– তোর মাকে রাখবি নাকি আমাকে? তা এখনি ঠিক করতে হবে। আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে স্নেহার দিকে তাকিয়ে আছি। এ ভাষায় স্নেহা কথা বলতে পারে, এটা অন্য কেউ আমাকে বললে কখনোই বিশ্বাস করাতে পারত না। আমি কি ঠিক শুনেছি? তাকে চুপ করানোর চিন্তাটাও মাথা থেকে বিদায় নিয়েছে। আমার মা পাশের কক্ষে শুয়ে আছে। এটা মনে উদয় হতেই আমি স্নেহার দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতজোড় করে বলি,
– প্লিজ চুপ কর। আমার অনুনয় জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। স্নেহা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
– কেন চুপ করব? আমি অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। বলতে ইচ্ছে করছে, “হ্যাঁ, অনেক সহ্য করেছ তুমি।” কিন্তু আমি বরাবরই একটু অন্তর্মুখি। মনে যা আসে তা মুখ ফুটে বলতে পারি না। আর সেটা যদি হয় রূঢ় সত্যি, তাহলে তো কখনোই পারি না। এবারও ব্যর্থ হলাম তাকে কিছু বলতে।
– প্লিজ, মা শুনছে। তোমার দোহাই লাগে মা খুব কষ্ট পাবে। আমার কোনো কথাই স্নেহার ভালো লাগবে না। সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে,
– তোমার মা কষ্ট পেলে আমার কি? এমন চ্যাঁচাছোলা জবাবের পর তাকে বলার মতো কোন ভাষা আমার মুখ দিয়ে বের হবে না। আমি মাথা নীচু করে তার সামনে থেকে বের হয়ে যাবার জন্য পা বাড়াই। স্নেহা তেড়ে আসে,
– আমার কথা এখনো শেষ হয় নি, আমার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি বের হবে না।
তাকিয়ে আছি চকচকে মেঝের দিকে। মন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মায়ের কক্ষে। এখন স্নেহার কোন কথাই আমার কানে ঢুকবে না। আমার শ্রবণেন্দ্রিয় বধির হয়ে আছে। কানের মাঝে শো শো বেগে লু হাওয়া বইছে। তপ্ত বাতাস আমার কানের পর্দাকে ছিড়েখুঁড়ে একাকার করে দিচ্ছে। তবু তার শেষটুকু শোনার চেষ্টায় এবার মাথা উঁচু করে তার চোখে চোখ রাখি। আমার চোখের শীতলতা স্নেহাকে হতবাক করে দেয়। ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ায়। আঁধার সরিয়ে ভব্যতার আলোটা বেরিয়ে আসার চেষ্টা বিফল হয়। রাগ স্নেহাকে কাবু করে ফেলেছে। তার চূড়ান্ত দেখার জন্য স্নেহাকে উস্কে দেবার জন্য বরফ শীতল দৃষ্টি অক্ষুণ্ণ রেখে মুখ খুলি,
– বলো, তোমার শেষটা শুনে নিই। আমার ঢিলটা ঠিক জায়গাতে আঘাত হানে। হিংস্র নাগিনীর ন্যায় হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
– তোমার অশিক্ষিত মায়ের জন্য আমার সম্মান ধুলোয় লুটাচ্ছে। আমাদের দুজনের যে কোন একজনকে তোমার বেছে নিতে হবে। বলেই স্নেহা একরোখা ঔদ্ধত্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার চোখে। আমি মাথাটাকে ঠান্ডা রেখেছি। মাথা গরম করা যাবে না, বারবার মনে নিজেকে শাসন করছি। শেষবারের মতো তাকে জিজ্ঞেস করি,
– এটাই তোমার শেষ কথা? সে সমান তেজে জবাব দেয়,
– হ্যাঁ, এটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
খুব ধীরে সুস্থে আমি চোখের পলক ফেলি। কয়েক মুহূর্ত চোখ দুটো বন্ধ করে রাখি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি। বাইরে থেকে আমাকে খুব শান্ত দেখছে স্নেহা, কিন্তু আমার মনের ভেতর প্রচন্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ঝড় আমার ভেতরটা ভেঙেচুরে একাকার করে দিচ্ছে।
মনের ঝড়কে থামাতেই পায়ে পায়ে মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে যাই। স্নেহার বাবার গুলশানের বিশাল বাসায় আমরা পরগাছা হয়ে আছি। চাকরি হবার পরপরই স্নেহার চাপে বিয়েটা করে ফেলি। মা কখনোই অমত করবে না আমি জানতাম। সব শোনার পর মা আপত্তি করে নি। মায়ের রুমে ঢুকেই আমার হৃদয়টা হাহাকার করে উঠে। মায়ের দুচোখ বেয়ে অবিরাম ঝরছে নোনা জল। বরাবরই মায়ের রুমে প্রবেশের আগে আমি শব্দ করি, কিন্তু মন বিক্ষিপ্ত থাকায় কখন ঢুকে পড়েছি বুঝতে পারি নি। আমি নিজের অজান্তেই চিৎকার করে উঠি। শব্দ পেয়ে মা তড়িৎ চোখের জল মুছে নেয়। আমি দৌড়ে ছোট্ট শিশুর ন্যায় মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ি। মা আমাকে সেই ছোট্ট শিশুর মতোই আগলে রাখতে চায়। আমি হাউমাউ করে কাঁদছি। এমনি করে কখনোই কাঁদি নি কোন দিন। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখেন। আমি মায়ের কোলে মুখ গুঁজে হারিয়ে যাই ফেলে আসা সময়গুলোতে। নিজেকে তিরস্কারে তিরস্কারে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলি। জীবনটা নতুন করে শুরু করার রাস্তা খুঁজতে ইচ্ছে জাগে। কান্না করার শুরুতেই মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে,
– মা, কেন এমন হলো? গ্রাম থেকে এসে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলা বেশ কষ্টসাধ্য আমার জন্য। তার উপর দশ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় মায়ের শাসনটা পাই নি। মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবার ছিল আমাদের। তিন জনের সংসার। তিনজন থেকে হঠাৎ করে দুইজনের সংসার হয়ে উঠায় মায়ের উপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে যায়। বাবা ছিলেন পিতৃ-মাতৃহীন এতিম। মা গৃহশিক্ষক বাবার প্রেমে পড়ে একেবারে দিওয়ানা হয়ে যান। নানা দুজনের সম্পর্ক মেনে নিয়ে বিয়ে দিয়ে দেন।
এসএসসি পাশের পর মা আর কলেজে ভর্তি হন নি। বিধাতা মায়ের উপর নতুন বিপদ চাপিয়ে দেন। মা তার বাপ ভাইদের ইচ্ছের প্রতিকূলে আমাকে নিয়ে দিন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। ভার্সিটিতে ভর্তির পর মায়ের ইচ্ছের বাইরে একটি পা রাখি নি আমি। মায়ের স্বপ্ন আমার লক্ষ্য হয়ে উঠে অজান্তে। আমি নিজেকে গুটিয়ে নিই। পড়াশোনার মাঝে বিলীন করে দিই। তৃতীয় বর্ষে এসে মোটামুটি পড়ুয়া হিসেবে অর্থনীতি বিভাগে নাম ছড়িয়ে পড়ে আমার। গোবেচারা সেজে থাকলেও আমি বেশ সুদর্শন। ভালো ছাত্র হিসেবেই সহপাঠী স্নেহার চোখে ধরা পড়ি। এড়িয়ে চলতে গিয়েও জড়িয়ে পড়ি তার সাথে। ধনী পরিবারের অত্যন্ত ফ্যাশন সচেতন স্নেহার রূপের আগুনে পতঙ্গের মতোই ঝাপিয়ে পড়ি অজান্তে। তার ভালোবাসার আগ্রাসনে ভেসে যায় আমার সব বাঁধ। আমাকে আছড়ে ফেলে উত্তাল ভালোবাসার সমুদ্রে।
তার ভালোবাসায় এতোটাই বিভোর ছিলাম, তার চরিত্রের বিপরীত দিকটির সন্ধান পাই নি। অর্থ এবং প্রতিপত্তি দিয়েই মানুষকে বিচার করে তার পরিবার। যখন এ সত্যিটা জানতে পারি, ততদিনে আমি ঘোলা জলে বিলীন হয়ে আছি। নিজেকে পুনরুদ্ধারের কোন সুযোগ নেই। স্নেহার পূর্বে মা ভিন্ন কোনো মেয়ের সান্নিধ্যে আসি নি সেভাবে। অনার্স এবং মাস্টার্স শেষ করে রাজনীতির শিকার হয়ে ছিটকে পড়ি শিক্ষক হবার দৌড় থেকে। প্রথম বিসিএসেই আমার চাকরিটা হয়ে যায়। স্নেহার পরামর্শেই প্রথম পছন্দ দিই ইনকাম ট্যাক্স। ঢাকায় বড় হওয়া মানুষ স্নেহা। তার পক্ষে গ্রাম গঞ্জে থাকা সম্ভব নয়, তাই প্রশাসন ক্যাডার পছন্দ তালিকায় ছিল না। বিয়ের পরপর স্নেহা আমাকে অনেকটা বাধ্য করে তাদের বাড়িতে উঠে আসতে। মা আমার মুখ চেয়ে মেনে নিয়েছে। তিনি গ্রামে থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি মাকে গ্রামে একা থাকতে দেব না বুঝতে পেরেই তিনি এখানে এসে উঠেছেন। আমার কান্নার বেগ কমে আসতেই মা বলে উঠেন,
– বাবা তুই আমাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে আয়। মায়ের কথা শুনে আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হই। মাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমি তাকে তৈরি হবার জন্য বলি। তখনো আমাদের নাস্তা করা হয় নি।
মা কিছুতেই নাস্তা করবেন না, কিন্তু আমি শ্বশুর শাশুড়ির কাছে মাকে ছোট হতে দেব না। মাকে নিয়ে নাস্তার টেবিলে বসি। স্নেহা মাকে নাস্তা এগিয়ে দেয়। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। স্বার্থপরতার কতটা নীচে নামলে মানুষ এমনটা হতে পারে! আমি চাকরি জীবনে সততাকে অবলম্বন করাকেই স্নেহা মেনে নিতে পারে নি। তার ধারণা, মা আমাকে শপথ করিয়েছেন। তাই তার সব ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে মায়ের উপর। আমি শ্বশুরের বাড়ি ছেড়ে বাসা খুঁজছি, এটা স্নেহার রাগের আরো একটি কারণ। গ্রামের বাড়িতে পৌঁছেই উকিলের সাথে কথা বলি। স্নেহার কাছে উকিল নোটিশ পাঠিয়ে পরের মাসেই মাকে নিয়ে ছোট্ট একটি বাড়া বাসায় উঠে আসি। স্নেহা কখনোই আমার মায়ের বিকল্প হতে পারে না। যে মা তার সাধ আহ্লাদকে জলাঞ্জলি দিয়েছে আমার মুখ চেয়ে, তার চেয়ে উপরের আসনে কখনোই কিছু বসতে পারে না।