নিশু আজ আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। পাঁচ বছরের বৈবাহিক সম্পর্কের সবকিছু আজ শেষ হয়ে যাবে একটু পরে। এখন সকাল আটটা বাজে। দুপুর বারোটায় তার ট্রেন।একটু পরেই তাকে আমি গাড়ি করে স্টেশন অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসবো।মা অবশ্য বলেছেন,’বেগানা নারীকে নিজের গাড়ি করে দিয়ে আসার কী দরকার?’ আমি বড় অবাক হয়ে বললাম,’আমার স্ত্রীকে আমি দিয়ে আসতে পারবো না!’ ‘না পারবে না। কারণ একটু পর সে তোমার স্ত্রী থাকবে না। তুমি তাকে তালাক দিবে।’ ‘তালাক!’
শব্দটা আমার ভেতর ঝড়ের তান্ডব চালালো। আমি বললাম,’না মা না,আমি এটা কখনো করবো না। কখনোই না।’
কিন্তু শব্দ করে মাকে শুনিয়ে বলতে পারলাম না। কারণ এখন শুনিয়ে বললেও কোন লাভ হবে না।এ বাড়ির সর্বে সর্বা আমার মাই।বাবাও তার কথার বউ।মা যদি বাবাকে বলেন, সারাদিন এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকো এখানে।বাবা ঠিক এক পায়েই দাঁড়িয়েই থাকবেন। কেয়ামত হলেও নড়বেন না। এমন মার মুখের উপর কথা বললে বিপদ আছে আমার।ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিবেন তিনি। যদিও মার কাছে আমি অনেক মূল্যবান সম্পদ।তার একমাত্র ছেলে আমি।সন্তানও আমি একমাত্র।মা আমায় ভালোবাসেন। খুব ভালোবাসেন। কিন্তু এটা কখনোই ভালোবাসেন না যে তার পুত্র নিঃসন্তান থাকবে।
সমস্যাটা আমার না নিশুর বোঝা যাচ্ছে না। ডাক্তার কবিরাজ দেখানো হয়েছে। তারা নিশুর ঘাড়েই বার বার দোষ চাপাচ্ছে।গত মাসে দেশের শীর্ষ ডাক্তার দেখানো হলো।মাও সাথে গিয়েছিলেন। তখন ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললো,নিশুর সমস্যা।মা খবর শুনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।যে মেয়ে বন্ধ্যা সে অলক্ষ্মী হয়।ওর জন্য ঘরের অমঙ্গল হয়। বিপদ আপদ আসে।আয় উন্নতি হয় না।মার কথা পরিষ্কার। তিনি ফেরার সময় রাস্তায়ই আমার কাছে বললেন,’বাদল, শিশুকে তোমার ছেড়ে দিতে হবে।’ আমি অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলেছিলাম,’ফান করছো না?’
‘বাদল, তোমার মা কখনো ফান করে কথা বলে না।যা বলছি তা শুনে রাখো। কদিন পরই তুমি তাকে তালাক দিবে।অপয়া অলক্ষ্মী মেয়ে ঘরে রেখে আমার ঘর আমি অপবিত্র করবো না। আমার প্রয়োজন লক্ষ্মী মেয়ের।যে মেয়ে ঘরে আসলেই ঘর স্বর্গের মতো আলোকিত হবে।মেশকের ঘ্রান ছড়াবে।ধন দৌলতে ভরে থাকবে সিন্দুক। আমি তোমাকে আবার বিয়ে করাবো।ডিসিশন ফাইনাল।’ ‘কখনোই না। কখনোই না। আমি মানবো না মা।’ মা আমায় ধমক দিয়েছিলেন।রাস্কেলের মতন কথা বলবা না।ঘাড় ধাক্কা দিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেবো।’
আমি চুপ হয়ে গেলাম। কিন্তু গাড়িতে পেছনের সিটে যে বসেছিল নিশু সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।মা তাকে ধমক দিয়ে থামালেন। তারপর বললেন,’ন্যাকামো করবানা মেয়ে।একদম ন্যাকামো করবা না। অলক্ষ্মী কোথাকার!’
নিশু ভয়ে তৎক্ষণাৎ কান্না থামিয়ে দিয়েছিল। সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকেই নিশু কাঁদে। কাঁদে আর কাঁদে।কী সুন্দর চেহারা ছিল তার। চোখ দুটো যেন জোড়া সরু নদী ছিল।তাকালে আর চোখ ফেরানো যেতো না কক্ষনো। সেই চোখের জোড়া নদী এখন ভেঙে একাকার হয়ে গেছে। চোখের বাইরে শুধু জলের ধারা।শরীর কেমন শুকিয়ে কাঁঠ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। একদিন রাত দুপুরে নিশু আমায় বললো,’তুমি আমায় ছেড়ে থাকতে পারবে?’
শুনে আমার কান্না এসে গেল। চোখের জল মুছে ভেজা গলায় বললাম,’পারবো না নিশু।’ ‘তোমার জন্য তো মা আরো ভালো কাউকে আনবেন!’ ‘আমি আর কাউকেই মেনে নিতে পারবো না। আমি শুধু তোমার।তোমায় ছাড়া অন্য কারো হতে পারবো না আমি।’ ‘ভালোবাসো না আমায়?’ ‘ভালোবাসি। প্রচন্ড ভালোবাসি।’ নিশু কাঁদছে। কড়াইয়ের গরম তেলে ডিমটা ভেঙে ছেড়ে দিতে দিতে তার চোখ মুচছে হাতের কনুই দিয়ে। আমি কাছে গিয়ে বললাম,’নিশু,এই নিশু কাঁদছো কেন?’ নিশু এবার কান্নারত গলায়ই বললো,’আমার রান্না ছাড়া যে তোমার চলেই না আমি চলে গেলে তোমায় কে রান্না করে দিবে!’
আমি চুপ হয়ে গেলাম। ভাবছি আরেকটি কথাও। আমার যে খাবারে অনীহা। খেতে খুব আলসেমিও করি। কিন্তু নিশু তা করতে দেয়না। বিছানায় এসে প্লেট ভর্তি ভাত শালুন মাখিয়ে নিজ হাতেই বেশিরভাগ সময় খাইয়ে দেয় আমায়।না খেতে চাইলে কান ধরে টেনে বলে,’না খেলে কান টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।’ আরেকটা বিষয়েও আমার খুব গাফলতি আছে। ফজরের নামাজের সময় ঘুম ছাড়ে না। এই সময় নিশু কত কায়দা করে যে আমার ঘুম ভাঙায় !এসব কাইদা আর কে জানবে জগতের?
আমার মুখ ফুটে কোন কথায় বেরিয়ে আসছে না। আমি শুধু নিশুর দিকে তাকিয়ে আছি। ওর জল শ্রাবণের এক জোড়া নদী দেখছি । এই জোড়া নদী ছাড়া যে আমি কিছুতেই বাঁচবো না। সময় খুব দ্রুত চলে যায়। এখন সকাল দশটা বাজে।নিশু তার সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছে।আজ আর অত সাজসজ্জা করেনি সে। প্রতি শুক্রবারে যেমন করে সাজে সে ঠিক তেমনই সেজেছে।কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি আর দু হাতে দু জোড়া করে সাদা কাঁচের স্বচ্ছ চুড়ি।কম সাজার কারণেই বোধহয় তাকে অন্য রকম এবং একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। এখন শুধু একটা নীল টিপ যদি কপালে পড়তো তবে আর তার কোন অপূর্ণতা থাকতো না।
না ভুল বলছি আমি।ওর যে অপূর্ণতাই ভরা।আজ এই অপূর্ণতা নিয়েই তো সে আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে! মা এসে তাড়া দিলেন আমাদের।গাড়ি রেডি।মা দুজনকেই বললেন,’তোমরা কিন্তু এখন থেকে একে অপরের অপর। বেগানা নারী পুরুষ। রাস্তায় কেউ কারো সাথে কোন রকম কথা বলতে পারবা না!’ নিশু আবার কেঁদে উঠেছে।মা বললেন,’কেঁদে লাভ নাই।এই বাদল, ওকে তিন তালাক বলে দে তুই।’ আমি খানিক চিন্তা করে বললাম,’এটা তো গতরাতেই বলে দিয়েছি আমি।’ ‘চুপ কর বদমাশ। বাহানা করছিস।আমার সামনে আরেকবার বল।’ ‘আমি দুবার বলতে পারি নে এসব। একবার বলছি হয়নি?’
মা হেসে বললেন,’রাগ করিস নে বাপু,তোর মঙ্গলের জন্যই তো এসব করছি।যা এবার ওকে স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আয়।’ আমি মার সাথে আর কোন কথা বললাম না। নিশু শুধু তার কান্না থামিয়ে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো। গাড়ি চলছে। মিনিট বিশেক লাগবে স্টেশনে যেতে।নিশু হঠাৎ আমায় বললো,’তুমি মার কাছে মিথ্যে বললে কেন?’ ‘মিথ্যে নয় সত্যি বলেছি।’ নিশু অবাক হয়ে বললো,’কই আমি তো শুনিনি। কখন বললে?’ ‘তুমি তখন ঘুমে।’ ‘ঘুমে থেকে কী কেউ শুনে?না শুনিয়ে বললে তো তালাক হয় না।’ আমি বললাম,’এসব আমি জানি না। আমি বলে দিয়েছি ব্যাস!’ নিশু আবার কেঁদে উঠেছে হাউমাউ করে।ওর দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছি আমি।কী নিষ্পাপ একটা মেয়ে। এমন একটা মেয়ের সাথে আমার মা এমন নিঠুর ব্যবহার করতে পারলো!
ট্রেন এসে গেছে। পাঁচ মিনিট পর স্টেশন ছেড়ে যাবে।যাত্রীরা হুড়মুড় করে গাড়িতে উঠছে। টিকিট করছে। আমিও টিকিট করে নিয়েছি।একটা টিকিট নিশুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম,’সাবধানে যেও। বাসায় গিয়ে আমায় জানাবে কিন্তু।’ নিশু কাঁদছে। খুব করে কাঁদছে।ট্রেনে উঠার আগে একবার আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর কপালে আলতো চুমু এঁকে বললো,’ভালো থাকবে।’ আমি বললাম,’ভালো থাকবো।’ ট্রেনের হুইসেল দিয়েছে। নিশু বললো,’যাই!’ আমি বললাম,’হুম।টা-টা।’ নিশু চোখ মুছতে মুছতে ট্রেনের কামরায় উঠে গেলো। চলন্ত ট্রেনে হুট করে তার পাশের সিটে আমায় বসতে দেখে নিশু চমকে উঠলো। অবশ্য তখনও সে কাঁদছিল।আমায় দেখে কান্না থামিয়ে বললো,’তুমি!’ আমি হেসে বললাম,’হুম আমি।’ ‘কোথায় যাবে তুমি?’ ‘তোমার সাথেই যাবো।’
‘আমার সাথে! তুমি না আমায় তালাক দিয়েছো?’ আমি হু হু করে হেসে উঠে বললাম,’মিথ্যে বলেছিলাম।মার কাছ থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যে।আসলে তোমায় ছাড়া কী করে বাঁচতাম আমি।তাই চলে এসেছি সব ছেড়ে ছুড়ে। এবার দুজন গিয়ে দূরে কোথাও একটা ছোট্ট ঘর বাঁধবো। যেখানে সুখ আর সুখ থাকবে।’ নিশু রাগত স্বরে বললো,’মা বাবাকে ছেড়ে আসা তোমার মুটেও উচিত হয়নি!’ আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম,’দেখো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।মা তার ভুল বুঝবে। সেদিন আমাদের পাগলের মতো খুঁজবে।আর তখনই আমরা তার কাছে যাবো।’
নিশু কোন কথা বললো না। শুধু বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। প্রায় ছ’বছর পর বাড়ি যাচ্ছি আমরা। যাচ্ছি নিজ বাড়ি।যে ট্রেনে করে এসেছিলাম ঠিক সে ট্রেনেই।সব কিছু আগের মতোই আছে কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু নিশুর কোলের মেয়েটা।হ্যা এটা অদ্ভুত হওয়ার মতো একটা বিষয়। মাঝেমধ্যে আল্লাহ এমন কিছু কান্ড করেই বসেন।আমরা ঢাকা যাওয়ার পরেও অনেক ডাক্তারের চেম্বারে চেম্বারে দৌড়িয়েছি।পয়সা জোগাড় করে ভারতেও গিয়েছিলাম একবার।বড় বড় সব ডাক্তার দেখিয়েও কোন ফল পাইনি।ওরা বললো,’আমরা নিরুপায়। আপনার ওয়াইফ কোনদিন বাচ্চার মা হতে পারবে না।’
কিন্তু সবচে বড় ডাক্তার যিনি তিনি তো আর এ কথা বলতে পারেন না যে,’আমি নিরুপায়!’ আমরা কেঁদেছিলাম খুব। গভীর রাতে দুজন একসাথে সিজদায় পড়ে চোখের জলে আল্লাহর কুদরতি পা ভাসিয়ে বলেছিলাম,’ফিরিয়ে দিলে আর পা ছাড়বো না বলছি!’ আল্লাহ আমাদের ফিরাতে পারেননি।নিশুর কোল জুড়ে এসেছে ফুটফুটে এক মেয়ে।মেয়ের নাম ফেরা। ওকে নিয়ে বাড়িতে ফিরবো বলেই নাম দিয়েছিলাম ফেরা। ফেরাকে নিয়ে আজ বাড়ি ফিরছি আমরা।দেখি সে তার দাদুর মন গলাতে পারে কি না!