সকালের দিকে বাসার নিচে আমার নতুন কেনা বাইকটা পরিষ্কার করছি, এমন সময় ছোট বোন এসে বললো,
-নতুন বাইক কিনেছিস অথচ একটাবার নিজের ছোট বোনকে নিয়ে ঘুরতে বের হলি না। আমি মুচকি হেসে বললাম,
— আজ ঘুরতে নিয়ে যাবো যদি আমার বাইক পরিষ্কার করতে সাহায্য করিস। কথাটা শুনে ছোট বোন আনন্দে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললো,
– ঠিক আছে ভাইয়া, আমি তাহলে মামার কিনে দেওয়া ঐ নতুন শাড়িটা পরবো আর তুই আমাকে অনেকগুলো ছবি তুলে দিবি! আমি তখন বললাম,
— সবই হবে আগে তো বাইকটা পরিষ্কার করে দে বিকালের দিকে দেখি ছোট বোন শাড়ি পরে মুখে মেক-আপ টেক-আপ মেখে অবস্থা খারাপ। আমি দুষ্টামি করে ছোট বোনকে বললাম,
— তুই তো দেখতে এমনিতেই সাদা ব্রয়লারের মুরগীর মত। মেক-আপ করে তো তোকে বরফের দেশের সাদা ভাল্লুকের মত লাগছে। ছোট বোন কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,
– এখন একদম খেপাবি না। তুই থ্রি-কোয়াটার পরে আমার সাথে যাবি না কি? আমি অবাক হয়ে বললাম,
— থ্রি-কোয়াটার পরে গেলে সমস্যা কি?ছোট বোন আলমারি থেকে নতুন একটা পাঞ্জাবি বের করে আমার হাতে দিয়ে বললো,
– অনেক সমস্যা আছে। তুই এই পাঞ্জাবিটা পরে নে। তারপর দুই ভাই বোন মিলে অনেক ছবি তুলবো… আমার ছবি তোলার হাত মোটামুটি ভালোই। সেই হিসাবে ছোট বোনকে বিভিন্ন পোজ দেখিয়ে দিচ্ছিলাম আর ছবি তুলছিলাম। একটা সময় ওকে বললাম,
— তুই সামনের দিকে একটু উদাস মনে তাকিয়ে থাক। আর শাড়ির আঁচলটা এমন ভাবে রাখ যেন বাতাসে একটু ওড়ে। মনে মনে ভাব তোর হিমু তোকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে আর তুই রুপা উদাস মনে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছিস। ছোট বোন লজ্জা মাখা হাসি হেসে বললো,
-কুত্তা, ফাইজলামি করবি না একদম..! আমি ছোট বোনের শাড়ির আঁচলটা ঠিকঠাক করে দিচ্ছিলাম। এমন সময় দুইজন মধ্যবয়সী লোক একজন আরেক জনকে বলছেন, ” বুঝলেন ভাই, সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে। আশে পাশে লোকজন না থাকলেই শাড়ির আঁচলের নিচে হাত আর লোক আসতে দেখলেই আঁচল ঠিক করে দেওয়ার বাহানা! ” কথাটা শুনে মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেলো। আমি লোকটাকে বললাম,
— ঠিক বলেছেন আংকেল। সমাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর এই সমাজ নষ্ট করেছে আপনাদের মত কিছু মানুষ যারা ভাই বোনের সম্পর্কটাকেও খারাপ চোখে দেখে। আপনারা যে সন্তানগুলো জন্ম দেন সেই সন্তান গুলোই বড় হয়ে ধর্ষক হয়। গাছ খারাপ হলে গাছের ফলতো খারাপ হবেই লোকগুলো আমার কথায় বিন্দু পপরিমাণ লজ্জা পেলো না। বরং বললো,
— কোথাও কি লেখা আছে তোমরা ভাই বোন হও? তাছাড়া ভাই বোন কখনো পাঞ্জাবি-শাড়ী পরে বাইক নিয়ে ঘুরতে বের হয় না। আমি লোকগুলোকে কি বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিলো গলা টিপে দুইটাকে মেরে ফেলি! পিছনে তাকিয়ে দেখি ছোট বোন কান্না করছে। আমি ছোট বোনকে বললাম,
— আরে গাঁধী কাঁদছিস কেন? মানুষের মত হাত পা থাকলেই কি মানুষ হওয়া যায় না কি? ওরা নরপশু, ওদের কথা বাদ দে। তোকে খুব সুন্দর কয়েকটা ছবি তুলে দিচ্ছি। ছোট বোন চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা মুছতে মুছতে আমায় বললো,
– ভাইয়া, আমি বাসায় যাবো…
এরপর থেকে ছোটবোনকে সাথে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সাহস হয়ে ওঠে নি। বলা তো যায় না, কখন কে কি বলে ফেলে কারণ কোথাও তো লেখা নেই আমরা ভাই বোন শওকত নামের এলাকার এক বড় ভাই ছিলো। উনি সম্পর্কে বড় ভাই হলেও আমার সাথে বন্ধুর মতই মেলামেশা করতেন। সব সময় উনার বাসায় আসা যাওয়া করতাম। একটা এক্সিডেন্টে শওকত ভাই মারা যান। উনাদের আর্থিক অবস্থা ভালো থাকলেও শওকত ভাই মারা যাবর পর ভাবী একটু ঝামেলায় পড়ে যান। একা হাতে সব কিছু সামলাতে পারতেন না। তাই আমি বাজার করে দেওয়া,গ্যাস বিল, কারেন্ট বিল দিয়ে আসা.. এইগুলো করে দিতাম। সেদিন দুপুরে যখন ভাবীর হাতে রান্না করা বিরিয়ানী খাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ ভাবী বললো,
– পিয়াস, তোমায় খুব ঝামেলাই ফেলে দেই আমি। তাই না? শুধু শুধু আমাদের পিছনে অনেক সময় নষ্ট করে ফেলো। আমি হাসতে হাসতে ভাবীকে বললাম,
— আমি বিল গেটস না কি যে আমার সময়ের অনেক দাম? সারাদিন তো বসেই থাকি তাছাড়া আমি তো শুধু শুধু কাজ করে দিই না। তোমার বিরিয়ানীর লোভে করে দেই! ভাবী আমার কথা শুনে মাথাটা নিচু করে বললো,
– নেক্সট টাইম তোমার বিরিয়ানী খেতে চাইলে আমাকে ফোনে বলো আমি রান্না করে তোমার বাসায় পাঠিয়ে দিবো। কিন্তু তবুও কাল থেকে আমার বাসায় আর এসো না। আমি অবাক হয়ে ভাবীকে বললাম,
— কেন ভাবী, কি হয়েছে? ভাবী অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
– একটা মেয়ে কখন অসহায় হয়ে যায় জানো? যখন অল্প বয়সে তার স্বামী মারা যায়। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি অল্প বয়সী বিধবা মেয়েদের সমাজে মানুষ পতিতা মনে করে। ওরা ভাবে স্বামী যেহেতু নেই সেহেতু বিধবা মেয়েরা যার সাথে ইচ্ছে তার সাথেই শারীরিক সম্পর্ক করে। ভাবীর কথা শুনে বিরিয়ানী গলা দিয়ে নামছিলো না। খাওয়া ছেড়ে যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ভাই আমার কথায় কিছু মনে করো না। কি করবো বলো, সমাজ নষ্ট হয়ে গেলেও আমাকে তো সমাজ নিয়েই চলতে হবে।
এর কয়েকদিন পর ভাবীকে বাজারে দেখলাম। ভাবী হালকা মাথা ঝুঁকে টমেটো গুলো দেখে দেখে দোকানদারকে দিচ্ছে মাপার জন্য আর দোকানদার আড়চোখে ভাবীর শরীরের কোনো একটা অংশ দেখার চেষ্টা করছে। এখন যদি প্রতিবাদ করা হয় তাহলে সমাজের কিছু পুরুষ মানুষ বলবে, “মেয়ে মানুষ বাজারে গিয়েছে কেন?” আর কেউ যদি বাজারটা করে এনে দেয় তাহলে সমাজের সেই মানুষ গুলোই বলবে, ” বিধবা মেয়ে মানুষের বাসায় এত পরপুরুষের আনাগোনা কেন?” আমার জন্মদিন উপলক্ষে আমার গার্লফ্রেন্ড শ্রাবণী বায়না ধরলো ওকে নিয়ে সারাদিন রিকশায় ঘুরতে হবে। ওর কথা মত রিকশা নিয়ে ঘুরতে বের হলাম। রিকশাওয়ালাকে বললাম,” আপনার পছন্দ মত যেকোনো একটা জায়গায় নিয়ে যান।” রিকশাওয়ালা আমাদের শহর থেকে কিছুটা দূরে খুব নিরিবিলি একটা রাস্তায় নিয়ে গিয়ে বললো,
– মামা রিকশার হুট তুলে আপনারা কাজ শুরু করে দেন। আমি দূরে বসে সিগারেট খাচ্ছি। কাউকে আসতে দেখলে শিশ বাজিয়ে আপনাদের সিগন্যাল দিবো।
রিকশাওয়ালার কথা শুনে মাথা ঘুরে গেলো। আসলে এই রিকশাওয়ালার কোনো দোষ নেই। দোষ হলো আমাদের। আমাদের মতই কিছু প্রেমিক প্রেমিকেরা উনার রিকশায় বসে এইসব কাজ করেছে, তা দেখেই উনি অভ্যস্থ। সেজন্য আমাদেরকেও ঐরকম মনে করেছেন। আসলে আমরা যে সমাজের দোষ দেই, এটা কিন্তু ঠিক না। দোষতো আমাদের! কারণ আমরাই তো সমাজটাকে এমন বানিয়েছি। আমি মুচকি হেসে রিকশাওয়ালাকে বললাম,
— মামা, তোমার কোথাও যেতে হবে না। তুমি বরং খুব জোরে রিকশা চালাও যাতে আমাদের চোখে মুখে বাতাস আছড়ে পড়ে।
রিকশা খুব জোরে সামনে ছুটে যাচ্ছে আর শ্রাবণীর খোলা চুলগুলো মাঝে মধ্যে আমার চোখ- মুখে আছড়ে পরছে। প্রেমিকার শ্যাম্পু করা চুলের ঘ্রাণে এমনিতেই তো প্রেমিকের মাতাল হয়ে যাবার কথা তবুও কেন এই সমাজের কিছু মানুষ ভালোবাসাটাকেও নষ্টামিতে পরিণত করেছে?