আপু একটা কথা বলতে পারি?(অনিক)
__হুম, বলো।(মায়া)
__আসলে কথাটা কিভাবে শুরু করবো সেটাই বুঝতে পারছি না।
__সমস্যা নেই বলতে পারো।
__আসলে আমার বন্ধু নাহিদকে তো চিনেন?
__হুম। ওই ফাজিল ছেলেটা!
__কোনটা?
__যে ছেলেটা আমার দিকে ড্যাব ড্যাপ করে তাকিয়ে থাকে? আমি আসার সময় গেটে দাড়িয়ে এক নজর দেখার চেষ্টা করে?
__হুম আপু।
__তোমরা কি পাগল নাকি?
__কেন আপু?
__তোমরা ফার্ষ্ট ইয়ারে আর আমি থার্ড ইয়ারে।তাছাড়া ওর থেকে কয়েক বছরের বড় আমি।
__আমাদের রাসূল (সাঃ) ২৫ বছর বয়সে ৪০ বছরের খাদিজা (রাঃ) কে বিবাহ করেছিলেন।
__তোমাদের এ নাটক বন্ধ করো। এটা শুধু মোহ। মোহ কেটে গেলে সবই ঠিক হয়ে যাবে। এখন যাও। আমাকে শান্তিতে থাকতে দাও।
__আপু নাহিদ আসলেই আপনাকে অনেক ভালোবাসে। অনেক বেশিই ভালোবাসে।
এ কথা বলে সেখান থেকে চলে গেল অনিক। মায়া যে ভার্সিটিতে লেখাপড়া করে, নাহিদ ওই ভার্সিটিতে নতুন ভর্তি হয়েছে। ভর্তি হওয়াতে ওর অনেক বন্ধু-বান্ধব হয়ে যায়। যার মধ্যে অনিক অন্যতম। নাহিদরা ক্লাসের ফাঁকে অধিকাংশ সময় একটা বট গাছের নিচে বসে সময় কাটায়, আড্ডা দেয়। ভার্সিটিতে আসার মাস দুয়েকের মধ্যে মায়াকে ভালো লাগে নাহিদের। যে কোন পার্শ্ব দিয়ে কোন অংশে কম ছিলো না মায়া। হয়তো তাই।
তাইতো রোজ রোজ মায়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো সে। প্রায় প্রায় মায়ার মেসের সামনেও ঘোরাঘুরিও করতো। মায়া সব বুঝতো কিন্তু সে চায় না এটা একটা সম্পর্ক হোক। তাই তো সে নাহিদকে এড়িয়ে চলতো।নাহিদকে যেখানে দেখতো মায়া সেখান থেকে পশ্চাৎগমন করতো। এভাবে কেটে যায় আরো কয়েকদিন। মায়া এখন নাহিদকে তার আশে পাশে দেখে না। যখন বন্ধুরা বটগাছের নিচে আড্ডা দিতো তখন কিংবা তার বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করতে। আস্তে আস্তে মায়া নাহিদকে এভাবে মিস করতে থাকে। কাউকেই এই কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না। একদিন অনিককে একলা বসে থাকতে দেখে মায়া এগিয়ে যায় তার কাছে।
__কি খবর অনিক, কেমন আছো?
__জ্বী আপু আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি?
__আলহামদুলিল্লাহ। ইদানিং তোমার পাগল বন্ধুটাকে কেন জানি দেখি না। কোথায় সে?
__কার কথা বলছেন?
__নাহিদের কথা।
__ওহ। আসলে, ও…….
__কি ও ও করছো। কি হয়েছে বলবে তো। তোমার মুখ এতো শুকিয়ে যাচ্ছে কেন?
__আসলে নাহিদ হাসপাতলে।
__হাসপাতলে?
__হুম।
ছেলেটা জীবনে অনেক সংগ্রাম করে আজ এই অবধি উত্তীর্ণ হয়েছে। সেই ছোটবেলা বাবা-মাকে হারিয়েছে। এর পর থেকে নানা-নানীর কাছেই মানু্ষ হয়েছে। যখন নাহিদ ক্লাস নাইনে পড়তো তখন তার বৃদ্ধ নানাও মারা যান। নাহিদের মামারা নাহিদের লেখাপড়ার খরছ দিতো না। তাই তো একটা দোকানে থেকে কিছু উপার্জন করেছে আর লেখাপড়ার খরছ চালিয়েছে। যখন ইন্টার ফাইনাল ইয়ারে তখন দোকান ছেড়ে দিয়ে টিউশনি করাতো। আজ পর্যন্ত তাতেই আছে। জানেন, অনেক ভালোবেসে ছিলো আপনাকে। তাই তো সবসময় আপনার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতো। কিন্তু আপনি তো ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। তাই তো এখন সে আপনাকে ডিষ্টার্ব করে না। আপনাকে ও শান্তি দিয়েছে।তাই তো আপনি চেয়েছিলেন।
__তুমি ওর এতো কথা জানলে কেমন কর?
__আমি একদিন ওর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তাতে ওর মামাতো ভাইয়ের কাছে শুনেছি।
__তা ও হাসপাতালে কি করছে?
__ব্রেন টিউমার ওর মাথার ভিতরের সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলেছে।
ডাক্তার বলেছেন, ও নাকি আর একমাস এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে। নাহিদহীন আমাদের আড্ডা জমে না। তাই তো আগের মত আর বসি না। ভার্সিটি থেকে যাওয়ার পর হাসপাতলে যাই প্রতিদিন। ওকে ছাড়া আমার এক মূহুর্তও ভালো লাগে না। ডাক্তার বলেছেন, যদি এক মাসের বেশি সে বেঁচে থাকে তাহলে তা প্রতিপালকের একমাত্র কৃপায়। (অনেকটা কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বললো অনিক)
__(মেঘের আড়ালে ঢেকে গেছে মায়ার মুখের সেই হাসি। সারা মুখে বেদনার ছাপ) কোন হাসপাতলে আছে ও।
__সিটি হাসপাতলে।
ঘরে প্রবেশ করেই মায়া কাঁদছে, মন ভরে কাঁদছে এরকম একটা হাসি খুশি ছেলে চলে যাবে সবাইকে ছেড়ে। ভাবতেই মনটা আতকে উঠে মায়ার। কোন কাজেই যেন তার মন বসছে না তার। এমনকি লেখাপড়াও না। সবসময়ই ভাবছে নাহিদের কথা। তার দিকে তাকিয়ে থাকা সেই মুখচ্ছবির।কিন্তু এখন তো সবি শেষ! কি করার আছে তার? সেটা হয়তো তার অজানা।
নাহিদের পাশে বসে আছে মায়া। কিন্তু নাহিদের মুখে তখন অক্সিজেন লাগানো। হয়তো বুঝতেই পারে নি, এতদিন সে যার জন্য পাগল ছিলো আজকে সে তার পাশেই বসে আছে। নাহিদের নানী বেডের অপর প্রান্তে প্রান প্রিয় নাতির জন্য সবসময়ই আল্লাহর কাছে দোয়া করে যাচ্ছেন। মায়ার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। কয়েক ফোঁটা নাহিদের হাতকে স্পর্শ করলো। নাহিদ তার চোখ দুটো খুলে এক নজর দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না, মায়া তার কাছে এসে বসে চোখের জল ফেলছে। কিছুক্ষনের মধ্যে নাহিদের মুখটা আনন্দে ভরে উঠলো।
মুখ থেকে অক্সিজেনটা সরিয়ে মায়ার মুখের দিকে অসহায়ের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষনের মধ্যে মুখ থেকে একটা শব্দ উচ্চারিত হলো আলহামদুলিল্লাহ।আস্তে আস্তে নাহিদের চোখটা ঘুমের দেশে চলে যায়। নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার সারা দেহ। চোখ থেকে দু ফোঁটা পানি টপ করে পড়ে যায় বালিশের উপর। অতঃপর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে নাহিদ। হয়তো সে ঘুম থেকে কেউ তাকে কোন দিন জাগিয়ে তুলতে পারবে না। এমনকি মায়াও না।