দেনমোহর

দেনমোহর

বিয়ের আসরে পাত্রীর সাহসী কথায়, সবাই মোটামোটি স্তম্ভিত।। সরগরম পরিস্তিতি একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো।। পাত্রী কাজি কে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠলো —

–কিসের পাঁচ লক্ষ এক টাকা দেনমোহর ……?? তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠলো —
–এই আপনি আজকের মধ্যে আমাকে পাঁচ লক্ষ এক টাকা দিতে পারবেন?? পাত্রীর কথা শুনে আমার বিয়ে করার স্বাদ প্রায় যায় যায় অবস্থা।। কিন্তু যখন পাত্রীকে দেখতে এসেছিলাম তখন তো ওর এরূপ রূপ দেখি নাই।। কি বলি এখন,,,,,,?? তারপর হঠাৎ ই আমার বাবা বলে ওঠলেন …

–মা তু তুমি কি বলছো? বাবার কথা শেষ না হতেই, হাত জোড় করে বাবাকে বললো–

–প্লিজ বাবা, আপনি কিছু বলবেন না।। অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা চুপ হয়ে গেলেন।।।। এবার আমার উত্তর দেওয়ার পালা।। কি বলি ভেবে পাচ্ছি না। এদিকে আসরের লোকজন সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেনো চিড়িয়াখানার সদ্য নতুন প্রাণী। কাচুমাচু করে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলাম পারবো।। কিন্তু মেয়ের বোধহয় বিশ্বাস হলো না, তাই আবারো বললো –

–দেখুন ভেবে বলুন,,,। আমি জানি আপনার বাবার সহায়তায় আপনি আমাকে কোটি টাকাও দিতে পারবেন। কিন্তু নিজের টাকা কতটা দিতে পারবেন, তাই বলুন।। সবার নজর এবার মেয়ের দিকে।। অনেকেই বলাবলি করছিলো, ঠিকই তো বলছে মেয়ে।। ছেলের নিজের যোগ্যতা কতটুকু তা দেখা দরকার।। মনে হলো সব বিজ্ঞ উকিল।। এবার আমার বাবার মুখেও সামান্য হাসির রেখা।। কেননা আমার অকর্মণ্যতা নিয়ে বাবা মাঝেমাঝেই প্রশ্ন তোলেন।। সামান্য অপমানবোধ নিয়ে বললাম —

–তাহলে আর এক লাখ কম করা হোক।। এবার সবার নজর আবারো আমার দিকে।। এবারো মেয়ে আমার যোগ্যতাকে অবিশ্বাস করছে।। বললো আরেকটু ভেবে বলুন।।। লে সালা,,,,,, বিয়ে করতে এসে দেখি মহা ঝামেলায় পড়লাম।। তাইতো মাকে বারবার বোঝালাম,, অযথাই বাড়তি ঝামেলা বাসায় আনার দরকার নেই।। কে শোনে কার কথা।। যাকগে আমার কি,,,, যা বোঝার বাড়ির লোকই বুঝবে।। আমি বরং বিয়েটা মনোযোগ দিয়ে করি।।

মেয়ের ভয়ানক চাহনির দিকে তাকিয়ে শেষমেশ তিন লাখ টাকা ঠিক করলাম।।। এবার মেয়েটা মনে হয় কিছুটা বিশ্বাস করলো আমার সাধ্যি কে। যাইহোক কোনোমতো বিয়েটা সম্পন্ন হলো।। এবার বিদায়ের পালা।।। মনে করলাম এইবার বোধহয় মেয়েটা কাদতে কাদতে কোনঠাসা হবে।। ওম্মা একি,,,,,, মেয়েই ওর বাবা মাকে আরো সান্তনা দিচ্ছে আমি কি একেবারে চলে যাচ্ছি নাকি।। যখন তোমাদের কথা মনে হবে চলে আসবো।।। শুধু ছোট ভাইয়ের থেকে বিদায়ের সময় একটু চোখের জল ফেলেছিলো মেয়েটা।।। আমি সহ পুরো বরযাত্রী টিম অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে।। শুধু আমি কেনো পুরো টিমই বুঝে গেলো,,,, এবার আমার তেজপাতা হওয়ার দিন চলে এসেছে।।। এই ব্যাপারে সবাই তেমনটা খুশি না হলেও,,, আমার বাবা তার এমন বউমা পেয়ে চরম খুশি।।

কোনোমতো বিদায় পর্ব শেষ করে চলে আসলাম আমাদের বাড়িতে।।। নিজের বাড়িতে এসে আমার সাহসের উন্নতি হবে, সেটা সবাই ভেবে নিয়েছিলো, এমনকি আমিও।।। কিন্তু কিসের উন্নতি,,,,,?? আমিতো সাহস দেখানোর জায়গাই পাচ্ছি না।। বিয়ে করে আনার পর ছেলেরাও যে পর হয়ে যায়, তা আমার মা আর আত্বীয় স্বজনকে না দেখলে বুজতেই পারতাম না।। আমার দিকে কারো কোনো খেয়ালই নেই, সব আধিখ্যেতা বউ কে নিয়ে।। যে যার মতো নতুন বউ কে নিয়ে ব্যস্ত।। এমনকি আমার যে খুদা লাগছে, সে বিষয়েও কাউকে কিছু বলতে পারছি না।। যাইহোক অনেক কষ্ট আর ঝামেলার মধ্য দিয়ে দিনটা পার হলো।।।

তারপর এসে গেলো সেই মাহিন্দ্রক্ষন, মানে বাসরের তরজোড়।। কিন্তু আমার তো সেই রকমের অস্বস্তি হচ্ছে, যে টাইপের মেয়ে এসে জুটলো, জানি না আজকে কি হবে?? সমস্ত জটিলতার অবসান ঘটিয়ে শেষমেশ বাসর ঘরে প্রবেশ করলাম।। আমি ঢ়ুকতেই সুন্দর করে এক হাসি দিয়ে মেয়েটা আমাকে সালাম করলো।। আমার ভালোই অবাক লাগছিলো।। হঠাৎ বোল পালটে ফেল্লো কেমনে,,,,,?? নাকি অভিনয় শুরু করছে,,,?? কে জানে?? যাকগে এবার আমার সাহস দেখানোর পালা এসে গেছে।।। রংধনুর রং আমিও ওকে বীরের মতো করে বললাম,,, ঠিক আছে, ঠিক আছে।। সালাম করতে হবে না।। বলেই ওর বাহুদুটো ধরে আদরের চোখে ওকে তুলতে গেলাম।। তারপর আরেকটু কাছে যাওয়ার চেষ্টা করতেই, এক ঝটকায় আমাকে সরিয়ে দিলো।। আর তরতর চোখে আমার দিকে তাকালো।। আমারতো আবারও শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। না জানি কি রূপ যে এখন আবার দেখাবে,,,,,?? তাই একটু শান্ত গলায় বললাম–

–কি হয়েছে,,,?? এনিথিং রং??
–ওয়াট ইজ রং,,,,,? আপনি তো পুরাটাই রং,,,, দেখছি।। খুব কাছে আসার চেষ্টা চলছে,,,, নাহ,,,,??আগে দিনমহরের ফুল টাকা পরিশোধ করুন, তারপর যা হবার হবে।।। আমি ভাব দেখাতে বলে ওঠলাম —

–আর যদি না দেই,,,,,,,,!!!
–আমিও চিৎকার করে আপনার গুষ্টির ষষ্ঠী করে ফেলবো।।।

ভীষন লজ্জা আর ভয় পেয়ে গেলাম।। আর ব্যাকামো করা যাবে না।। চুপচাপ ওর আবদার পূরন করতে হবে।।। কোনোমতো গহনাপাতির অজুহাত দিয়ে দুই লাখ টাকা মিল করলাম।। কিন্তু তাতেও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বোঝাতে হয়েছে।।। মনে করলাম একটু শান্ত হবে।।। কিন্তু বাদবাকী টাকাও তখনই দিতে বললেন মহারানি।। কি আর করার একমাসের গচ্ছিত ৫০ হাজার টাকাও নগদ দিয়ে দিলাম।।। খুব কষ্ট হচ্ছিল।। হাজার হোক নিজ উপার্জনের টাকা তো।।। যাইহোক আড়াই লাখ টাকা মিল করলাম।।। তারপর একটু বোঝাতে চেষ্টা করলাম, যে বাদবাকী টাকা দিয়ে দেবো, অর্থাৎ বাকি রাখতে চাইলাম।। কিন্তু তাতে মহারানির রাগ আরো তিনগুন বৃদ্ধি পেলো।। বললো —

–তিন লাখ টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন?? আর পাচ লাখে বিয়ে পড়াতে চাইছিলেন না?? তারপর আরেকটু মেজাজ ঝারলো মহারানি।। যখন আর কোনোভাবেই আমার কাছ থেকে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা পাচ্ছিল না, তখন এক মাস্টার প্ল্যানের উদয় হলো আমার সদ্য বিবাহিত নতুন বউয়ের।। লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা।। কি আর বলবো বউ আমার হেব্বি স্ট্রং।। কেননা কিছু করার মতো সুযোগও আমায় দিচ্ছিল না, চুপচাপ ওর অত্যাচার সইতে হচ্ছিল আমার।। কথায় কথায় চিৎকার করে লোক ডাকার হুমকি দেয়।। কি এক লজ্জার ব্যাপার বলুনতো,,,,,?? বাসর ঘরে কি এমন কাজ সোভা পায়,,,,,?? যাইহোক এবার বউয়ের মাস্টার প্ল্যানে আসা যাক।। যখন কোনো উপায়েই আর টাকা হাসিল করতে পারলো না, তখন শান্ত ভাবে বসে কি যেন ভেবে বললো —

–বাহ আপনার হাত ঘড়িটা তো বেশ সুন্দর।। কত দিয়ে কিনেছেন?? আমিও সোজা সরলভাবে বললাম —

–বেশ সুন্দর। দশ হাজার টাকায় কিনেছি।। বলার সাথে সাথেই টুপ করে ঘড়িটা হাত থেকে খুলে বললো —

–যেহেতু সেকেন্ড হ্যান্ড, তাই অর্ধেক দামে দিনমহর হিসেবে নিয়ে নিলাম।। দিন এবার বাদবাকি পঁয়তাল্লিশ হাজার দিন।। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।। কিন্তু ওখানেই শেষ না।। তারপর সরাসরি আমার ইজ্জতে হামলার সম্ভাবনা দেখালো আমার সদ্য বিবাহিত বউ।। সুন্দর চাহনি নিয়ে আমার সদ্য কেনা শেরোয়ানির দিকে তাকালো।। আমি তো পুরাই শেষ।। তারপর বললো

–আপনার শেরোয়ানি টা সুন্দর।। তা এটাও নিশ্চয় দশ হাজারে কেনা।। না বলতে চেয়েও, ভয়ে মাথা নেড়ে বসলাম, হুম দশ হাজার টাকা।। তারপর আর কি ওটাও খুলে নিয়ে নিলো বউ।। তারপর আর উপায় না দেখে বলে বসলাম —

—প্লিজ আর নিচে যাবার চেষ্টা করবেন না।। এমনিতেই সবটা দিয়ে দিয়েছি।। দেখলাম মহারানি মুখ লুকিয়ে ফিক ফিক করে হাসছেন। আমিও সব হিসাব কড়ায় গন্ডায় তুলে রাখছি।। সুযোগ একদিন আমারো আসবে, এই সান্তনায় নিজেকে দমিয়ে রাখলাম, শান্ত বীরপুরুষের মতো।। তারপর আর বাড়াবাড়ি না করে, বললো —

–ঠিক আছে, আর কিছু নেবো না।। এবার বাদবাকি চল্লিশ হাজার দিন, নয়তো নিচে ঘুমান।। আমিও চটপট আর কথা না বাড়িয়ে বীরপুরুষের মতো সুযোগটা কাজে লাগালাম।। কোনোমতো বালিশটা নিয়ে চুপচাপ সুয়ে পড়লাম।। আর রাগে ফুসতে ফুসতে মন কে বোঝালাম – আর কখনও বিয়ে করলে দিনমহর গুছিয়েই করবো, নয়তো সারাজীবন আইবুড়ো থেকে যাবো।। তবুও কোনো অত্যাচারিণীর হাতে অত্যাচারিত হবো না।।

সারাদিনের ধকলে, তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে গেলাম।। অভিমানে মহারানির আর খবর নেই নি।। প্রায় শেষরাতের দিকে ঘুমটা একটু ভেঙ্গে গেলো, চোখ খুলেই আমি তো তাজ্জবনে গেলাম।। দেখি মহারানি আমাকে জড়িয়ে শান্তভাবে সুয়ে আছে।। আমারতো আনন্দে ইদ লাগার যো।। তাহলে বোধহয় বাদবাকি টাকা মহারানি মাফ করে দিয়েছে।। তাই আনন্দে আমিও জড়িয়ে ধরলাম।। মহারানি জেগে গেলো।। টানাটানা মায়া মাখা চোখে আমার দিকে তাকালো।। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম —

–তাহলে বাদবাকি টাকা টার কি করলেন মহারানি?
–কি আর করবো মহারাজ,, ভাবলাম আপনার তো আজকে দেওয়ার সামর্থ্য হবে না,,তাই আপনার খাট টাকেই চল্লিশ হাজারে নিয়ে নিলাম।। কি ভালো করিনি মহারাজ ??? কি আর বলবো তখন, জোড়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম — আল্লাহ্ গো ….

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত