জীবন

জীবন

ঠিক এই মুহুর্তে আমার আম্মু আমার পাশে বসে কান্না করতে করতে বলছেন-

–আর কতোদিন মেহরাব? এভাবে আর কতোদিন চলবে?? আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিলাম। মাত্র কয়েকটা দিনে আমার জীবনটা একদম উলটপালট হয়ে গেলো। অথচ আমার জীবনটা একটু অন্যরকম হলেও হতে পারতো!!

–এইযে মিস্টার প্রবলেম কি তোমার? অলটাইম আমাকে ফলো কেনো করো?! সকাল ৬টা জগিং করার সময় হুট করেই কোনো এক মেয়ে পিছন থেকে ডাক দিয়ে কথাটা বললো। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সাদা টি-শার্ট, সাদা ট্রাউজার, পায়ে সাদা কেডস, মাথায় সাদা ক্যাপ পড়া কোনো এক সাদা অপ্সরী আমাকে কথাটা বলছে। আমি কিছুটা অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম-

–মানে কি? আমি কখন আপনাকে ফলো করি?
–সবসময় করো। এইযে প্রতিদিন আমি এখানে জগিং করতে আসি, তুমিও আসো। কিন্তু তুমি জগিং করতে না,, আমাকে দেখার জন্যই আসো আর জগিং করার ভান করো !!

–দেখুন আমি প্রতিদিন সকালে জগিং করার জন্যই আসি। জগিং শেষ করে আমার স্টুডেন্টকে পড়াতে যাই। দেন নাস্তা করে ভার্সিটিতে চলে যাই, আর সন্ধ্যায় ভাষায় ফিরি। এখানে আপনাকে ফলো কখন করি সেটাই বুঝতে পারছিনা !!

–ওই তুমি এতো বেশি কথা বলো কেনো? আমি কি জানতে চাইছি তোমার সারাদিন কিভাবে কাটে? নেক্সট টাইম যাতে আমার আশেপাশে না দেখি বুঝলে? কথাটা বলেই মেয়েটা চলে গেলো। আমি অবাক হয়ে ভাবতে থাকি কে এই মেয়ে? মেয়েটার কি মাথায় প্রবলেম? না’কি সকাল সকাল আমার মাথাটা খারাপ করে দেওয়ার জন্যই এসেছে? যাইহোক এসব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে বাসায় ফিরে আসি। এখন আমার স্টুডেন্ট রাহাতকে পড়াতে যেতে হবে কিছুদিন পরেই ছেলেটার পিএসসি এক্সাম!! পরেরদিন থেকে প্রতিদিন সকালে জগিং করার সময় মেয়েটাকে দেখতাম। মেয়েটার চোখে চোখ পড়তো আমি ভয় পেয়ে চোখটা নামিয়ে অন্য দিকে চলে যেতাম। সত্যি বলতে মেয়েটাকে অনেক ভয় লাগতো যদি আবার এসে ঝাড়ি দেয় তখন কি করবো?

ব্যাস এভাবেই কাটছিলো দিন। প্রতিদিন মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয়,, আমি চোখটা নামিয়ে অন্য দিকে চলে যাই। মেয়েটাকে ভয় পেতাম এটা ঠিক, আবার মেয়েটার প্রতি কবে যে ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করলো বুঝতেই পারলাম না। ওর চোখে চোখ রাখা কয়েকটা সেকেন্ডের সেই মুহুর্তটা আমার সারাটা দিনের সবচাইতে বেস্ট মুহুর্ত হয়ে গেলো। সত্যি বলতে ইদানিং জগিং করার কোনো ইচ্ছা না থাকলেও প্রতিদিন জগিং এ যেতাম। ওর চোখে চোখাচোখি হওয়া সেই কয়েকটা সেকেন্ডের জন্য!!

সেদিন রাতে মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছিলো। অনেক ঠান্ডা পড়ছে। মাথায় হাত দিয়ে দেখলাম হালকা গরম। সম্ভবত জ্বর আসবে। কিন্তু এখন জ্বর আসলে আমার অবস্থা একদম খারাপ হয়ে যাবে। সামনে আমার এক্সাম, আমার স্টুডেন্ট রাহাতের এক্সাম। ড্রয়ার থেকে একটা নাপা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমটা যখন ভাঙলো তখন সকাল ৮টা। ইশশশ আজকে আর মেয়েটাকে দেখা হলোনা। মাথাটা প্রচন্ড ভারী লাগছে। ইচ্ছা করছেনা টিউশনিতে যেতে… তারপরেও তাড়াতাড়ি এক কাপ চা খেয়ে রাহাতের বাসার উদ্দেশ্যে বের হলাম। অন্য কোনোদিন হলে এই জ্বর নিয়ে যেতাম না কিন্তু ছেলেটার এক্সাম। আমার যাওয়াটা জরুরী !!

সেদিন রাহাতকে পড়াটা বুঝিয়ে দিয়ে কখন যে টেবিলের উপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। ঘুমটা ভাঙার সাথে সাথে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল ১০টা। মাই গড তারমানে ২ঘন্টা যাবথ আমি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলাম? ডান দিকের চেয়ারটায় তাকিয়ে দেখি রাহাত বসে বসে খিলখিল করে হাসছে। বাম দিকে ফিরে তাকাতেই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শকড খেলাম জগিং এর মেয়েটা এখানে দাঁড়িয়ে। মনের ভুল ভেবে ডান হাত দিয়ে চোখটা মুছে আবার তাকালাম। না মেয়েটা সত্যি দাঁড়িয়ে আছে। আমি কি বলবো ঠিক ভেবে পাচ্ছিনা। আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা বললো-

–কেউ স্টুডেন্টের বাসায় এসে এভাবে ঘুমিয়ে থাকে? শরীর খারাপ করছে তাইনা?? আজকে জগিং করতেও আসোনি। কথাগুলো বলে মেয়েটা আমার কপালে হাত দিলো। আমার শরীরে মেয়েটার প্রথম স্পর্শ আমার সাথে কি হচ্ছে আমি আসলেই কিছু বুঝতে পারছিনা। মেয়েটা আমার মাথায় হাত দিয়ে বললো-

–ইশশশশ অনেক জ্বর। একটু অপেক্ষা করো। আমি রুম থেকে মেডিসিন নিয়ে আসছি…!!

কথাটা বলে মেয়েটা রুমের দিকে চলে যায়। আমার কেনো জানিনা নিজের কাছে খারাপ লাগলো। আসলেই তো… কেউ স্টুডেন্টের বাসায় পড়াতে এসে এভাবে ঘুমায়? আমি রাহাতকে ছুটি দিয়ে মেয়েটার ফিরে আসার অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বের হয়ে বাসায় চলে আসি। পরের ২দিন অনেক চেষ্টা করেও রাহাতের বাসায় যেতে পারিনি। যাবো কিভাবে? জ্বরে তো বিছানা থেকে উটতেই পারিনি !! জ্বর কমার পর যেদিন রাহাতের বাসায় গেলাম, সেদিন গিয়ে প্রথমেই রাহাতকে জিজ্ঞাস করলাম-

–আচ্ছা রাহাত? সেদিন যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিলো ওনি কে?
— স্যার আপনি মিহি আপুকে চিনেন না? আপনি জানেন না আমার বড় একজন বোন আছে?
–হুম বোন আছে সেটা তো জানি। কিন্তু তোমাকে পড়ানোর তো ২মাস হয়ে গেলো। এই ২মাসে ওনাকে তো একবার ও দেখিনি !! রাহাত ওর দাঁতগুলো বের করে হাসতে হাসতে বললো-

–মিহি আপু তো আপনার সামনেই বের হোন না দেখবেন কিভাবে? কিন্তু আপু প্রতিদিন আপনাকে দেখেন। আপনি আমাদের বাসায় আসার সময় ছাঁদ থেকে দেখেন যাওয়ার সময় ছাঁদ থেকে দেখেন। আমাকে তো প্রতিদিন আপনার কথা জিজ্ঞাস করেন !! রাহাতের মুখে কথাগুলো শুনে আমি অনেকটা অবাক হলাম আবার মনের ভিতর অনেকটা আনন্দ কাজ করছিলো। আমি রাহাতকে বললাম-

–তোমার আপুকে এখন একটু আসতে বলবে? ১টা কথা বলার ছিলো ওনাকে !!
–কিন্তু স্যার আপু’তো বাসায় নেই। আব্বু আপুকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। ওখানে ৩-৪দিনের ভিতর আপুর বিয়ে দিয়ে দিবে !! কথাটা শুনে আমার বুকটা কেমন যেনো ধুক করে উঠলো। আমি রাহাতকে বললাম-

–বিয়ে দিয়ে দিবে মানে? জোর করে বিয়ে দিচ্ছে না’কি?
–আরে না না স্যার… ওখানে আমার ফুফাতো ভাই আছেনা? ওনার সাথে সবার সম্মতি নিয়ে বিয়ে হচ্ছে !!

রাহাতের মুখে কথাগুলো শুনে ভিতরে কি’রকম কষ্ট হচ্ছিলো তা কাউকে বুঝানো সম্ভব না। সেদিন প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলাম আমি মিহিকে ভালোবাসি। প্রচন্ড ভালোবাসি! ৩টা দিন পার হয়ে গেছে। সেদিন রাহাতের বাসা থেকে আসার পর ওকে আর পড়াতে যাইনি। প্রতিদিন সকালে জগিংয়ের জায়গাটাতে গিয়ে বসে থাকতাম। মিহিকে একটাবার দেখার জন্য সেই চোখে চোখ রাখা কয়েকটা সেকেন্ডের জন্য কিন্তু আফসোস মিহি আসতোনা। আমি জানিনা মিহিকে আবার দেখতে পাবো কি’না। আমি জানিনা মিহির সাথে আবার কথা হবে কি’না। তারপরেও অপেক্ষা করতে থাকি মিহিকে একনজর দেখার অপেক্ষা!!

রাহাতকে পড়াতে যাইনি ৫দিন হয়ে গেছে। ৫ম দিন রাত ১১টায় আননোন নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে একটা মেসেজ আসে। “”এই ছেলে… ৫দিন যাবথ রাহাতকে পড়াতে আসোনা কেনো হুম? একটা মিথ্যা না’হয় রাহাতকে দিয়ে বলিয়েছি, তাই বলে এরকম করতে হয়? আগামিকাল সকাল ১১টায় কলেজের সামনে আমার সাথে দেখা করিও… মিহি”” মেসেজটা পড়ে মুহুর্তের মধ্যেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। আবার মেয়েটাকে প্রচন্ড গালি দিতেও ইচ্ছা করছিলো। কেউ এভাবে মিথ্যা বলে মানুষকে কষ্ট দেয়? আমি মোবাইলটা তাড়াতাড়ি হাত থেকে রেখে অপেক্ষা করতে থাকলাম সকাল হওয়ার অপেক্ষা!! সকাল ১১টা… কলেজের সামনে যেতেই দেখলাম মিহি হাতে একটা ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিহির কাছে যেতেই মিহি বললো-

–কি ব্যাপার মেহরাব সাহেব? একদম ঠিক টাইমে চলে আসলেন? আমি মিহির প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে উল্টো মিহিকে প্রশ্ন করলাম-

–আমার সাথে এরকম মজা কেনো করলে? মিহি ওর মুখে হাত দিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো-

–কি করবো বলো? তুমি যে টাইপের ছেলে, সারাজীবনেও তোমার মনের কথা বলতে পারতেনা। তাই তোমার মনের কথাটা বুঝার জন্যই রাহাতকে দিয়ে মিথ্যাটা বলালাম !!
–তো মিহি ম্যাম কি আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছেন?
–আমরা ওইদিকে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি?? রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাললাগছেনা।
–ঠিক আছে!!

দুজন চুপচাপ হাঁটছিলাম। আমাদের মধ্যে কয়েক পা দূরত্ব… হুট করে মিহি আমার হাতটা টান দিয়ে আমাকে ওর ছাতার ভিতর নিয়ে বললো-

–রোদে হাঁটতে ভাললাগে তোমার? ছাতার ভিতরে আসো !!

আমি মিহির চোখের দিকে তাকালাম। মিহি এখনো আমার হাতটা ধরে আছে।আমি মিহির চোখের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললাম-

–সারাজীবন আমার হাতটা ধরে এভাবে হাঁটবে?

মিহি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে হ্যা সূচক উত্তর দিলো। ব্যাস… সেদিন থেকেই শুরু আমাদের প্রেম আমাদের সুখের মুহুর্ত!! ভালোই চলছিলো আমাদের দিন। রাহাতকে পড়াতে গিয়ে মিহির সাথে দেখা হতো এক্সট্রা টাইমেও বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখা করতাম। কিন্তু আমার সুখটা বিধাতার কাছে বেশি পছন্দ না। তাইতো আমার সুখের সময়টা আমার কাছ থেকে খুব তাড়াতাড়ি কেড়ে নিলেন…!! সেদিন মাসের প্রথমদিন যখন রাহাতকে পড়াতে গেলাম, তখন মিহির বাবা বের হয়ে আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন। যার অর্থ আমাকে আর আসতে হবেনা। আমি তারপরেও আংকেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আংকেল কিছুটা রাগি কন্ঠে বললেন-

–তোমাকে আর আসতে হবেনা। আমি রাহাতের জন্য অন্য কোনো টিচার দেখে নিবো !!
–কিন্তু আংকেল আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আংকেল আবারো বললেন-
–তুমি এখন আসতে পারো !!

আংকেল হুট করে এভাবে রেগে যাওয়ার মতো কোনো কারন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেদিন নিরুপায় হয়ে বাসা থেকে চলে আসলাম!! বাসায় এসে মিহিকে ফোন করলাম। কিন্তু নাম্বারটা সুইচ অফ… সারাদিন একটু সময় পর পর মিহির নাম্বারে ফোন করেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু বার বার নাম্বারটা সুইচ অফ আসছে। আমার মাথাটা তখন কাজ করা বন্ধ করে দিছে। কি করবো এখন আমি? একটা ছেলের তখন কি করা উচিত..??

মিহির সাথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার ৭দিন হয়ে গেছে। এই ৭দিনে কয়েক হাজারবার মিহির নাম্বারে কল দিছি, বাট নাম্বারটা সুইচ অফ। ওর ফ্রেন্ডদেরকে কল দিছি ওরাও মিহির কোনো খুঁজ জানেনা। মিহির বাবা না’কি ওদের সবাইকে বাসায় যেতে নিষেধ করে দিছেন। কেমন জানি ভিতরে খুব বেশিই ভয় কাজ করছে… মিহির জন্য ভয়। আমি নিরুপায় হয়ে বাসায় বসে থাকা ছাড়া কিচ্ছু করতে পারছি না। সেদিন-ই জীবনের প্রথম নিজেকে খুব বেশিই অসহায় মনে হলো…!! রাত ১০টা আমার মোবাইলটা বেজে উটলো। ফোনটা ধরার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে মিহির কান্না করার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। মিহি কান্না করতে করতে বললো-

–মেহরাব, বাবা আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গেছে। আমার মোবাইলটাও আমার কাছ থেকে নিয়ে নিছে। আমি অনেক কষ্টে চুরি করে আম্মুর নাম্বার থেকে তোমাকে ফোন করছি। প্লিজ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও মেহরাব… বাবা পরশুদিন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। প্লিজ মেহরাব আমাকে নিয়ে যাও !! মিহির কান্না শুনে আমি কি বলবো ঠিক ভেবে পাচ্ছিলাম না। স্রেফ মিহিকে এতোটুকুই বললাম-

–চিন্তা করোনা মিহি। আমি আগামিকাল আংকেলের সাথে কথা বলবো !! মিহি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে বললো-

–মেহরাব আমি আগামিকাল অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। কিন্তু একটা কথা জেনে রেখো মেহরাব, তোমাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে লাইফ কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব না। ভালো থেকো…!! আমি পরেরদিন সকালে মিহিদের বাসায় গেলাম। কিন্তু দারোয়ান আমাকে কোনোভাবেই বাসার ভিতরে যেতে দিচ্ছেনা। অনেক চিল্লাচিল্লি করছিলাম। আমার চিৎকার করা শুনে আংকেল গেইটের বাইরে এসে বললেন–

–প্রবলেম কি তোমার?
–আংকেল প্লিজ এরকম করবেন না। আমার লাইফটা, মিহির লাইফটা এভাবে নষ্ট করবেন না প্লিজ !!
মিহির বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন-

–দেখো মেহরাব আমার মেয়ের ভিতর এখন যেটা কাজ করছে সেটা আবেগ। বিয়ের পর সেটা এমনিতেই কেটে যাবে। আগামিকাল আমার মেয়ের বিয়ে। ছেলে কি করে জানো? ছেলে তোমার মতো টিউশনি করায় না। ওর দেশে বিদেশে নিজস্ব বিজনেস। আমার মেয়েটাকে সুখি থাকতে দাও প্লিজ !! আমি কান্না জড়িত কন্ঠে মিহির বাবাকে বললাম-

–আমাকে ১টা বছর সময় দিন প্লিজ। আমার পড়া শেষ হলে আমিও ভালো একটা চাকরী পাবো। মিহি আমার সাথেই বেশি সুখে থাকবে !! মিহির বাবা আমার কথা শুনে হাসলেন। হেসে হেসে বললেন-

–দেখো মেহরাব। এসব আবেগ বাদ দাও। আমি মিহির জন্য যে ছেলে ঠিক করেছি, তুমি সেই ছেলের পজিশনে যেতে হলে এখনো তোমাকে ১০বছর অপেক্ষা করতে হবে। এসব কথা বাদ দিয়ে নিজের বাসায় ফিরে যাও। আর নেক্সট টাইম এখানে আসলে আমার কাছ থেকে ভালো ব্যাবহার পাওয়ার আশা করিওনা !! সেদিন আংকেলকে অনেক চেষ্টা করেও বুঝাতে পারিনি। আমি নিরুপায় হয়ে অসহায়ের মতো চলে আসলাম…!!

আজকে রাতে মিহির বিয়ে। অথচ আমি আমার রুমে বসে কান্না করা ছাড়া অন্য কিছুই করতে পারছিনা। আমি পারছিনা ফিল্মের হিরোর মতো মিহিকে বাসা থেকে তুলে আনতে। জীবনটা কোনো সিনেমা না আমি বুঝতে পারছিলাম আমার ভালোবাসা আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। আমি মিহিকে হারিয়ে ফেলছি। কিন্তু আমি নিরুপায় আমি অসহায়!! রাত ৮টা আমার মোবাইলে একটা কল আসলো। ভাবলাম হয়তো শেষবারের মতো মিহি কল দিছে। চোখটা মুছে ফোনটা রিসিভ করার সাথেই মিহির বাবার কান্না জড়িত কন্ঠটা শুনতে পেলাম। ওনি কান্না করতে করতে বলছেন-

–মিহি আর নেই। মিহি আর নেই মেহরাব একটু আগেই আমার মেয়েটা ছাঁদ থেকে লাফ দিয়ে সুসাইড করছে !!
কথাগুলো শুনে আমার চোখ থেকে অবিরাম পানি পড়ছে। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটগুলো কাঁপছে আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের করতে পারছিনা। ওনি আবারো কান্না করতে করতে বললেন-

–আমি বুঝতে পারিনি বাবা। আমি বুঝতে পারিনি মিহি তোমাকে এতোটা ভালোবাসে। আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা আমাকে ক্ষমা করে দাও!!

আমি হাত থেকে মোবাইলটা ফেলে মিহির বাসার দিকে ছুটে গেলাম। মিহির বাসার গেইটের সামনে গিয়ে দেখলাম অনেক মানুষ ওদের বাসায়। মিহির বাবাকে দেখলাম ওনার সামনে কি যেনো একটা জড়িয়ে ধরে অনেক জোরে জোরে কান্না করছেন। আমার চোখ থেকে তখনো অবিরাম পানি পড়ছে। আমি আস্তে আস্তে পা দিয়ে ওনার কাছে গেলাম। ওনি আমাকে দেখা মাত্রই ওনার সামনে রাখা একটা সাদা কাফন সরালেন। কাফনটা সরানো মাত্রই মিহির রক্তভেজা মুখটা আমার সামনে চলে আসলো ও অনেক সুন্দর করে ঘুমাচ্ছিলো। কিন্তু ওর চোখগুলো আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। যে চোখগুলো দেখার জন্য প্রতিদিন সকালে জগিং এ যেতাম, সেই চোখগুলো আজকে বড্ড শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। ওর হাতটা নিস্তব্ধ হয়ে কাফনের ভিতর লুকিয়ে আছে। যে হাতটা আমার কপালে হাত রেখে বলতো “অনেক জ্বর উঠছে তোমার তাইনা?” আমি রোদের মধ্যে হাঁটলে যে হাতটা আমাকে টান দিয়ে ছাতার ভিতর নিয়ে গিয়ে বলতো “রোদের মধ্যে হাঁটতে অনেক ভাললাগে?

ছাতার ভিতরে আসো” ওর বলা শেষ কথাটা বার বার কানে মধ্যে ভাঁজছিলো। “মেহরাব, তোমাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে লাইফ কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব না”… সেদিন মিহির লাশটা ধরে কান্না করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলাম। জ্ঞানটা যখন ফিরলো তখন আমি হসপিটালে!! ব্যাস তারপর কেটে যায় ৬টা মাস অনেক আগেই আমিও মিহির কাছে চলে যেতাম। অনেক আগেই সুসাইড করতাম। বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিলোনা এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে থাকার। কিন্তু আমার আম্মু আমার আম্মুর জন্য বারবার সুসাইড করতে গিয়েও ফিরে আসছি। আমার একমাত্র সাথী এখন সিগারেট। আমার রাত কাটানোর সঙ্গী আমার আম্মু আমার রুমে এসে কান্না করতে করতে বলেন-

–আর কতোদিন মেহরাব? আর কতোদিন এভাবে চলবে? আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে মিথ্যা একটা হাসি দেই। আমি জানিনা দোষটা আসলে কার? দোষটা আমাদের ভালোবাসার? না’কি ফ্যামেলির? না’কি এই সমাজের? আমি জানিনা কেনো আমার জীবনটা এমন হলো আমি শুধু এটা জানি, আমার জীবনটা একটু অন্যরকম হলেও হতে পারতো!!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত