পালাবদল

পালাবদল

— ভাবী, তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও। এই দুঃসময়ে তোমার জন্যই বাড়িতে ভাইরাস ঢুকতে পারে। বাবা মা আছে, বাচ্চারা আছে।

আমার ননদ শারমিন ফোন করে কথাগুলো একটানা বলে গেল। ওদের সবার নিরাপত্তার জন্য আমার চাকরি ছাড়াই নাকি একমাত্র সমাধান।

— চাকরি ছেড়ে দিতে হবে ?

প্রশ্নটা নিজের কানেই অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। কেউ কোনোদিন শুনেছে ডাক্তার কাজ ছেড়ে দিয়ে বসে আছে ! এতোদিনের পরিশ্রম, বাচ্চা- সংসার সামলে ক্লিনিক, হাসপাতাল …এসব কিছু ছেড়ে দিতে হবে ?

—হ্যাঁ, ছেড়ে দেবে। এদেশে ডাক্তারদের কোন প্রটেকশন নেই। তোমার কিছু হলে বাসাসুদ্ধ সবাই ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। সবচাইতে ভালো সমাধান চাকরি ছেড়ে দেয়া। ভাইয়া নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না। আর ভাইয়া যে চাকরি করে তাতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না।

শারমিনের সাথে বেশী কথা বলে লাভ নেই। বেশ আটঘাট বেঁধেই নেমেছে বুঝতে পারছি। আমাকে ক্লিনিকে ফোন করে বলার মানে বাবলু এবং বাবা মায়ের সাথে পরামর্শ করা হয়ে গেছে। চৌদ্দ বছর ধরে দেখছি তো ! বাড়িতে সবার ছোটো হলেও তার কথা অমান্য করার সাহস কারও নেই।

মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। চাকরি ছেড়ে দেয়ার ভয়ে নয়। বাড়ি ফিরে যে পরিবেশ দেখব তাতেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। শ্বশুর শাশুড়ী এই করোনা দুর্যোগের মাঝে গ্রাম থেকে এসেছেন। বাবলুই ওঁদেরকে আনার ব্যবস্থা করেছে। ওঁরা আসার আগে আমি মিনমিন করে বলেছিলাম,

— এইসময়ে ওঁরা আসবেন ? করোনা শুরু হয়েছে। বাবা মায়ের ডায়াবেটিক, প্রেসার আছে। বাবার তো এজমা আছে। এজমার রোগীদের জন্য খুবই খারাপ। ঢাকাতেই বেশী ছড়াবে। গ্রামের দিকে হয়তো কম হবে।

—তুমি কোত্থেকে জানো গ্রামের দিকে কম হবে ? বেশী বোঝ, না?

—আহা, বাড়িতে তেমন কেউ যায় না। যে কাজের লোকেরা আছে তাদের নিয়ে ওঁরা ওখানেই ভালো থাকবেন। আমাকে ভুল বুঝো না প্লিজ ! তুমি খুব ভালো করেই জানো আমার কোনো আপত্তি নেই ওঁরা থাকলে। আমার তো কাজে যেতেই হবে। করোনা পেশেন্ট এলে আমারও হতে পারে। আমার থেকে তোমাদের সবার।

— বলে দিয়েছি। ওঁরা আসবেন। শারমিনও আছে। এখানে সমস্যা হলে শারমিনের ওখানে থাকবেন। যা হয় হোক সবাই কাছাকাছি থাকতে চাই।

কাছাকাছি থাকা অবশ্যই ভালো। ওঁদের বয়স হয়েছে… ওঁরা কিছুতেই ঢাকার পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারেন না। ডাক্তার দেখানো ছাড়া আসতেও চান না। আমরাই যাই ছুটি ছাটায়।

কিছু হলে শারমিনের বাসায় তাঁদের পাঠিয়ে দেয়াটা কথার কথা। শারমিন ফোঁপর দালালী করতে যতটা পটু, দায়িত্ব নিতে ততোটা নয়। তখন ভেবেছিলাম আসুক। পরে দেখা যাবে। সাবধানে থাকতে হবে। বিপদ তো সব জায়গাতেই হতে পারে। সাবধানতা অবলম্বন করলে ইনশাল্লাহ কিছু হবে না। কিন্তু এখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ননদিনীর অমোঘ রায় শুনে ভয়ই পাচ্ছি আজ বাসায় যেতে। এমনই কপাল আমার ভেবেছিলাম বিয়ের পর ইংল্যান্ড গেছে শারমিন… এইবার বুঝি হাঁফ ছেড়ে বাঁচব। কিসের কী ! দু’বছর পেরুতেই নন্দাইয়ের কোর্স শেষ হয়ে গেল। আর পুরো পরিবার ব্যাগ লাগেজসহ দেশে প্রত্যাবর্তন করলো।

পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্ম হয় অন্য সবাইকে জ্বালানোর জন্য। আর কিছু মানুষ জন্মায় শুধু গঞ্জনা সহ্য করবার জন্য। এক কথায় চার কথা শোনাতে যে পারে না তার জন্য পৃথিবী এক ভয়ংকর জায়গা। পায়ে ঠ্যালা, পেটে লাথি খেয়েই এরা মরার আগেই মরে যায়।

দুরুদুরু বুকে বাসায় ফিরেই ঢুকে যাই অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট বাথরুমে। গোসল করে সব কাপড় ধুয়ে নেড়ে প্রার্থণায় দাঁড়াই। এর মাঝে বাবলু এসে আমাকে দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে গেল। সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া চাই নিজের জন্য। একজন স্বাবলম্বী ডাক্তার নারী হয়ে এইরকম ভয়ে ভয়ে জীবন কাটাই আমি, তাহলে এদেশের ঘরে ঘরে কী অবস্থা !

আমারই এক আত্মীয় ভাবী আছে যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই কিন্তু ঘরের লোককে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। শ্বশুর শাশুড়িকে মিষ্টি কথায় ভিজিয়ে সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। অথচ, কথা বললে কেউ বুঝবে না এই মেয়ের এত বুদ্ধি। জয় করে নিতে পেরেছে সবাইকে অথবা তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই বলেই সম্পত্তি নিজের দখলে রাখার চেষ্টা। শিক্ষিত মেয়ে হয়েও যে চক্ষুলজ্জা আমাকে অবদমিত থাকতে বাধ্য করে ভাবীকে সেই শিক্ষার অভাবই হয়তো সাহস জোগায়।

আজকাল কোন কাজের মানুষ নেই। রাতের খাবার আমিই রান্না করি কাজ থেকে ফিরে। শাশুড়ি দুপুরেরটা করে নেন। আজ নরম খিচুড়ি, ডিম ভুনা আর আলু ভাজি করলাম। শ্বশুর আর বাবলুর ডিম ভুনা ভারী প্রিয়।

আমাকে রান্নাঘরে দেখলেই বাবলুর মেজাজ খারাপ হয়। এমন না যে কেউ রান্না করে রেখেছে তা দিয়ে রাতের খাবার হবে ! শাশুড়ি প্রতিদিন দুপুরে অতটুকু রান্না করেন যতটা তাঁদের দরকার। রাতের জন্য প্রায় কিছুই থাকে না। রাতের রান্নার সঙ্গে আমি বাচ্চাদের সারাদিন খাওয়ার জন্য বিভিন্ন নাশতাও বানাই। কেক, পুডিং, নুডলস এসব।

—রাতের বেলা রান্না আমার পছন্দ না, তুমি জানো !
—রান্না না হলে খাবে কী ?
—কেন ? মা যে দুপুরে রান্না করলো?

ফ্রিজ খুলে দেখালাম দুই টুকরা মাছ পড়ে আছে। অল্প একটু বাধাকপি ভাজি আর ডাল। ছয়জন মানুষের তা কিছুতেই হবার নয়।

—দুই টুকরা মাছে তো আমার আর বাবার হয়ে যেতো। তোমরা কয়টা ডিম ভাজি করে নিলেই পারতে। এইসব কথায় আগে জবাব দিতাম।
–কেমন মানুষ তুমি ? নিজের কথা ভাবলে কই আমি কি খাবো একবারও তো ভাবলে না ?

—কেন? তোমাকে ডিম খেতে বলছি। ডিম কি খারাপ খাবার ?

এখন আর কিছু বলতেও ইচ্ছা করে না। যা খুশী বলুক। কান বন্ধ করে থাকি । বোবার কোন শত্রু নাই। কথায় কথা বাড়ে। মেজাজ খারাপ হয়। ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। ওরা শোনে হাঁ করে। বিচ্ছিরি লাগে এইসব সামান্য ব্যাপারে ঝগড়া করতে। খিচুড়ি দিতেই সবাই হুড়মুড় করে খেতে চলে এলো। বাবলুই সবচে’ বেশী খেয়েছে। আমার জন্য প্রায় থাকতই না। সবাই একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসার শিষ্টাচার আমি ঠেকে চালু করেছি। নয়তো প্রতিদিন আধপেটা খেয়ে থাকতে হবে।

শাশুড়ি মুখে যাই বলুন না কেন, উনি পছন্দ করেন না ছেলের বউ সবার সাথে বসুক। তাঁরা খেয়ে উঠে গেলে আমি উচ্ছিষ্ট খাবো আর তাই খেয়ে পরের দিন সারাদিন ক্লিনিক টহল দেবার মতন বোকামী থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছি। আজকের সবগুলো আইটেম সবারই পছন্দের আমি জানি। কিন্তু শাশুড়ি আজ ডিম না নিয়ে শুধু আচার নিলেন খিচুড়ির সাথে। বাবলু আমার দিকে বারবার গরম চোখে তাকাচ্ছিল… মাকে কেন আমি বলছি না ডিম নিতে। একবার বলেছি। উনি নিতে রাজী হননি। বাবলুর গরম চোখ তো উপেক্ষা করলাম। এখনো বৈঠক বসছে না কেন তা নিয়ে শংক হচ্ছে। বেশী দেরি করতে হলো না। শাশুড়ি খেয়ে উঠেই মেয়েকে ফোন করলেন। শারমিন ওর বর পল্লবসহ নেমে এলো নয়তলা থেকে।

এঁরা করোনার মাঝেও এবাড়ি ওবাড়ি যাচ্ছে। শারমিনের বাড়ি যায় চা খেতে, ওরা এবাড়ি আসে যখন তখন। ইচ্ছে করে পুলিশে ধরিয়ে দেই। সভ্য দেশ হলে জেল, জরিমানা হয়তো হতো। চীনে বা ভারতে যেমন পিটিয়ে ঠান্ডা করছে তা তো আর এমনিতে না ! শিক্ষিত মানুষজন আচরণ করছে মূর্খের মতো। যেখানে বলা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সেখানে এরা আয়েশ করে। একদিন বাবলুকে বলেছিলাম এনিয়ে। আমাকে এক লেকচার শুনিয়ে দিলো।

–তুমি কি বেশী বোঝ ? ডাক্তারী পাশ করেছো বলে হাসপাতালের নিয়ম ঘরে চালাবে ? মনে রেখো, ঘরে আসার পর তুমি মুনশী বাড়ির বউ। আমরা আর শারমিনরা এক পরিবার। উপরে নিচে থাকি কারণ ফ্ল্যাটগুলো ছোটো। আমার বোন কি বাইরের লোক ? তোমার বাবা ছিল না। মায়ের কাছে নানীবাড়িতে কষ্টে বড় হয়েছ তো ! পরিবারের মূল্যবোধ তোমার মাথায় ঢুকবে না।

এসব কথার প্রতিবাদ করার মানে হলো ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া। বাবলুর সাথে মনের মিল আমার হয়নি কেন যেন শুরু থেকেই। ওর বন্ধুরা ডাক্তার বউ বলে যত উচ্ছ্বসিত ছিল, সে ততটাই বিরক্ত ছিল আমাকে নিয়ে। হয়তো ওর পৌরুষে লাগে !

আমি প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করি না। শুধু হাসপাতালের চাকরিতে আর কতো বেতন ! আমার মাসিক আয় বাবলুর চেয়ে অনেক কম। সে একটি বিদেশী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে বিশাল বেতনের চাকরি করে। ডাক্তার হলেও আমার মর্যাদা একেবারেই নেই এবাড়িতে। অনেকেই, ভাবে আমি শখের চাকরি করি। অথচ এটা আমার পেশা। বসার ঘরে পুরো পরিবার কলরবে মেতে উঠেছে। এরা সবাই বাসায় বসে কাজ করে বা ছুটি কাটাচ্ছে। আমিই একমাত্র মানুষ প্রতিদিন কাজে যাই। হাতের কাজ সেরে কফির পানি চড়িয়ে দিয়েছি। কিছুক্ষণ চুপচাপ শুনলাম ওদের কথোপকথন পর্দার আড়াল থেকে। শারমিন আর বাবলু হাসছে।

–ভাইয়া, কাল আমাদের ফ্লোরের সুমনা ভাবীর বাসায় কাল দাওয়াত ছিল। ভাবী তো একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছে। যা মজার হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি করেছিল। শাশুড়ি মা বলছেন, তাই নাকি ? এত কাজ করলো কি করে? কারো বাসায় তো কাজের মানুষ নেই।

—ভাই তো খুবই সাহায্য করে কাজে। মশলা পেষা, ঘর ঝাড়ু দেয়া-মোছা নাকি আকরাম ভাইই করেন।

—বাহ। খুবই ভালো। সুমনা মেয়েটা ভারী লক্ষী। আমরা আসার পর কয়েকবার খাবার পাঠালো। আমি খালি বাটিগুলি ফেরত পাঠাতে পারছি না। আমাদের ঘরে তো সৌখিন খাবার কিছু রান্নাই হয় না। শুধু প্রতিদিনের ডাল ভাত কী আর দেয়া যায় ? এইসময়ে আমি প্রবেশ করতেই সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। বাবলু বুঝি আমাকে দেখামাত্রই চন্ডাল রাগে ফেটে পড়লো।

—শিখা, তুমি কেন সুমনা ভাবীর বাটি ফেরত পাঠাচ্ছ না ? সংসারের দিকে খেয়ালই নাই তোমার ! ওরা না জানি কী ভাবছে!

—শুক্রবারে পিজ্জা বানিয়ে ফেরত দেবো, বলেছি ভাবীকে। আকরাম ভাই পিজ্জা খেতে চেয়েছেন। বাবলু ঠান্ডা হলেও সাথে সাথেই পল্লব সুর ধরলো।

—কি ভাবীসাহেবা, আপনি আজকাল আকরাম ভাইয়ের জন্য পিজ্জা বানান। নিজের নন্দাইকে পাত্তাই দেন না।
চোখ মটকে বললো পল্লব। এইসব ঠেস মারা কথা আর বাজে ইয়ার্কি শুনলেই আমার গা গুলিয়ে ওঠে। কিন্তু কি করবো, সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। গায়ে মাখি না। পালটা বলি,

–কফি বসিয়েছি। খাবে তো সবাই ?

কেউ কোনো উত্তর দিলো না দেখে আমি বেরিয়ে গেলাম। কফির সঙ্গে বরফির প্লেট ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে হাজির হলাম।

—ভাবী, তুমি নিচ্ছ না কফি ? শারমিন বলে।

—নাহ, আজকাল রাতে চা কফি খেলে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে।

—ভাবী চাকরি ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে কথা বলেছো তো ভাইয়ার সাথে ?

আমি থমকে তাকালাম। বাবলু আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। পল্লবের মুখে মিটিমিটি হাসি। শ্বশুর শাশুড়ি এমন ভাব করছেন যেন তারা ঘরে নেই। ছেলেমেয়েরা নিজেদের ঘরে আছে। যাক, নিশ্চিন্ত। কিছু শুনতে পাবে না।

—শারমিন কিন্তু একটা খুব দরকারী কথা বলেছে। শ্বশুর বললেন।

—তাই না বাবা ? আমি ভেবে দেখলাম চারদিকে যা অবস্থা ডাক্তাররাই সবচে’ খারাপ অবস্থায় আছে। নাই তেমন কোন সরকারী সাহায্য…যার যার তার তার। এই অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার মানে হল ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার।

—আসলেই তাই। কতো ডাক্তার মারা গেছে ইতালীতে। ইস ! শাশুড়ি মায়ের মন্তব্য।

এখনো অপেক্ষা করছি বাবলুর মুখ থেকে কিছু শুনবার। কিন্তু সে চুপ করে আমার পানে চেয়ে আছে। অর্থাৎ আমার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। আমার উত্তর শুনে সে পরবর্তী ঝড়ের প্রস্তুতি নেবে। ঘরের বাকী পাঁচজনকে একবার দেখলাম। এঁরা সবাই এক দল। আমার পক্ষে কেউ নেই। কি বলব, আমি ? যাই বলি না কেন এঁরা ঝাঁপিয়ে পড়বে আমাকে ভুল প্রমাণিত করতে। এমন কিছু বলতে হবে যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে। কিন্তু আমি অত চৌকস নই বাকপটুতায়।

—–শারমিন, খুব ভালো একটা কথা বলেছো যুদ্ধক্ষত্রের কথা উল্লেখ করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ লড়াই করেছিল সশস্ত্র বাহিনীর সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে। এবং সেইজন্যই আজ স্বাধীন দেশে বসে আমরা কথা বলতে পারছি।

—কিসের মধ্যে কি বললেন ভাবীসাহেবা ? হো হো করে হেসে উঠলো পল্লব।

—আমার কথা শেষ হয়নি পল্লব ! শান্তভাবে বললাম।

—এতো কথা না বলে আসল কথা বলো। চাকরি ছাড়বে কি না ? বাবলুর এই “ ধর তক্তা মারো পেরেক” মনোভাবের জন্য কথা শেষ পর্যন্ত শোনার ধৈর্য থাকে না।

—শারমিন, আমি ডাক্তার হয়েছি নিজের ইচ্ছায়। পরিবারের ইচ্ছেয় নয়। ডাক্তার হয়েছি মানুষের সেবা করার ব্রত নিয়ে। কারো পছন্দ অপছন্দের জন্য না।

—এইসময় আবার পছন্দ অপছন্দ কিসের ? তোমার জন্য যদি বাড়িতে কারো করোনা হয় ? সেটা তুমি দেখবে না ? বাবা মা বাঁচবে যদি অসুস্থ হয় ? তুমি খুব স্বার্থপর, ভাবী !

—বল, বল ! আমি তো আকারে ইঙ্গিতে কতোবারই বললাম। আমার কথা তো পাত্তাই দেয় না। বাবলু বোনকে সমর্থন করার জন্য গলা মেলালো। আবারও উপেক্ষা করলাম বাবলুকে।

— আমার যেহেতু কাজে যেতে হয় হাসপাতালে সেজন্য বলছো তো ? তোমরা যে ফ্ল্যাটবাড়ির মধ্যে এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছ সেভাবেও কিন্তু সংক্রমণ হতে পারে। আর বেশী ভয় পেলে বাবা মাকে তোমার বাসায় নিয়ে রাখো কিছুদিন। তোমরা তো দুজনেই ঘরে। আমার কথায় ঘরে যেন বোমা পড়লো। বাবলু লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শাশুড়ি আর ননদ ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকালেন। পল্লব নাকের পাটা ফুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে থাকল।

—শারমিনের বাসায় কেন যাবে বাবা মা ? আমি জীবিত থাকতে ?

— তাঁদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেই বলছি। শুধু এই সময়টার জন্য, এটাই সবচেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা।

—ছোটমুখে বড়কথা বলবে না। যা বুঝো না তা নিয়ে ইডিয়টের মতো একটা কিছু বললেই হয় না।

—জানি আমি ছোটলোক, ছোটজাত। চৌদ্দ বছরে বহুবার শুনেছি। আমার কোন মাথাব্যথা নেই শারমিন কি করবে বাবা মাকে নিয়ে ! এই সংসারে আমি কি করবো না করবো তা নিয়ে কথা বলতে এলে আমাকে সত্যটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতেই হবে ! পল্লবের বাবা মাকে কেন ওঁরা পল্লবের বোনের বাসাতেই ফেলে রাখে তাও জানতে চাই না ! নিয়ম শুধু এবাড়িতেই পালন করতে হয়, এবাড়ির বাইরে কোনো নিয়মই নিয়ম নয় ! আমি কখনই এসব নিয়ে বলতে চাইনি। আজকে বলতে বাধ্য হলাম। তোমরা যতো কথাই বলো চাকরি আমি কখনো ছাড়বো না।

—বেশী বাড় বেড়েছে তোমার, শিখা ! এতো আস্পর্ধা কোত্থেকে আসে ? কয় টাকা বেতন পাও যে এতো দেমাক দেখাচ্ছ ? বাবলু একেবারে যথার্থ পুরুষের ভূমিকায় আজকে। এইরকম স্বামীর সাথে বেশীদিন থাকতে পারব না বুঝে গিয়েছি বহু আগেই। ছেলেমেয়েরা আরেকটু বড় হলেই পৃথক হবার চিন্তা আছে আমার।

—যত কম টাকাই পাই না কেন চাকরি আমি ছাড়ছি না। বাবা মাকে নিয়ে তোমরা সবাই ভয় পাচ্ছ…সবাই মিলে শারমিনের বাসায় চলে যাও না কেন? আমাকে একা থাকতে দাও। আমরা যারা কাজ করছি তাদের সেল্ফ আইসোলেশনে যাওয়া উচিত পরিবারের সুরক্ষার জন্যই। আস্পর্ধা, সাহস এসব আমি তোমাদের কাছ থেকে শিখেছি। সেই সাথে আরেকটা জিনিস শিখেছি, যার কেউ নেই তার জন্য উপরওয়ালা আছেন। আমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে না হলে অন্য বাসা নাও। যা খুশী করো। আমি এবাড়ি ছেড়েও যাচ্ছি না। চাকরিও ছাড়ছি না। হম্বি তম্বি করার আগে ভেবেচিন্তে কথা বলো। করোনা সংক্রমণের অভিযোগ করে তুমি, তোমার বোনের গোষ্ঠী সুদ্ধ সবাইকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি। আর্মিতেও ফোন করতে পারি। নিজেরাই ভেবে দেখো কী করবে ! একদমে কথাগুলো আউড়ে গেলাম। অপমানে আর রাগে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আমি ঘর ছেড়ে বেরুবার আগেই শারমিন তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। কেউ কিছু বুঝবার আগেই হনহন করে হেঁটে দরজা খুলে ফ্ল্যাটের বাইরে।

পিছন ফিরে শুধু বললো, ‘পল্লব! তুমি আসবে নাকি আরও অপমান গিলবে ?” কথার তীর একবার ছুটে গেলে তা ফেরানো কঠিন। এই দিন একদিন আসতোই। করোনার কারণে সবার মুখোশ উন্মোচন হলো। কিছু হারাবার ভয় নেই আর। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়াতে হবেই। বেঁচে থাকার লড়াইটা প্রত্যেকের নিজের। সর্বংসহা দশভূজা হয়ে কোনো লাভ নেই যদি নিজের অস্তিত্ব টিকে না থাকে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত