উত্তরণ

উত্তরণ

টিউশনির টাকা জমিয়ে গার্লফ্রেন্ডকে মেরুন কালারের শাড়ি গিফট করেছিলাম। শাড়িটা দেখে খুশি হবার পরিবর্তে সে আমার মুখের উপর বলে দিল ‘-এটা আমি জীবনেও পরবো না। এমন একটা খ্যাত মার্কা কালার তোমার পছন্দ হল? তোমার যখন এতই দেয়ার ইচ্ছে হয়েছিল আমাকে সাথে করে দোকানে নিয়ে যেতে। কথাগুলো শুনে দ্বিতীয়বারের মত আমি চুপসে গিয়েছিলাম এবং ভাবছিলাম এভাবেও কাউকে বলা যায়?

নীলিমা আহমেদ রাত্রি, বাবা-মার আদরের রাজকন্যা। সদা হাস্যজ্জল, বন্ধুবৎসল, অভাবনীয় রুপের অধিকারিণী। ঠোটের পাদদেশে অবস্থিত তিলের আহ্বানে গালের গর্তে(টোল) কতজন হোচট খেয়েছে তার হিসাব আমার জানা নেই। আমি যেদিন প্রথম দেখলাম, থ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একেই বোধহয় স্বর্গের অপ্সরী বলে। এত রুপ এত সৌন্দর্য দেখে কতজন কবিতা লিখার চেষ্টা করেছে সেই খবরও আমার জানা নেই। লাস্যময়ী এই ষোড়শীর প্রেমে হাবুডুবু কলেজের সিনিয়র-জুনিয়ররা। এমনকি অবিবাহিত শিক্ষকগুলো মেয়েটির সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজে।

বাবা প্যারালাইজড হওয়ার পর থেকে থমকে গেছে আমাদের পরিবারে চাকা। বাবা একটা কোম্পানীতে মেশিন অপারেটর হিসাবে কাজ করতো। চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে চার জনের পরিবার স্বাভাবিকভাবে চলতে ছিল। হঠাৎ একদিন কাজ করা অবস্থায় অসাবধানতাবশত বাবার মাথায় আঘাত লাগে।প্রাথমিকভাবে চিকিৎসার ভার কোম্পানী বহন করে, পরবর্তীতে অবস্থা গুরুতর হয়ে যায়। বাবার এক সাইড পড়ে যায়। তখন কোম্পানি এককালীন পঞ্চাশ হাজার টাকা আর বস্তাভরা সমবেদনা দিয়ে পাশ কেটে পড়ে। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে আমরা পড়লাম মহাবিপাকে। সেই টাকা দিয়ে আর কত দিন চলে। মায়ের শরীরও খুব একটা ভাল না। আমি ভেবেছিলাম পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ঐ কোম্পানীতে ডুকবো। কিন্তু বাবা বললো,

-বাপ, যাই করিস না কেন, পড়াশোনাটা ছেড়ে দিস না। সার্টিফিকেটের মর্ম আমি বুঝি। মা’ও বাবার সাথে সাথ মিলিয়ে বললো, কষ্ট করে হলেও পড়াশোনা চালিয়ে যা। একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে।

আমি কলেজে কন্টিনিউ যেতে পারতাম না। গেলেও আমি কারো সাথে তেমন মিশতাম না। আমার কাছে মনে হত বন্ধু মানেই টাকা খরচ। তাদের সাথে মিশলে টাকা খরচ করতে হবে। তখন বুঝতাম এক একটা টাকার মুল্য। আমার ঢিলেঢালা শার্ট প্যান্ট দেখা কেউ কথা বলার আগ্রহ দেখাতো না। আর ওদের স্টান্ডার্ডে আমায় মানাতো না।
প্রথম যেদিন ক্লাস করতে গেছি, খুব উৎসাহ নিয়ে সম্মুখ সারির বেঞ্চে বসতে গেলাম, তখনই একজন বললো এটা অমুকের জন্য, এটা তমুকের জন্য বরাদ্দ। পৃথিবীর নিয়মটাই বোধহয় এমন, জোর যার মুল্লুক তার। হতাশ হয়ে চলে গেলাম পেছনে সারিতে। এখানে বসতে কেউ নিষেধ করে নি। পেছনের সারির অধিকাংশ উচ্ছৃঙ্খল, পড়াশোনা নিয়ে এত ভাবনা নেই। স্যারদের অপমান নির্দ্বিধায় গলাধঃকরণ করে তাও কোন পরিবর্তন নেই। শিক্ষক ক্লাসে থাকলেও গল্প করা, ইয়ারফোনে গান শোনা, মেসেনজারে চ্যাটিং, পর্ণ ভিডিও দেখা এগুলো তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যে কয়েকদিন ক্লাসে যেতাম চুপচাপ এক কোণে বসে ক্লাস করে চলে আসতাম।

অরুণ কুমার ঘোষ সংক্ষেপে এককেজি বা AKG নামে পরিচিত। আরেকটা নামও আছে। প্রেমকুমার, বয়স চল্লিশার্ধ্ব। এখনও বিয়ে করেন নি। মাঝেমধ্যে কুষ্টিয়ার কোর্টপাড়া স্টেশনে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে দেখা যায়। লোকমুখে শোনা যায় তিনি তার প্রিয় মানুষটিকে এখান থেকেই হারিয়েছেন। প্রিয় মানুষটি ফিরবে সেই প্রত্যাশায় এখনও অপেক্ষা করেন। অরুণ আমাদের ইংরেজী ক্লাস নিতেন। পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাসে ত্রিশ মিনিট প্রেমপাঠ(প্রেমের ক্লাস) করাতেন, তবে বাঁকি বিশ মিনিট এত সুন্দর পড়াতেন তার সমকক্ষের শিক্ষক অত্র অঞ্চলে নেই। তিনি ক্লাসে সবচাইতে বেশি মজা দিতেন।ছাত্র-ছাত্রীরা অন্য সব স্যারের ক্লাস মিস করলেও প্রেমকুমার স্যারের ক্লাস মিস করতে চাইত না।

বাবা অসুস্থ হওয়ার পর সংসারে দায়িত্ব নিজের কাঁধে চলে আসে। এক ভাইকে ধরে একটা কোচিংয়ে ক্লাস নেয়ার সুযোগ হল। তারপর সেখান থেকে আরো দুটো টিউশনি।কোচিং থেকে হাজার তিনেক, আর দুটো টিউশনি দুই। মা টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে। সব মিলিয়ে মোটামুটি ছয় সাত হাজার। বাবার ঔষুধের খরচ মিটিয়ে সংসারটা টেনেটুনে চলে যায়। শখ বিলাসিতার সুযোগ হয় না। সকাল বিকাল কোচিং তার পর পর দুটো টিউশনি, মাঝেমধ্যে হাঁফিয়ে উঠি।সবসময় চিন্তা করতাম কবে পড়াশোনা শেষ হবে। একটা বড় চাকরী করবো, ধুমধাম করে ছোট বোনটার বিয়ে দিবো। দুচোখে কত স্বপ্ন….

অরুন স্যার একদিন ক্লাশ শেষের দিকে সবার উদ্দেশ্য বললেন- প্রেম ভালবাসা নিয়ে তোমাদের কার কি ভাবনা পরের ক্লাসে লিখে নিয়ে আসবে। সেদিন রাতে আমার ঘুম আসলো না। কি লিখবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মনে হল ঘরে তো কয়েকটা উপন্যাস আছে। বাবা-মার লাভ ম্যারেজ ছিল। বাবা মা’কে বিয়ের পূর্বে অনেক বই গিফট করেছিল। নিমাই ভট্টাচার্যে মেম সাহেব উপন্যাস বের করে একটানা পড়ে শেষ করলাম। তখন মাথায় কিছুটা ভাবনা হল। প্রেম তো ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। একটা কাগজে কয়েকটা লাইন লিখলাম…

টিউশনি শেষ করে পরের দিন ক্লাসে যেতে লেট হল। অরুণ আমায় দেখে বললেন- Come in. আমি দ্বিতীয় বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। আমি চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখলাম আমায় দিয়ে চারজন ছেলে, আর তিনবেঞ্চে ন’জন মেয়ে। তখন স্যার বললো- You are the unlucky thirteen number. So, let start what you have written about love. Express your feelings. ভয়ে বুকটা দুরু করছে। কি ভাবে যে কি বলি।

স্যার আবার বললেন, -কি বললাম বুঝতে পেরেছো? কিছু লিখে নিয়ে আসতে বলেছিলাম। লিখেছো?? মুখ ফসকে ‘না স্যার’ শব্দটা বের হয়ে গেল। Ok, fine. Bring out your thoughts. সাহস নিয়ে বললাম- “প্রেম হল এক অদৃশ্য মায়া।দুটি দেহের একই আত্মা! প্রেম মানে কুয়াশাঘেরা শিশিরসিক্ত দুর্বাঘাসের উপর প্রিয় মানুষটার হাত ধরে খালি পায়ে হেঁটে চলা। শরতের কোন এক পড়ন্ত বিকেলে কাশবনের ধারে বসে নীল আকাশের মেঘের মাঝে হারিয়ে যাওয়া। কোন এক বৃষ্টি নামা দুপুরে প্রেয়সীর সাথে ভিজে একাকার হওয়া। প্রেম মানে কখনও ছেড়ে যাবো না, এই প্রতিশ্রুতি দেয়া।”

=বাহ্ চমৎকার। তোমার চিন্তনশৈলী অসাধারণ। কবিতা লিখো নাকি?
-না স্যার।
=এখন থেকে লিখবে। গল্প, কবিতা যা মনে আসবে, তাই লিখবে।
-জি স্যার।

এরপর আরো কয়েকজনের কথা শুনলেন। তার খুব একটা পছন্দ হল না। তারপর বললেন আজ আর কারো কাছে কিছু শুনবো না। তোমাদের ভাবনার পরিধি বাড়ানোর জন্য লিখতে বলেছিলাম। কিন্তু আপসোস, তোমাদের ইচ্ছে শক্তি সংকীর্ণ। ক্লাস শেষে স্যার আমাকে একটা ডাইরি উপহার দিয়ে বললেন, ‘প্রতিভাটা নষ্ট করো না…

কলেজে উঠার পর, শখ করে একটা ফেসবুক আইডি খুলেছিলাম। কিন্তু খুব একটা খুব একটা চালানো হত না।তবে প্রেমকুমার স্যারের উৎসাহের পর ফেসবুকের পাতায় ছোট ছোট কবিতা লিখতাম। অনেক রিকোয়েস্ট আসতো। চোখবুজে সবাইকে এড করে নিতাম। অনেকেই লিখার প্রশংসা করত, উৎসাহ দিত। তবে যাই লিখি না কেন নীলারাত্রি নামের আইডি থেকে যথেষ্ট উৎসাহ আসতো। একদিন আগ্রহ নিয়ে নিজ থেকে নক দিলাম, তারপর থেকে নিয়মিত চ্যাটিং, কি ভাবছি, কি লিখছি সব কথায় হতো।। এভাবে অনেকগুলো দিন গড়িয়েছে। বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ভালবাসায় রুপ নিয়েছে। তখনও তাকে দেখি নি। পিক চাইলেই বলতো, তুমি কি চেহারাকে ভালোবাসো নাকি মনটাকে ভালোবাসো।

প্রত্যুত্তরে আমি হেরে গেছি। প্রথম যেদিন আমাদের দেখা হল, আমি পুরোটাই অবাক। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এই মেয়েটাই কলেজের সেরা সুন্দরী নীলিমা আহমেদ রাত্রি। তবে তাকে দেখারর পর পায়ের তলার অবশিষ্ট মাটিটুকুও সরে গেলো। কোথায় আমার পরিবার, আর কোথায় তার? জমিনে বাস করে আমি চাঁদ ছোঁয়ার কল্পনা করতে পারি না। বাস্তবতা আমি বুঝি…। আমাদের এই প্রেম কখনই সম্ভব নয়। কোনভাবেই তাকে বুঝাতে পারলাম না যে এটা হয় না। তবুও এটা চলতে থাকলো। তার জেদী মনোভাবের কাছে আমার বুঝ নিত না।

টিউশনি থেকে ফিরে প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছিল। বিছানায় গা লাগাতেই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম। মা বলল, খাবার টেবিলের উপর রেখে গেলাম উঠে খেয়ে নিস। হঠাৎ রাত্রীর ফোনে ঘুম ভাঙলো। জিজ্ঞেস করলো, খেয়েছি কি না। জবাবে না বলাতে বললো, -এখনই উঠো খেয়ে নাও, আর খাচ্ছো কিনা এমন একটা পিক পাঠাবে। খেতে বসে খাবারের একটা পিক পাঠালাম….

-ওহ মাই গড! তুমি এগুলো খাও কি করে? এই মোটা মোটা ভাত তো আমার গলা দিয়ে নামবে না।’
মেসেজটা দেখামাত্র ভাত আমার গলা দিয়ে নামলো না। মনে হল কেউ গলা টিপে ধরেছে। প্রচণ্ড অবাক হলাম। এভাবে কি তার বলাটা ঠিক হল? এর পর অনেকগুলো দিন পেরিয়েছে। মন থেকে ভালবাসতাম, কিন্তু বাস্তবতায় দুরে ঠেলতাম। আমি তাকে কখনও বুঝে উঠতে পারি নি। তার কোন বাড়তি দাবী ছিল না, আমারও কোন চাওয়া ছিল না। সে হয়ত আমার কবিত্ব মনোভাবকে ভালবাসতো। এজন্যই আমার সঙ্গ পছন্দ করতো। এতকিছু মিলিয়ে দিন চলে যাচ্ছিলো।

দ্বিতীয়বার অপমানিত হয়ে বিধ্বস্ত চেহারায় বাসায় ফিরলাম। হাতে সেই মেরুন রংয়ের শাড়ী, মা দেখে বাবাকে বলছে, -ওগো শুনছো, তোমার ছেলে বড় হয়ে গেছে। আমার জন্য শাড়ি কিনে এনেছে। শাড়ীটা হাতে নিয়ে মা বললেন, বাহ্! অনেক সুন্দর হয়েছে। আমি আর কিছু বলতে পারি নি। বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। মা’কে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছি…এই কান্না দুঃখের নয় সুখের কান্না…

সেদিন রাতে শেষবারের মত ফেসবুকে ডুকলাম। কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। ”তোমার পছন্দ হয় নি, সেটা আমার সামনে নাও বলতে পারতে। তুমি ফকিরকে দিয়ে দিতে বা ঘর মুছতে। আমি তো জানতাম না। আমার রুচি এতটা খারাপ ছিল বলে কখনও জানিনি। আজ থেকে তোমায় মুক্তি দিয়ে দিলাম। আর কখনও আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। ভালো থেকো।” মেসেজটা সেন্ড করে কিছুটা স্বস্তি লাগলেও মনের দিকে অস্বস্তিতে লাগছিল। আইডিটা একেবারে ডিলেটে দিলাম।অবহেলায় পড়ে থাকা ধুলোমাখা ডাইরিটা বের করে প্রথম পাতায় লিখলাম- আমার প্রথম ভালবাসা আমার পরিবার….

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত