শিউলিদের বাসার নিচে দাড়িয়ে আছি। শিউলি দাড়িয়ে আছে ওদের বারান্দায়। মেসেঞ্জারে আমাদের কথা চলছে আর মাঝে মাঝে দুজন দুজনকে দেখছি। কোত্থেকে যেনো শাহীন ভাই চলে আসলো। আমাকে বললো, ‘কিরে এখানে কি করিস?’ আমি মিথ্যা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। বললাম, ‘না ভাই এমনি হাটতে হাটতে এসে এখানে একটু দাড়ালাম।’ শাহীন ভাই বললো, ‘বাইরে ঘুরাঘুরি করিস না। পরিস্থিতি কি তা তো জানোস, যা বাড়ি যা।’ আমি মাথা নিচু করে বাড়ির দিকে হাটা দিলাম। পিছু ফিরে একবার দেখলাম শাহীন ভাই শিউলির সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিলো শিউলি কি যেনো বলে ভেতরে চলে গেছে। আমি একবার মুচকি হাসলাম।
শাহীন ভাই এলাকার বড় ভাইদের মধ্যে একজন। অনেক ভালো প্লেয়ার। খেলাধুলায় মোটামুটি আমাদের এলাকায় উনি সেরা। এককালে আমি উনার সাগরেদ ছিলাম৷ উনার পিছে পড়ে থাকতাম। কিভাবে এত ভালো খেলে, কোন টেকনিক ইউজ করে এগুলা জিজ্ঞেস করতাম সারাক্ষণ। শাহীন ভাই ও গর্বের সহিত তার টেকনিকের কথা বলে যেতো। আমি শুনতাম বুঝতাম ঠিকই কিন্তু খেলতে গেলে সেই আবার গোল্ডেন ডাক মেরে ফিরে আসতাম। তবে আমিও অনেক ভালো বোলার ছিলাম। এখনো আছি। আমার সমবয়সী যারা আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বল আমি করতে পারি।
এইজন্য বড় ভাইদের প্লেয়ারের শর্ট পড়লে আমি খেলার সুযোগ পেতাম। ব্যাটিংয়েও মাঝে মাঝে ভালো করে ফেলি। তবে সবসময় পারি না। এভাবেই দিন কাটছিলো। শিউলির সাথে তখন আমার সাত মাসের প্রেম চলছিলো। নতুন নতুন প্রেম। প্রেমিকা ছাড়া তখন আর কিছুই বুঝিনা। হঠাৎ একদিন শুনলাম শাহীন ভাইও শিউলিকে পছন্দ করে। শাহীন ভাই অনেক ভালো মানুষ। সাত মাস আগে শুনলে হয়তো শাহীন ভাইয়ের জন্য শিউলিকে ভুলে যেতাম। কিন্তু এখন কিছুতেই সম্ভব না। শাহীন ভাইয়ের ছোটখাটো অনেক কাজই আমি করে দিতাম। যেহেতু তার অলিখিত সাগরেদ ছিলাম আমি। একদিন শাহীন ভাই আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলো। বললো এটা শিউলিকে দিতে। শুনে তো আমার মাথায় হাত। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কি?’ শাহীন ভাই বলল, ‘তোর এত কিছু জানতে হবেনা’। আমি মন খারাপ করে শিউলির কাছে গেলাম। শিউলি আমার মন খারাপ দেখে বললো,
– কি ব্যাপার কি হইছে?
– দেখ কি হইছে..
এই বলে আমি শিউলির হাতে চিঠিটা দিলাম। শিউলি আমার সামনেই খুলে পড়া শুরু করলো। তারপর আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– তোর মাথা ঠিক আছে? এসব কি? শাহীন ভাইকে বলিসনি তুই আমাকে ভালোবাসিস? আমি বললাম,
– বললে যদি উনি কষ্ট পায় এই জন্য বলিনি।
– তুই থাক তোর শাহীন ভাইয়ের কষ্ট নিয়ে। আমার কষ্ট তো তোর কাছে কিছুই না।
কথাটা বলেই শিউলি চলে গেলো। আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এরপর শাহীন ভাইকে অনেকবার, আমার আর শিউলির ব্যাপারটা বলবো বলবো বলেও বলা হয়নি। কেন জানি বলতে পারিনা কে জানে। তবে ইদানীং একটা জিনিস এনজয় করি। আমার সামনে শাহীন ভাই শিউলির সাথে কথা বলতে চায় শিউলি পাত্তা দেয় না। দেখে আমার হাসি পায়। ভালোও লাগে। শাহীন ভাইয়ের সামনেই আমাদের চোখে চোখে কথা হয়। শাহীন ভাই বুঝতে পারে না।
সকালে একটু একটু বৃষ্টি হয়েছিলো। এখন নেই। প্রকৃতি একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কোথাও কোনো হইচই নেই। আমাদের গ্রাম সহ আসেপাশের আরো ছয়টা গ্রাম লক ডাউন করা হয়েছে। এমন একটা সময়ে শাহীন ভাই আমাকে আর শিউলিকে একটা নির্জন জায়গায় ডেকে পাঠিয়েছে। জায়গাটা আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। চারপাশে ঝোপঝাড়। পাশে একটা পুকুর আছে। বাইরে বের হওয়া অনেক কঠিন। গ্রামের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে পুলিশের পাহারা আছে। তারউপর শিউলিকে রাজি করাতেও অনেক কষ্ট হয়েছে। আসতেই চাইছিলো না। অনেক বুঝাতে হয়েছে। শাহীন ভাই আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট তারার মত কি যেন একটা দেখিয়ে বলল, ‘তানভীর ওইটা দেখতে পাচ্ছিস?’ আমি হ্যাঁ বললাম। শাহীন ভাই বললো, ‘ওটাই আমার বাড়ি’। শাহীন ভাই আবেগে বকতেছে বলে এড়িয়ে গেলাম। বললাম,
– কি এত জরুরি কথা ভাই? এখানে ডাকলেন যে? শাহীন ভাই শিউলির দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
– তুই কি ভাবছিস আমি কিছুই বুঝিনা? প্রথম যেদিন তোরে চিঠি দিতে বলেছিলাম সেদিন তোর চোখ দেখেই বুঝে গেছিলাম ঝামেলা আছে। যখন তখন শিউলি দের বাসার সামনে দাড়িয়ে থাকিস। এগুলা আমার চোখ এড়ায় না।আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। বলার মত আসলে কিছু নাই। ঠিক তখনি দেখলাম শাহীন ভাই কেমন জাদু করে হাতের মধ্যে সবুজ বাতি ওয়ালা একটা যন্ত্র নিয়ে আসলো। আমি আর শিউলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। শাহীন ভাই বললো,
– এই পরিস্থিতিতে তোদের কারো বেঁচে থাকা সম্ভব হবে বলে মনে হয়না। আমি চেয়েছিলাম শিউলি যদি রাজি থাকে তবে শিউলিকে নিয়ে নিজ গ্রহে চলে যাবো। কিন্তু শিউলি অন্য কাউকে ভালোবাসে সেটা বুঝতে একটু দেরি হয়ে গেছে। শাহীন ভাই যন্ত্রটার একটা বোতাম চাপ দিতেই একটা গোল উড়োজাহাজের মতো এসে আমাদের মাথার উপর থামলো। সেখান থেকে ছোট্ট একটা সিড়ি বের হয়ে এসে মাটিতে পড়লো। শাহীন ভাই সবুজ বাতি ওয়ালা যন্ত্রটা আমার হাতে দিতে দিতে বললো,
– পৃথিবী নিয়ে চিন্তা করিস না। আমি সামলে নিবো। ওই ক্ষমতা আমার আছে। আমার ক্ষমতা ব্যবহার করার আগেই তোদের কিছু হয়ে যাক আমি চাই না। তুই শিউলিকে নিয়ে চলে যা। পৃথিবী সুস্থ হয়ে গেলে তোরা সংকেত পাবি। তখন না হয় আবার ফিরে আসিস। আমি আর শিউলি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছি। শাহীন ভাই সাধারণ কোনো মানুষ না আগে শুধু মনে করতাম। এখন সরাসরি দেখতেছি। শাহীন ভাই চলে যেতে লাগলো। শিউলি শাহীন ভাইকে ডাক দিলো। শাহীন ভাই পিছু ফিরে তাকালো। শিউলি একটু কাছে গিয়ে বললো,
– আপনার এই উপকার আমরা কোনোদিন ভুলতে পারবোনা। ভালো থাকবেন। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
শাহীন ভাই মুচকি হেসে আবার তার গন্তব্যে চলতে লাগলো। আমরাও সিড়ি বেয়ে উড়োজাহাজে উঠতে লাগলাম। এই মুহূর্তে শাহীন ভাইকে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। তবুও যেতে হবে। খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো শাহীন ভাই।