– মামা যাবেন?
– কই যাবেন মামা?
– ২ নং গেট?
– যামু মামা, ৩০ টাকা ভাড়া।
– ২৫ দেই?
– না মামা রাইত হইছে অনেক।
– কি আর রাত, সবে তো ১০ টা বাজে।
– আপনি একা যাইবেন?
– হুম, একাই, আমি যা খালি রিক্সাও তা।
– হা হা হা,আপনের যে শরীর, উঠেন মামা।
রিহান রিকশায় উঠেই প্যাকেটে থাকা সিগারেট বের করে ধরালো। রিক্শা কিছু দূর যেতে জিজ্ঞেস করলো,,
– আচ্ছা মামা, আপনার কাছে জীবন মানে কি?
– জীবন হইতাছে মামা, পোলাডারে মানুষ করা, একটাই পোলা আমার। ডাক্তার তো বানাইতে পারুম না, তয় শিক্ষিত বানাইতে পারুম। আর বাপ মা যতদিন আছে, তাগো সেবা করুম, এইডাই জীবন।
– হুম, বেশ ভাল
– আপনের কাছে জীবন কি মামা?
– আমার কাছে জীবন মানে কি?
– হ, মামা
– এইত চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন, আসলে আমার কাছে জীবন মানে কি তা জানতে চাইলে হাসবেন।
– না মামা, হাসুম না, বলেন আপনি, হাসার কি আছে।
– আসলে, এক এক জনের কাছে জীবন মানেইত একেক রকম, আমার কাছে জীবন মানেই হচ্ছে সকালে
অফিসে যাওয়া, অইখান থেকে টং এ আড্ডা দেয়া, ওইখান থেকে বাসার ছাদে শুয়ে শুয়ে তারা দেখা, গান শুনা আর সিগারেট টানা, এটাই আমার কাছে জীবন।
– হাহাহা
– বললাম না মামা হাসবেন আপনি।
– হাসুমিত মামা। এইডারে তো জীবন কয় না, এটা তো রুটিন।
– তাহলে কি এক কথায় বলব?
– বলেন মামা
– আমার কাছে জীবন মানেই হচ্ছে নিকোটিন
– হা হাহা, আবার হাসাইলেন মামা। এইডা তো নিশা। আইচ্ছা মামা বিয়া করবেন না?
– আমি? কে বিয়ে করবে?
– কি কন মামা, আপনেরে বিয়ে করবো না কিডা? কি সুন্দর কইরা কথা কন, ইস্মার্ট পোলা, কত সুন্দর হাসেন, আমার তো মনে হয় আপনের তিন, চাইর টা গার্ল ফেরেন্ড আছে।
– হা হা হা
– হাসেন কেন মামা, সত্যি কইছিনা?
– না মামা, এইসব কিছুই না।
বেশ কিছুদূর যেয়ে রিক্শা সাইড করল, রিকশা থামাতে থামাতে বলল, একটু মামা, একটা ম্যারিজ সিগারেট লই, সুখ টান দিই একটু।
– মামা আপনে রিকশা থামায়েন না, আপনি টানেন, আমার কাছে গোল্ড লিফ আছে। সিগারেটের রাজা।
– না মামা, দামী সিগারেটে নেশা ধরাইয়েন না। পরে পেটে টান পরব না?
– আরে ধুর মামা, একটায় নেশা ধরবেনা, আপনার পেটেও টান পড়বে না। ধরেন তো।
– আইচ্ছা মামা, দেন।
রিক্সা ওয়ালা মামা, সিগারেট ধরিয়ে, টান দিয়েই সূর করে গাইতে লাগল,, এক টানেতে ভিসন মজা দুই টানেতে প্রজা তিন টানেতে উজির নাজির চাইর টানেতে রাজা
– কি মামা, নিজেরে কি রাজা মনে হচ্ছে?
– হা হা হা, কি যে কন না মামা। আইচ্ছা, একটা কথা কই মামা?
– হুম বলেন?
– আপনি অনেক ভালা, সহজ সরল, এত সরল হওয়া ভালা না।
– হা হা হা
রুপ নগর কমিউনিটি সেন্টারের পাশ দিয়ে রিক্সা যাচ্ছে। কমিউনিটি সেন্টারে আলোক সজ্জা। বাহিরে সারি সারি গাড়ির বহর। তা দেখে রিকশা ওয়ালা বলল,,
– তারা কত সুখি না মামা?
– কিভাবে বুঝলেন?
– এই যে বিয়া করতাছে, কত আনন্দ করতাছে, সুখে থাকলেইত বিয়া করে মানুষ, ঠিক না মাম?
– হা হা হা, আচ্ছা মামা, আপনের কাছে সুখ কি?
– আমার কাছে সুখ মানে হইতাছে, মা বাবা আর বউ পোলা নিয়া যেইদিন ভাল খাইতে পারি, ওইডাই আমার কাছে সুখ। আপনের কাছে?
– সিগারেটে সুখ টান দেয়াই হচ্ছে আমার সুখ।
– ধুর মামা, কি যে কন না, আপনে দেখি সিগারেট ছাড়া কিছুই বুঝেন না।
– হা হা হা, জীবনে আর আছে কি? এটা ছাড়া? এটাইত একমাত্র সংগী সাথি।
– একটা কথা জিগাই?
– একটা না, যা মনে আসে তাই বলেন।
– আপনের লগে কথা বইলা বুঝলাম, যতক্ষন কথা হইল আর কি, আপনে অনেক কষ্টে আছেন?
– হা হা হা
– আবার হাসে, ঠিক কইছি না মামা?
– আরে ধূর, কিসের কষ্ট, এই যে দেখেন, রিক্সায় যাচ্ছি, বাতাস খাচ্ছি, সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছি, আমার থেকে সুখি কেউ আছে?
– হা হা হা, মামা, আমি বুঝি, আপনে কষ্টরে গিইলা গিইলা খান, আপনের হজম শক্তি ভালা, ইঞ্জিন ঠিকাছে, চাইনিজ না মামা।
– হা হা হা, আচ্ছা মামা, আপনের ছেলে কিসে পড়ে?
– কথা কাটাইতেছেন মামা? আপনেরা শিক্ষিত মানুষ, কথা কাটানোর ওস্তাদ। এইত মামা কেলাস ফোরে পড়ে, পড়া লেখায় মাশাল্লাহ ভালা, রোল তিন।
– হুম
– মামা এই পাশ কইরা নামামু নাকি রাস্তা পার করাইয়া নামামু?
– না, সাইড করিয়েই নামান, আমি চা, সিগারেট খেয়ে তারপর অই পাশে আরেকটা রিক্সা করে চলে যাব।
– আইচ্ছা। ২ নং গেট রিকশা থেকে নেমে রিহান মানি ব্যাগ বের করলো।
– মামা, এই নেন আপনার ভাড়া ২৫ টাকা, আর এই নেন, একশ টাকা, আপনের ছেলের জন্য কিছু নিয়েন।
– না না মামা, এইডা কেমনে হয়?
– আরে আপনাকে না, আপনের ছেলের জন্য দিয়েছি। চিপস আইস্ক্রিম নিয়ে বলবেন, তার এক চাচা দিয়েছে।
দেখবেন আপনের ছেলে যে হাসি টা দিবে, ওইটা লাখ টাকায়ও কিনতে পারবেন না। কি এমন হাসি দেখতে চান না? রিকশা ওয়ালা মামার চোখে হঠাত করে রিহান পানি নামক কিছু জিনিস স্পস্ট দেখতে পেল। রিকশা ওয়ালা মামা হঠাত করেই রিহানকে জড়িয়ে ধরে বলল, কবে আমার পোলারে চিপস কিন্না দিছি নিজেই ভুইলা গেছি মামা। আপনি অনেক ভালা মামা, অনেক ভালা। আপনের মত মানুষ আর দেখিনাই কোন দিন। আল্লাহ আপনেরে অনেক বছর বাচায়া রাখুক।
আসে পাশের বেশ কিছু মানুষ অবাক দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখতে লাগল। সচরাচর এমন দৃশ্য তারা হয়ত দেখেনা, বা আড়ালে অবড়ালে ঘটে যাওয়া অনেক দৃশ্যই তারা দেখতে পায় না। এই দৃশ্য প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায় তাই তারা হয়ত বেশ অবাক ভাবেই দেখছে। এক প্যাসেঞ্জার কে এক রিকশা ওয়ালা জড়িয়ে ধরে কাদছে, আর দোয়া করছে। তাই হয়ত এই অবাক দৃষ্টির সৃষ্টি। বেশ কিছুক্ষন পর, রিক্শা ওয়ালা রিহান কে ছেড়ে, তার রিকশা টেনে উল্টা দিক করে নিয়ে যাচ্ছে, আর বার বার পিছন ফিরে রিহান কে দেখছে।
রিহান অই দিকে আর না তাকিয়ে, আশ পাশের উৎসুক মানুষের দিকে তাকিয়ে নীরব বোবা হাসি দিয়ে টং এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর ভাবছে,, নাহ, এই রিকশা ওয়ালা মামা দেখছি অনেক দিন তার মগজে মগজে পায়চারী করবে। রিহান তার হাত ঘড়িতে সময় দেখল। রাত দশ টা বেজে পনের মিনিট। টং এর দিকে ক্রমস এগিয়ে যেতে লাগল সে, টং এ এখনো বেশ কিছু মানুষ নিজেদের ধোয়ায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ধোয়ার অবয়ব তাদের বেশ রহস্যময় করে তুলেছে। রিহান মনে মনে ভাবছে,, আচ্ছা তাদের জীবন কি এই ধোয়ার মতই রহস্যময়? তাদেরও কি রিহানের মত অনেক না বলা গল্পের ঝুলি মনের মাঝে পোষন করে নীরবে বয়ে বয়ে ঠোটে আনন্দের হাসি হেসে অভিনয় করে বেড়ায়?
আচ্ছা, তাদেরও কি এক সময়ে কোন সুখের কবিতা ছিল? যা কিনা প্রতিটা দিন তারা নিয়ম করে পাঠ করত? আর কিছুই ভাবতে পারছে না রিহান, নিকোটিন চাচ্ছে তার মন, শুধুই নিকোটিন। যে সিগারেটের ফিল্টার গোলাপি ঠোটের নকশা কে কালো নকশার অবয়বে পরিনত করার নেশায় বার বার শুকিয়ে যাচ্ছে। আর মন নামক বোবা পাখির অসহনীয় তীব্র চিৎকারের মুখে কুলুপ এটে দেয়ার জন্য মস্তিস্ক এক মাতাল নেশায় মত্ত হয়ে বার বার আদেশ দেয়ায় ব্যস্ত সময় পার করছে।