আমরা তিন বোন মিলে আব্বার ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জির ছিদ্র গুনতাম। আমার আব্বার দুটো স্যান্ডো গেঞ্জি। একটা মোটামুটি ভালো। এই ভালো গেঞ্জিটা আব্বা কোথাও বেড়াতে গেলে পরেন। ছেঁড়াটা নিয়মিত পরেন। অফিস থেকে ফিরে আব্বা জামা আর স্যান্ডো গেঞ্জিটা খুলে যখন খাটের কোণায় রাখতেন তখন আমরা তিন বোন পাল্লাপাল্লি করে এই ছিদ্রগুলো গোনা শুরু করতাম। আমাদের ছিদ্র গুনতে দেখে আব্বা হাসতেন আর বলতেন, মা জননীরা দেইখো গুনতে গিয়া আমার গেঞ্জির ছিদ্রগুলান আরো বড় কইরো না।
বিলু ছিল বিরাট মাথা মোটা। শুধু মাথা মোটা বললে ভুল হবে। বিলু একটা ভুইত্ত্যা মারা মাইয়্যা। হা হা হা….. এটা্ আমার মা বলতেন। সাতের নামতা শিখতে তার লেগেছিল গোটা মাস দুয়েক। বিলু আমাদের মেজো। আমি তিথি আর ভয়ানক সব বুদ্ধি মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটা হলো ছোটো বোন বিথি। তিথি আমাদের সবার বড়। বিথিকে নিয়ে আব্বা বলতেন, আমার এই মাইয়্যা হলো গিয়া রানী এলিজাবেথ। এই মাইয়্যার বুদ্ধি থাকব না তো কার বুদ্ধি থাকব।
তখন আমরা সবাই প্রাইমারীতে পড়ি। আমি পঞ্চম শ্রেনীতে উঠলাম। বিলুকে তৃতীয় শ্রেনীতেই থাকতে হলো বলে বিথিও দ্বিতীয় শ্রেনী থেকে পাশ করে তৃতীয় শ্রেনীতে বিলুর সাথে যোগ দিলো। মা বলতেন এই মাইয়্যাতো ভুইত্যা মারা মাইয়্যা। তারে ক্লাস থ্রিতেই মেট্রিক দেওয়া লাগবে।
তখন ঘোর বর্ষা। কাক ভেঁজা হয়ে সন্ধ্যার পর পর আব্বা বিরাট এক কাঁঠাল নিয়ে বাসায় ঢুকলেন। বাসায় ঢুকেই তিনি বললেন, তিথির মা আজ রান্ধন বন্ধ। আজ রাইতে কাঁঠালই আমাদের খাওন। এত বড় কাঁঠাল খাইয়্যা ভাত কি আর খাওন যাইবো। মা জননীরা তোমাগো পড়ালেখা তাড়াতাড়ি শেষ কর। তোমাগো পড়া শেষ হইলেই এই কাঁঠাল ভাঙ্গা হইবো।
বিলু কাঁঠাল দেখে আনন্দে আত্নহারা। ও পড়ালেখা বাদ দিয়ে কাঁঠালের পাশে গিয়ে বসে আছে। কাঁঠাল বিলুর ভীষণ প্রিয়। আমাদেরও প্রিয় তবে বিলু কাঁঠাল একটু বেশিই পছন্দ করে। এত বড় কাঁঠাল আমরা আর কখনো দেখিনি। সবাই পড়ার টেবিলে থাকলেও অপেক্ষা করছিলাম আব্বা ভেঁজা জামা কাপড় পাল্টিয়ে কখন বলবে, আইসো দেখি মা জননীরা কাঁঠালটা খাইতে জুইত হলো কিনা। বিলু মাঝে মাঝে কাঁঠালের গায়ে হাত দিয়ে দেখছে। কাঁঠালের গায়ে হাত চেপে ধরলে খোসার ধারালো গুটি গুটি চিহ্ন হাতের তালু তে বসে যায়। বিলু খুব খুশি হয়ে হাতের এই চিহ্ন আমাদের এসে দেখাচ্ছে।
আব্বা মেঝেতে কাঁঠাল নিয়ে বসলেন। আমরা তিন বোন আব্বাকে ঘিরে বসে আছি। আব্বা দুই হাতের তালু তে সরিষার তেল মেখে বিসমিল্লাহ বলে কাঁঠালে হাত দিলেন। বাবা বললেন, মা জননীরা বিসমিল্লাহ বলে কাঁঠাল ভাঙ্গলে কাঁঠালের খোয়াগুলো খুব ভালো হইবো। আব্বা কাঁঠাল ভেঙ্গে একটার পর একটা খোয়া বাটিতে রাখতে রাখতে বললেন, মা জননীরা তোমরা খাওয়া শুরু কর।
আমরা আনন্দে কাঁঠাল খাচ্ছি। বিলু একটু বেশিই খাচ্ছে। আমরা বাটিতে রাখা খোয়া শেষ করতে না করতেই আব্বা আবার বাটি ভর্তি করে ফেলেন। আব্বা বিলুর দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বললেন, মা জননী কাঁঠাল কেমুন হইলো? মিষ্টি আছে তো? বিলুর কথা বলার সময় নেই। তার মুখ ভর্তি কাঁঠাল। বিথি বললো, খু-উ-ব মিষ্টি। একেবারে চিনির মত।আব্বা বলল, খাও মা খাও। আজ এই পুরো কাঁঠাল তোমাগো খাওন লাগবো।
আব্বা হাসি হাসি মুখ নিয়ে আমাদের কাঁঠাল খাওয়া দেখছে। আমরা তিনবোন প্রায় অর্ধেক কাঁঠাল খেয়ে ফেলেছি কিন্তু আব্বা একটা খোয়াও মুখে দেননি। তাকে ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে। খুশিতে তার চোখ দুটো চিক চিক করছে। এক সময় আমি আর বিথি আর খাব না বলে উঠে যাচ্ছি তখন আব্বা বললেন, মা জননীরা কাঁঠাল খাওয়া শেষ হলে একটা কাঁচা বিচি খাইয়্যা নিবা এতে বদ হজম হইবো না।
বিলু এখনো খাচ্ছে আর আব্বা তার পাশে বসে আছে। কাঁঠাল আব্বারও ভীষণ প্রিয়। বিলুর চাইতেও প্রিয় কিন্তু বিলুর খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত একটা খোয়াও তিনি মুখে দিলেন না।
হ্যাঁ, আমরা বড় হয়েছি। আমাদের তিন বোনেরই বিয়ে হয়ে গেল। আব্বা মারা গেছেন তিন বছর হলো। আমরা তিন বোন্ সুখেই আছি। বিলু এখন সুদুর আমেরিকায় স্বামীর সাথে। বিথি খুব নাম করা ডাক্তার আর আমি স্বামী সংসার নিয়ে সুখেই আছি। এখন কেনজানি কাঁঠাল দেখলে বুকের ভেতর চিন চিন করে উঠে। চিন চিন করা বুক নিয়ে আমি কাঁঠালের দিকে তাকিয়ে থাকি। আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে আমরা তিন বোন কেউই আর কাঁঠাল খেতে পারি না। কাঁঠাল দেখলেই আমার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। খুব ইচ্ছে করে একটু ছুঁয়ে দেখি। অথচ একটুও খেতে ইচ্ছে করে না। আব্বার হাতে ভাঙ্গা কাঁঠাল ছাড়া আমার সত্যিই খেতে ইচ্ছে করে না।
এখন বুঝতে পারি। আর বুঝতে পারি বলেই বুকের ভেতরটা কান্না জমতে থাকে। আব্বা ছোট একটা চাকরি করে আমাদের পড়ালেখা করিয়েছেন। নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও আব্বা চাইতেন তার মেয়েগুলো খুশি থাকুক, সুখে থাকুক। আব্বার নিয়ে আসা সামান্য একটা কাঁঠাল আমাদের কাছে ছিলো বিশাল কিছু। এই বিশালতার কারণ ছিলো আব্বা। আব্বার ভালোবাসার এই বিশালতা আমাদের কখনো বুঝতে দেয়নি না পাওয়ার কষ্ট। মধ্যবিত্তের টানাটানির সংসারে সন্তানের হাসি দেখে একজন বাবার চিক চিক করা চোখের জল যেন ভালোবাসার আশ্রয়। এটাই যে মধ্যবিত্তের শক্তি, মধ্যবিত্তের অবলম্বন।