আমার ছোট ভাইটা মারা গেছে ছয়মাস হলো। ওর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী খুব অসহায় হয়ে পড়লো। এমনিতেই মেয়েটার অল্প বয়স।মাধ্যমিক ডিঙিয়েই গরীব বাবা মা তাকে বিয়ে দিয়েছিল। আমার ভাই শুধু তাকে বিয়ে করেছিল ওর রুপ এবং উত্তম ব্যবহারের জন্যই। মানুষ বলে না যে রুপ এবং ভালো চরিত্র এই দুটো একটার শত্রু আরেকটা।মানে একসাথে এই দুই থাকে না। কিন্তু শেফার ক্ষেত্রে এটা একেবারেই ব্যাতিক্রম হলো।সে অত্যন্ত ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ।ব্যবহারও অতি উন্নত।শেফার একটা ছোট্ট মেয়ে আছে।এক বছর বয়স। ভাইয়ের মৃত্যুর পর সে বিপাকেই পড়ে গেল মেয়েকে নিয়ে। আমি একদিন বলেছিলাম,’শেফা বিয়ে করে ফেলো তুমি বোন। সামনে তোমার অনেক লম্বা জীবন। এই জীবনে একা থাকা খুব কষ্টের!’
শেফা কান্নাভেজা গলায় বলেছিল,’ভাইজান, আপনার আপন বোন যদি হতাম তবে কী তাড়িয়ে দিতে পারতেন আমায়?এই বাড়িটা ছেড়ে আমি কোথায় যাবো ভাইজান? এখানকার সব কিছুতে আমার নূরার বাবার ছায়া মিশে আছে। আমি বিয়ে করলে নূরার বাবাকে অবহেলা করা হবে। তাছাড়া নূরারও যত্ন-আদর তেমন হবে না। অন্য কেউ হয়তো নূরাকে সহ্য করতে পারবে না। আমি ভাইজান কী করে করবো এই কাজটা?নূরা যে আমার কলিজার টুকরা!’
সেদিন আমি শেফার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলাম,’তোমার ভাই বেঁচে থাকতে তোমার একটুও অবহেলা হবে না। তুমি আজীবন এ বাড়িতে থাকবে। আমার রক্তের মেয়েটা এ বাড়িতে থেকেই তার বাবার,কাকার ছায়া মাড়িয়ে বড় হবে, পড়াশোনা করবে,বড় ঘরে বিয়ে হবে ওর।’
শেফা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল সেদিন। আমিও তার দেখভালের সবটুকু দায়িত্ব নিয়েছিলাম নিজের কাঁধে। নিজের বোনের জন্য মানুষ যেভাবে বাজার থেকে এটা ওটা কিনে এনে দেয় ঠিক সেভাবেই আমি ওর জন্য বাজার থেকে এটা ওটা এনে দিতাম। আমার ছেলে ফাইয়াজের জন্য যদি নতুন কোন জামা কিংবা খেলনা কিনে আনতাম তবে নূরার জন্যও আনতাম।নূরার অসুখ হলে তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতাম।শেফার সাথে নিজের বোনদের মতো করে গল্প করতাম,সাহস দিতাম তাকে।শেফা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে দোয়া করতো আমার জন্য। আমায় বলতো,’নূরার বাপ না মারা গেলে আমি ভাইয়ের সোহাগ কাকে বলে তা কোনদিন জানতে পারতাম না।’
শেফার আনন্দ কিন্তু কদিন পরেই ভাটা পড়লো। দেবরের হঠাৎ মৃত্যুর পর আমার স্ত্রী আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল।তার ধারণা ছিল শেফা নতুন একটা বিয়ে করবে।আর নতুন বিয়ে করলেই তো সব সম্পদ আমাদের থেকে যাবে। এইসব আবার আমার কানেও বলেছিল রুমা। কিন্তু আমি এসবে পাত্তা দেইনি মোটেও। বরং ওকে বুঝিয়েছিলাম, ‘আমার ভাইয়ের সম্পদের হকদার আমার ভাতিজি। এখানে আমার হাত দেয়া মানে দোযখের আগুনে হাত দেয়া।’ রুমা আমার এমন উত্তরে খুব খ্যাপে গিয়েছিল। সেদিন রাত দুপুরে আমার সাথে রাগারাগী করে যা তা বলেছিল। একবার বললো,’ওর সুখ আমি দেখে নিবো।’ আমি হেসে বলেছিলাম’অন্যের জন্য গর্ত করলে নিজেকেই সেই গর্তে পড়তে হয়।’ আমার কথা শুনে রুমা রাগে আগুন হয়ে উঠেছিল। সাথে সাথে আমায় অকস্মাৎ গালি দিয়ে বলেছিল,’ভাইয়ের সুন্দর মাগী দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার। ছোট ভাইয়ের মাগী নিয়ে এখন খেলবার চাও না? আমি যদি এই মাগীর চুল না ছিড়ি তবে আমি বাপের পয়দা না!’
নিজ স্ত্রীর এমন অকত্য এবং অশ্লীল ভাষার গালাগাল আর হীন অভিযোগ শুনে আমার পিত্তিতে আগুন জ্বলে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে বসা থেকে উঠে ওর দু ‘গাল কষে দুটো শক্ত চড় বসিয়ে বলেছিলাম,’ছিঃ!তোর মতো ফালতু মেয়ের সাথে আমি সংসার করেছি এতোটা দিন, ভাবতেই আমার ঘেন্না হচ্ছে!’ আমাদের এসব কথাবার্তা গোপন থাকেনি।মধ্যরাতে শেফাও ও ঘর থেকে শুনেছে।শুনেছে আমার পাঁচ বছরের ছেলেটাও।সে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে চোখ মুখ কঁচলে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছে আমাদের।ওর মা তখন ওর একটা হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলেছিল,’দেখ বাজান দেখ তুই কেমন বাপের ঘর থেকে জন্ম নিছস!দেখ তোর বাপ একটা বেশ্যা মাগীর লাইগা আমার গায়ে আজ হাত উঠাইছে পর্যন্ত।এর শোধ তুই তুলিস বড় হইয়া।’
ছেলেটা আমার কিছুই না বোঝে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছে। কেঁদে উঠেছিল পরদিন সকাল বেলা শেফাও। সে এসে আমার পায়ে পড়ে কেঁদে কেটে বলতে লাগলো,’ভাইজান,আল্লার দোহাই লাগে, আপনি আর ছোট হইয়েন না, আপনার বোনেরেও ছোট কইরেন না।আপনারা থাকেন বাড়িতে। আমার জন্য আপনাদের সংসার ভাঙুক এটা আমি কিছুতেই চাই না।আজ সকালেই আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।’ আমি তখনও রাগে কাঁপছি। কাঁপতে কাঁপতেই বললাম,’এই বাড়ির অর্ধেক নূরার।নূরার বাড়িতে নূরার মা থাকবো। এইখানে অন্য কারোর কথা বলবার অধিকার নাই।তার পরেও যদি কেউ কথা বলতে আসে তাইলে তার জিভ আমি কেটে ফেলবো!’
পরিস্থিতি তার বিপরীত দেখে রুমা আর কিছু বলার সাহস করলো না। কিন্তু মনে মনে সেই রাগ সে পোষে রাখলো। বাড়িতে শেফার কোন একটা ত্রুটি হলেই তার খোঁটা দিয়ে কথা বলা শুরু হলো। আমার আড়ালে নাকি সে নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করাও শুরু করলো এবার।এসব কথা ভুলেও আমার কাছে বলতো না শেফা। আমি শুনতাম ফাইয়াজের কাছ থেকে। ফাইয়াজকে নিয়ে কখনো ঘুরতে বের হলে ও হঠাৎ করে বলে উঠতো,’বাবা,মা না কাকীমাকে পঁচা পঁচা কথা বলে। তারপর কাকীমা কাঁদে!’ শুনে আমার কী যে খারাপ লাগে! আমি রাতে গিয়ে শেফাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে এসব মিথ্যে। ফাইয়াজ বানিয়ে বলেছে। কিন্তু আমি জানি এসব মোটেও মিথ্যে নয়।শেফা অসাধারণ এবং চরিত্রবাণ মেয়ে বলেই সবকিছু গোপন করে রাখে।আর সে এও চায়না যেন এ বাড়িতে তার একমাত্র আপন মানুষটি অপমানিত হয়।এটাও চাইতো না যে কেউ শুনুক এ বাড়ির দুর্নাম।
আমি নিজেও এ নিয়ে আর বাগ বিতণ্ডা করতাম না। আমার মনে হতো রুমাকে শাসন করা সম্পূর্ণ অনর্থক একটি কাজ।শাসন পেয়ে সে আরো নষ্ট হবে। মনে মনে নতুন কুট কৌশল খুঁজে বের করবে শেফাকে ঘায়েল করার জন্য।ওর তো একটাই লক্ষ্য শেফা যেন এ বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যায়। তার লোভ আমার ভাইয়ের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে। কিন্তু আমিও আর বাড়াবাড়ি করতে চাই না এ নিয়ে। আমি চাই নূরা বড় হয়ে উঠুক আগে। তারপর ওর নামে সবকিছু লিখে দিতে পারলেই আমার স্বস্তি।
নূরা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগলো।বেড়ে উঠতে লাগলো ফাইয়াজও।আর বেড়ে উঠতে লাগলো রুমার অত্যাচারও।সে এবার নূরার নামেই কত কিছু অভিযোগ করে বসে।আজ বলে নূরা ঘর থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে গেছে।কাল বলে কানের দোলটা নাই। এভাবেই দিন যায়। কেঁদে কেটে শেফা আর নূরা মা বেটি দিনগুণে।এই দিন গুণা জানি খুব কষ্টের। জানি নিজের বাড়ির মানুষের দেয়া অত্যাচার সহ্য করা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন সংগ্রামের একটিও।রুমা কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়লো।
তখন অবশ্য নূরা বড়ো হয়ে গেছে।এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে। ঠিক তখন তার উপর একটা উৎকট অভিযোগ দিয়ে বসলো রুমা।বললো,ফাইয়াজের সাথে নূরার প্রেমের সম্পর্ক আছে। আমি জানি এটাও মিথ্যে অভিযোগ।রুমা এবার আর উপায় না পেয়ে নিজের ছেলের জন্য নূরাকে বিয়ে করিয়ে রেখে দিতে চাইছে।এতে লাভ সবটুকু সম্পদ ফাইয়াজের নামেই থাকবে। কিন্তু ফাইয়াজ এই অভিযোগ সহজ ভাবে নিতে পারলো না।সে তখন অনার্সে পড়ে। অনার্স পড়ুয়া ছেলেরা সব বুঝতে পারে।সে তার মাকে বললো,’তুমি অতটা নিচ মা? তোমার চরিত্র অতটা নিচে?
তোমার মতো মায়ের গর্ভে আমি ছিলাম ভাবতেই ঘৃণা লাগছে? তুমি পারতে আমার আপন বোনটার প্রতি আমার নাম দিয়ে এমন নোংরা একটি অভিযোগ করতে?’ রুমা তখন কেঁদে ফেললো।সে বুঝে গেছে তার সকল চেষ্টায় এখন বৃথা। কেঁদে কেটে রুমা ফাইয়াজকে বললো,’সব তো তোর জন্যই করলাম বাপ এখন তুই ই আমার নামে খারাপ খারাপ কথা বলতাছস!’ ফাইয়াজ বললো,’ছিঃ মা ছিঃ!নূরা আমার আপন বোনের চেয়েও বেশি। তাছাড়া তুমি আজীবন কাকীমার সাথেও খারাপ আচরণ করে এসেছো।এই একটুকু জমির লোভে তার নামে কত অপবাদ তুমি দিয়েছো তা আমি জানি।এমনকি আমার বাবাকেও তুমি ছাড়োনি অপবাদ থেকে! তুমি অতটা নীচ মা!” অসহায় রুমা একেবারে চুপসে গেল এবার। ছেলের কথার উপর কথা বলার মতো কোন যুক্তি সে খুঁজে পেলোনা আর।
নূরার বিয়ে হয়েছে। বিয়ে দিয়েছি আমি নিজেই ছেলে দেখে। ছেলে শিক্ষিত মার্জিত।সরকারি কলেজের প্রভাষক।নূরাকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ করে ফেলে তারা। তারপর মহা ধুমধাম করে বিয়ে। বিয়ের তিন চারদিন আগেই চুপচাপ নূরার নামে ওর বাবার সমস্ত সম্পত্তির কাগজ করে দেয় আমি। বিয়ে হয়ে গেলে নূরাকে নিয়ে ওর স্বামী ময়মনসিংহ শহরে চলে যায়। কদিন পর নূরা তার মাকেও নিয়ে যায় ওদের বাসায়।নিয়েছে নূরার স্বামীর কথায়ই।সে বলেছে,মা একা মানুষ তিনি বাড়িতে পড়ে থাকবেন কেন? মাকে আমাদের কাছেই নিয়ে আসো। আমিও আর না বললাম না। ভাবলাম সারা জীবন মেয়েটা কষ্ট আর কষ্টই করেছে। এবার একটু শান্তি করুক।
রুমার হঠাৎ করে এক বড় রোগ দেখা দিয়েছে।ক্যান্সার। এতো দিন সুপ্ত ছিল। এবার প্রকাশ পেল।ওর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা আমাদের নাই।রুমা এখন কাঁদে। কেঁদেকেটে বলে,’ফাইয়াজের বাবা, তুমি ঠিকই বলেছিলে,অন্যের জন্য গর্ত করলে সেই গর্তে নিজেরই পড়তে হয়।’ আমি শুনে মৃদু হাসি, কিন্তু মনে মনে কষ্টও পাই।শত অপরাধী হোক শেষমেশ ও নিজের ভুল বুঝতে পারলো তো! আমি এখন ওর চিকিৎসা নিয়ে ভাবি।ভাবি, এতো টাকা আমি কী করে পাবো?যে টাকা ওর চিকিৎসার জন্য লাগবে সেই টাকা জমি বাড়ি বিক্রি করেও আসবে না বোধহয়!আমরা যখন রুমার চিকিৎসা নিয়ে চিন্তার সাগরে ডুবছি- ভাসছি তখন আমাদের ত্রাতা হয়ে এলো নূরা আর তার মা।নূরা বললো,’আমরা এইসব সম্পদ দিয়ে কী করবো কাকা,তারচে বাড়ি সহ আমাদের সম্পদ টা বিক্রি করে বড়মার চিকিৎসা টা করিয়ে নাও।’ শেফাও বললো,’আর কোন কথা বলবেন না ভাইজান।এটাই শেষ কথা।’
আনন্দে আমার চোখে জল এসে গেল। রুমা সেদিন চিৎকার করে কাঁদলো।শেফার হাত ধরে মাফ চাইলো।নূরাকে টেনে বুকে নিয়ে বললো,’মারে,এই কপাল পুড়ি পাপীরে তুই মাফ দে!’ ওরা হেসে বললো,’আমরা মাফ করে দিয়েছি সাথে সাথেই।আমরা যদি কোন মানুষকে মাফ করতে কৃপণতা করি তবে আল্লাহও তো আমাদের মাফ করতে কৃপণতা করবেন।’ শুনে হাত তালি দিয়ে বলে উঠে ফাইয়াজ,’মা, আশরাফুল মাখলুকাত কাকে বলে দেইখা রাখো আজ।’