মেহেরুন্নেসা বেগম আজ সকাল থেকেই বেজায় খুশী, আজ উনি তার ছেলের বাসায় বেড়াতে যাবেন। তাই সকালে উঠেই গোসল করে নীল রঙের টাঙ্গাইল শাড়ীটা পরেছেন, হাতে দু’গাছি চুড়ি আর কানে মুক্তার দুল। গয়না বলতে এই তার সম্বল। মেহেরুন্নেসা বেগমের গায়ের রঙ টকটকে ফরসা, গোলগাল মুখ আর পান খেয়ে ঠোঁট দুটো লাল করে রাখেন।
মেহেরুননেসা বেগমের ছেলে বড় ইন্জিনিয়ার, এই ছেলে তার অতি আদরের ধন। তিন মেয়ের পর অনেক মানত, দোয়া কালাম, পানি পড়া আর কলা পড়া খেয়ে তার পুত্রলাভ। এই ছেলে তাই তার চোখের মনি। উনার সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে এই ছিল সবচেয়ে ন্যাওটা, মাকে ছাড়া চলতোই না। আজমল সাহেব, তার সবামী সরকারী চাকরী করতেন, সীমিত বেতন, সংসারে টানাটানি লেগেই থাকতো। মেয়েদের পাতে মাছ মাংস তুলে দিতে না পারলেও, রফিকের পাতে মাছের মুড়োটা অথবা মুরগীর ভালো টুকরোটা তুলে দিতেন। কারন এই ছেলেরাইতো বুড়ো বয়সে তাদের স্বামী-স্ত্রীর আশ্রয় হবে, মেয়েরাতো পরের বাড়ি চলে যাবে। তার ছেলে রফিক লেখাপড়াতেও ছিল তুখোড়, ম্যাট্রিক আর ইনটারমিডিয়েটে সট্যান্ড করে বুয়েটে ভর্তি হয়। পাশ করার পর বড় চাকরী পেয়েছে।
মেহেরুন্নেসা বেগমের সব ছেলে মেয়েরাই এখন প্রতিষ্ঠিত, তিনি এখন বড় মেয়ের বাসায় চিকিৎসার জন্য এসেছেন। কিন্তু তার মন পোড়ে ছেলের জন্য। কয়েকবারই মেয়ে আর নাতি-নাতনিদের দিয়ে ফোন করিয়েছেন কিন্তু ছেলে তার ভীষন ব্যস্ত। তাই আজ তিনি নিজেই গিয়ে ছেলেকে দেখে আসবেন। কয়েকপদের পিঠা বানিয়েছেন- পুলি, পাটিসাপ্টা, চিতই আর নারকেলের নাড়ু। ছেলেকে নিজের হাতে খাওয়াবেন। এখন নাতিটাকে রাজী করাতে হবে। কাল মেয়েকে বলার সাথে সাথে মেয়েতো রেগে আগুন
– মা, তোমার কি এখানে থাকতে কোন অসুবিধা হচ্ছে? রফিকের সময় হলে ও নিজেই আসবে। তিনি সুমনের ঘরে উকি দিয়ে দেখলেন সুমন তৈরী হচ্ছে, নাতীটা তার খুবই লক্ষী, নিশচয় নানীর কথা ফেলবে না। মেয়ে স্বাইরে গেছে, মেহেরুন্নেসা বেগম এই ফাকে ছেলের বাড়ী চলে যাবেন। মেয়ের বাড়ীতে এতদিন থাকতে কি ভালো লাগে? মানুষ কি বলবে? তিনি রাহেলা বুয়াকে বলেন,
– শুনেছ রাহেলা, আমি আমার ছেলের বাসায় যাচ্ছি, দুপুরে আর রাতে খাবো না।
– ক্যান নানী কয়েকদিন থাকবেন নি?
– হ্যা জানো তো আমার ছেলেটা যা পাগল, আমাকে হয়তো আসতেই দেবে না। আর নাতনীটাও তো আছে।
সুমন ভাবলো ভালো ঝামেলায় পড়া গেল! আজ স্যারের বাসায় পড়া শেষে রিয়ার সাথে পিজা হাটে যাওয়ার কথা। এখন নানু বুড়ি আবার বায়না ধরেছে ছেলের বাসায় যাবে কি যন্ত্রনা। কিন্তু নানুকে সুমন অনেক ভালোবাসে তাই সে নাও করতে পারেনি। যাহোক সে তো শুধু নামিয়েই দিবে।
সুমন নানু আর তার পোটলা- পাটলি নিয়ে একটা সিএনজিতে উঠে। মামার বাসা চারতলায়, সুমন নানুকে ধরে ধরে উঠায় । মেহেরুন্নেসা বেগমের হাফ ধরে যায়। দরজায় নক করতেই রফিক দরজা খুলে। সামনে বাক্স পেটরাসহ মাকে দেখে তো তার চক্ষু চড়কগাছ। আজ শনিবার ছুটির দিন, রফিকের নীলা আর মেয়েকে নিয়ে শহরের বাইরে যাওয়ার প্ল্যান। মেহেরুন্নেসা ছেলেকে দেখে জড়িয়ে ধরতে গেলেন কিন্তু ছেলের মুখ অন্ধকার।
– মা তুমি হঠাৎ করে চলে আসলে বলা নেই কওয়া নেই! আর সুমন তুই তো একটা ফোন করতে পারতি?
– বাবা, আমি ওকে নিয়ে এসেছি। ও তো পড়তে যাবে আমাকে নামিয়ে দিয়ে।
– তার মানে ও চলে গেলে তুমি কার সাথে যাবে?
– আমি তো আজ সারাদিন তোদের সাথে আর আপুমনির সাথে থাকবো বলে এসেছি বাবা।
– তা কি করে সম্ভব? আমাদের আজকে পিকনিকে যেতে হবে।
– তোরা তোদের মতো যা বাবা আমি থাকি কোনো অসুবিধা নেই।
সুমনের আর সহ্য হলো না এই অপমান। ও মেহেরুন্নেসা বেগমকে বুঝিয়ে বলে ওখানে না থাকার জন্য। এদিকে রফিকের মেয়েটা এসে দাদুকে টানাটানি করে ভিতরে নিয়ে যেতে চায়। রফিকের স্ত্রী এসে বলে,
– রফিক, তুমি একাই যাও, আমি নাহয় থাকি।
– না, শীলা তুমি ছাড়া আমি কি করে যাই? মা আরেকদিন আসবে, এটা কোন ব্যাপার না।
মেহেরুন্নেসা বেগম যেন লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছেন। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না! তিনি এই ছেলেকে পেটে ধরেছেন? ছেলের অসুখ হলে সারারাত জেগেছেন? সুমনের সাথে তিনি সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলেন, শত চেষ্টা করেও চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। সুমন নানুর চোখ মুছিয়ে বলে,
– নানু চলো আজ তোমাকে আমি বেড়াতে নিয়ে যাবো, তুমি আমার ডেট।
– সেইটা আবার কি?
– গেলেই দেখতে পাবে।
– কিন্তু তোর পড়া?
– একদিন না পড়লে কিছু হবে না, তাছাড়া মামার মতো এত বড় ইনজিনিয়ার হতেও চাই না আমি। মেহেরুন্নেসা বেগমের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।