমক দিয়ে বললাম, ‘এই ছেলে, কি সব আজেবাজে কথা বলতেছ?’ -আপনি থামুন তো, ওর কি দোষ, ও কি জানে নাকি আমরা যে একেঅপরের কেউ নই। ওর দেখে যা মনে হয়েছে তাই বলেছে। আপনি দিন বিশটি টাকা। বাদাম খাব। মেয়েটির মুখে কথাগুলো শোনার পর কিছুটা অবাক হই আবার ছেলেটিকে ধমক দেয়ার কারণে লজ্জাও পাই। কিছু না বলে পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটি নোট বের করে দিলাম। ছেলেটির থেকে দশ টাকার বাদাম রেখে বাকি চল্লিশ টাকাও ছেলেটিকে ও দিয়ে দিলো। আমি কোন প্রতিবাদ করিনি তাতে এই ভেবে যে, পরে আবার কোন ভাষণ শুনতে হয়!
-আপনি জানেন কেন ছেলেটিকে ঐ চল্লিশ টাকা দিয়ে দিয়েছি?
-নাহ জানিনা। কেন দিয়ে দিয়েছেন?
-এটা হলো ওকে আপনার ধমকে দেয়ার কাফফারা। আপনি ধমক দিয়ে ওর মনে কষ্ট দিয়েছেন আর আমি আপনার টাকা দিয়েই ওকে আবার খুশি করে দিয়েছি। এই নিন বাদাম খান এবার। -এই বলে বাদামের ঠোঙ্গাটি আমার দিকে এগিয়ে দিল মেয়েটি।
-আপনার নামটা যেন কি? -আমি জানতে চাইলাম।
-ঝুমুর। ঝুমুর চৌধুরী। আপনার নাম?
-আমি রিফান। রিফান ভূঁইয়া।
-তা কি করেন আপনি? -ঝুমুর জানতে চাইলো।
-চাকরী করি একটি বেসরকারি প্রতিষ্টানে।
-ওহ ভালো। তা আপনি কি আমার কোন কাজে বিরক্ত বোধ করছেন বা আমার পাশে বসে আন ইজি ফিল করছেন?
-কই নাতো।
-তাহলে তো ভালোই। তা, আমার নম্বর চাইবেননা?
-কেন, আপনার নম্বর চাইবো কেন?
-এখনকার ছেলেরা তো তাই করে। পড়াশোনার সুবাদে কতবার যাতায়াত করেছি সিলেট থেকে ভৈরব। অনেকবারই এমন হয়েছে।
-নাহ, আমি তেমন নই।
-সেটা আমি প্রথমেই বুজতে পেরেছিলাম।
-কি করে বুজতে পেরেছিলেন?
-আমি ইচ্ছে করেই আপনার সিটে বসেছিলাম। অবশ্য যদিও জানতামনা কোন পুরুষ নাকি মহিলা এই সিটে আসবে। পরে যখন মেয়ে মানুষ দেখেও আপনি আমাকে সিট থেকে উঠিয়ে নিজের সিটে বসলেন তখনই বুজতে পারি আপনি একটু ডিফারেন্ট। নয়ত, আমাকে ইম্প্রেস করার জন্যে হলেও সিটে ছাড়তে বলতেননা।
-আপনি তো দেখছি বেশ সাংঘাতিক মানুষ! -আমার এমন কথা শোনে ঝুমুর একটু হাসলো।
হঠাৎ করেই মনে হলো বাসের গতি কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। সামনে দুটি বাসের এলোমেলো এগিয়ে চলা আর পেছন থেকে ধাওয়া করতে থাকা আরেকটি বাসের হরণ শুনে বুজতে বাকি রইলনা যে, ড্রাইভাররা প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছে। যাত্রীরা চেঁচামেচি শুরু করে দেয় এবার। ড্রাইভারকে আস্তে চালাতে বলে কয়েকজন। আমিও বলি। আবার বেশ কজনকে দেখলাম এই প্রতিযোগিতা বেশ উপভোগ করছে আবার মোবাইল ফোনে তার ভিডিও ধারনও করছে! ড্রাইভার আমাদের কারোর কথায় ভ্রুক্ষেপ করেনি। ধীরে ধীরে গতি বাড়াতেই থাকে। সে চাইছে যে করেই হোক পেছনের বাসটিকে সাইড না দিয়ে সামনের দুটো বাসকেও পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে! সে লক্ষ্যেই সে গতি বাড়িয়েই চলেছে।
সামনের দুটো বাস এবার বরাবর একপাশ হয়ে এগুচ্ছে। আমাদের ড্রাইভার সামনের দিকে বেশ খানিকটা পথ ফাঁকা দেখতে পেয়ে বাস দুটোকে ওভারটেক করতে যায়। একটিকে ওভারটেক করেও ফেলে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অমনি কোত্থেকে যেন একটি মালবাহী ট্রাক এসে সরাসরি আমাদের বাসের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা খায়। নিমিষেই সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। এরপর কি হয়েছে না হয়েছে আমি কিছুই জানিনা। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখি আমি হাসপাতালে। আমার হাতে-পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ করা। নাহ, হাড়টার ভাঙ্গেনি আমার। বড় কোন আঘাতও পাইনি। বেড থেকে নেমে গিয়ে এক নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে কি বাস দুর্ঘটনায় আহত হওয়া সবাইকেই আনা হয়েছে?’ -নাহ, অন্যান্য জায়গাতেও নেয়া হয়েছে। তবে, বেশিরভাগ মানুষকেই এখানে আনা হয়েছে। এই বলে নার্স চলে যায়।
আমি মনে মনে ঝুমুরকে খুজতে লাগলাম। ওর কিছু হয়নি তো। ও ঠিক আছে তো। পাশের ওয়ার্ডে গিয়েই দেখি ঝুমুর শুয়ে আছে একটা বেডে। তারও হাতে-পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ। ও চোঁখ বুজে আছে। হয়ত অজ্ঞান। দায়িত্বে থাকা নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই পেশেন্টের কি অবস্থা কিছু জানেন?’ -হ্যাঁ জানি। উনার প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। অনেকেরই রক্ত লেগেছে। উনাকে আমরা রক্ত দিতে পারিনি। আমি এবার ঝুমুরের রক্তের গ্রুপ জানতে চাইলাম। মিলে গেল ওর সাথে আমার গ্রুপ। আমি দিতে চাইলে প্রথমে নার্স না করলেও পরে জোর করাতে রক্ত নিতে রাজি হয়। রাত দশটার দিকে ঝুমুরের জ্ঞান ফিরে আসে। চোঁখ মেলতেই আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে ওকে হাসানোর চেষ্টা করি। ও এবার তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে বলে উঠলো, ‘আমি এখানে কেন? আর আপনি কে?’
ঝুমুরের কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। বাস দুর্ঘটনার পর সেখানে ঠিক কি ঘটেছিল বা হয়েছিল তার কিছুই জানিনা আমি। আর বাসে ঝুমুরের সাথে একটা মোবাইল আরেকটা ব্যাগ ছিল। সেগুলোর কি হয়েছে কে জানে। এখন ও আমাকে চিনতে পারছেনা। মাথায় বড় ধড়ণের আঘাত পাবার কারণেই হয়ত এমন হয়েছে ওর। ও বলেছিল কাল ওর কলেজ খোলা। কিন্তু কলেজের নাম বলেনি। বাড়িরও কোন ঠিকানা বা তেমন কিছু বলেনি। আর বলবেই বা কেন, আমি তো সেসবের কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। এখন ওকে কি করব আমি। এভাবে একা ফেলে রেখেও তো যেতে পারিনা।
এমন সব প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল ঠিক তখনি সিনিয়র একজন ডাক্তার আসলেন ঝুমুরকে দেখতে। আমাকে পাশে বসে থাকতে দেখে ডাক্তার জানতে চাইলেন, ‘আপনি কে? আর পেশেন্ট কি হয় আপনার?’ -নাহ মানে…, আসলে…, ইয়ে…,এভাবে আমতা আমতা করতে থাকি আমি। ‘আপনিও তো দেখছি মারাত্মকভাবে ইনজোরড। বুজতে পেরেছি, আপনার স্ত্রী হন উনি। তা কি নাম আপনার স্ত্রীর?’ -আমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তাররে প্রশ্ন। এবার মুখ খুললো ঝুমুর। ‘আপনারা আমাকে নিয়ে কি সব বলছেন নিজেদের মধ্যে? দয়া করে কেউ আমাকে বলবেন কি আমাকে কেন আর কি করে এখানে আনা হলো?’ -ঠিক সে সময়ে ডাক্তারের ইশারায় একজন নার্স ঝুমুরকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দেয়।
এবার ডাক্তার আমার কাছে জানতে চান;
-কি ব্যাপার, আসলে বিষয়টা ঠিক কি হয়েছে আমার কাছে খুলে বলুন তো!
ডাক্তারের প্রশ্নের জবাবে আমি এবার পুরো ঘটনা খুলে বললাম। তিনি খুব মন দিয়ে শুনলেন আমার কথাগুলো। আমিও উনার কাছে এর একটা সমাধান চাইলে তিনি আমায় বললেন, ‘দেখুন, বিষয়টা খুবই জটিল। এখন সবার আগে যে কাজটি করা জরুরী সেটি হলো মেয়েটির জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল বের করা এবং তার বাড়ির ঠিকানা খুজে বের করা। তা না হলে বিষয়টা আরো জটলা বেঁধে যাবে’। আমি এবার ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতালের সামনে থাকা বিকাশের দোকান থেকে কিছু টাকা ক্যাশ আউট করলাম এবং হালকা খাবার নিয়ে আসলাম ঝুমুরের জন্য। ততক্ষণে মধ্যরাত হয়ে গেছে। ঝুমুর সজাগ হয়েছে এবার।
-কি ব্যাপার, আপনি আসলে কে বলুন তো? আর আপনি এভাবে আমার এত কাছে ঘেষে বসে আছেন কেন? -উত্তেজিত কণ্ঠে ঝুমুর আমাকে প্রশ্ন করলো।
-দেখো, আমি রিফান। তোমার নাম ঝুমুর। আমরা একসাথেই ভৈরব থেকে বাসে করে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম। বাসেই আমাদের পরিচয়। পথিমধ্যে আমাদের বাসটির এক্সিডেন্ট হয়ে যায় আর তারপরই আমাদেরকে এখানে নিয়ে আসা হয়। তোমার কি তাহলে সেসবের কিছুই মনে নেই?
-কি সব আবোলতাবোল বকছেন! আমার নাম ঝুমুর হতে যাবে কেন? আমি তো… আমি তো… আমার নাম তো…. -এবার চেঁচামেচি করতে শুরু করে দেয় ঝুমুর। তা শুনে কয়েকজন নার্স ছুটে আসে। আবার তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দেয় ওরা।
রাতের বেলায় এমন হট্টগোল হওয়ায় সিনিয়র ঐ ডাক্তার আমাকে তার কেবিনে ডেকে পাঠান। দরজার কাছে গিয়ে আমি বলি;
-স্যার আসব?
-জ্বী। আসুন। বসুন এখানে।
-স্যার, আমাকে ডাকার বিশেষ কোন কারণ!
-তেমন কিছু না হলেও একটা কথা আপনাকে না বললেই নয়। দেখুন, এটা একটা হাসপাতাল। এখানে সময় ধরে কেউ আসেনা। যখনতখন রোগীরা চলে আসে। তাদেরকে আমাদের বেড দিতে হয় সেবা দিতে হয় আরো কত কি। আপনার যে পেশেন্ট মানে, আপাতত আপনার পরিচয়েই যেহেতু উনি আছেন, উনাকে আমরা কাল সকাল নাগাদ রাখতে পারবো। তারপর রিলিজ করে দিতে হবে। আর উনার যে প্রবলেমটা মনে হচ্ছে ঐ স্মৃতিশক্তির হারানোর বিষয়টি, সে বিষয়ে যদিও এখনো রিপোর্টে আমরা তেমন কিছু পাইনি তারপরও উনি ঠিক কবে নাগাদ সুস্থ হবেন সেটা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আশা করি আপনি বুজতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি। এবার বাকি বিষয়টা আপনাকেই হ্যান্ডেল করতে হবে।
ডাক্তারের কাছ থেকে কথাগুলো শোনার পর আমি আরো হতাশ হয়ে পড়লাম। কি করব না করব মাথায় কিছুই কাজ করছেনা। অবশেষে ভোরবেলায় ভূলিয়ে বালিয়ে কোনরকম বুজ দিয়ে ঝুমুরকে নিয়ে সিএনজি রিজার্ভ করে চললাম সিলেটের উদ্দেশ্যে। দুপুর নাগাদ সেখানে গিয়ে পৌঁছুই। ফোন দিলাম সহকর্মী বন্ধু তামিমকে। ও ফ্ল্যাট নিয়ে পরিবার সহ থাকে। ওকে সবকিছু বলার পর সেও বিষয়টা বুজতে পারে এবং ঝুমুরকে কিছুদিনের জন্যে ওদের বাসায় ওর স্ত্রীর সাথে রাখতে রাজি হয়। গেলাম ওদের বাসায়। ঝুমুরকে বলে রেখেছিলাম যেন সবসময় চুপচাপ থাকে নয়ত ওর চরম বিপদে পড়তে হবে। ও তাই করতে থাকে। তামিমের বাসায় যেতেই তামিম তার স্ত্রীকে রুমে ডেকে নিয়ে সব বলে দেয়। তামিমের স্ত্রীও বিষয়টা বুজতে পারে।
দুপুর পেরিয়ে বিকাল গড়িয়ে এলো। পেঠে এখনো ভাত পড়েনি। আমাদের এমন অবেলায় আগমনে ওদেরও সময়মতো খাওয়া হয়নি। এবার সবাই মিলে টেবিলে খেতে বসলাম। কিন্তু একি! সবাই আছে অথচ ঝুমুরকে দেখতে পাচ্ছিনা সেখানে। তামিমের স্ত্রী এবার ফ্ল্যাটের সবগুলো রুমে রুমে গিয়ে ওকে।খুজতে শুরু করে। শেষে ড্রইংরুমে যাবে অমনি সেখান থেকে ফোনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসে ঝুমুর! সবাইতো একেবারে অবাক! কি ব্যাপার! ঘটনা কি তাহলে? ঝুমুর এবার আমাদের সবার সামনে বসে ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা লোকটিকে বলতে থাকে; ‘দেখো বাবা, তুমি তোমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিবে বলে একেবারে উঠেপড়ে লেগেছিলে তাইতো, এখানে তোমার মেয়ের জামাই পেয়ে গেছি আমি। এড্রেস দিচ্ছি কালই চলে এসো। কথা বলে যাবা এসে’। ঝুমুরের মুখে এসব শুনে বসা থেকে দাড়িয়ে যায় রিফান। ‘কি! আপনি তাহলে এসব নাটক করেছেন?’
-‘নাহ, নাটক করিনি। আসলে, আমি আরো লেখাপড়া করতে আগ্রহী। কিন্তু বাবা চাচ্ছেন এক্ষুণি বিয়ে দিয়ে দিতে। তবে বাবার পছন্দের কাউকেই আমার পছন্দ হচ্ছিল না। এদিকে কলেজও খুলে যাচ্ছিল। আর আসার সময় বাসে আপনার কথাবার্তা আর আচরণে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। স্বাদ জাগে আপনার মতো কাউকে স্বামী হিসেবে পাবার। তাই বাহানা করে আপনার ফোন নিই। কল লিস্টে শুধু বন্ধু, বাবা-মা, অফিস স্টাফ এসবের নম্বর আর ওয়ালপেপারে মুরুব্বি মহিলার ছবি দেখে নিশ্চিত হই আপনি অবিবাহিত। শুধু এটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট ছিলনা। তারপর ভাগ্যক্রমে রাস্তায় দুর্ঘটনা হয়।
তখন অবশ্য আমার কোন জ্ঞান ছিলনা। তবে হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর ঠিক করি এটাই সেরা সুযোগ আপনাকে যাচাই করার। তখন স্মৃতিহীন হয়ে যাবার ভান ধরি। আপনি চাইলেই আমার এমন দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমার সবকিছু কেড়ে নিতে পারেন এবং আপনি তেমনটি করতে উদ্যোত হন কিনা সেটা যাচাই করাই ছিল আমার মূল লক্ষ্য। কিন্তু আপনি তা না করে আমাকে সসম্মানে আপনার বন্ধুর বাসায় নিরাপদ জায়গায় এনে রাখলেন। এবার আপনিই বলুন, আপনার মতো মানুষকে কি নির্দ্বিধায় বিয়ে করা যায়না?’
-আমি সহ বাকি সবাই হা করে ঝুমুরের কথাগুলো শুনলাম। এবার বন্ধু তামিম আমার পিঠ চাপড়ে বললো, ‘বন্ধু আমার যেমনতেমন একখান ভাবী পেয়েছি আমাদের মনের মতন!’ -তামিমের মুখে এটা শোনার পর তামিমের স্ত্রী ঝুমুরকে নিয়ে অন্য রুমে চলে যায়। আমি কখনো ভাবতে পারিনি বাস যাত্রায় এমন আজব কোন মেয়ের সাথে সাক্ষাত হবে আমার! ঝুমুরকে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে জানিনা, যেই মেয়ে আমাকে যাচাই করার জন্য এতবড় ঝুঁকি নিলো তার সঙ্গে কেমন কাটবে আমার জীবন সংসার।