এই আকাশে ভীষণ মেঘ করেছে

এই আকাশে ভীষণ মেঘ করেছে

সেদিন টিউশনি শেষ করে আসার সময় ছাত্রের লজ্জাবতী বোনের হাতে ‘বেতন’ চেয়ে চিরকুট’টা দিয়ে আমি নিজেই ঘাবড়ে যাই।মেয়েটা রোজ রোজ পর্দার আড়ালে সেজেগুজে দাড়িয়ে থাকতো,আর আমারও কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগতো,তাই মুখ ফুটে টাকা’টা চাইতে পারিনি,একরকম বাধ্য হয়েই চিরকুটটা দিতে হলো।

দুইদিন পড়াতে যাইনি,পথে ছাত্রের সাথে দেখা হতেই সে বললো ‘স্যার,আপু বলেছে আপনাকে খুন করবে,কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দিবে। ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়ে গেলো, এক মাসের বেতন বাকি সেটাও হয়তো গেলো ।

বেতনের আশায় ছাত্রের বাসার সামনে যেতেই আমি ধরা পড়ে যাই ।ছাত্রের বোন অরুনা কলেজ থেকে আসতেছে, পালিয়ে যাবো ভেবেও পালাতে পারিনি। কি অদ্ভুত! এই মেয়েটার সামনে বারবারই আমি কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে যাই।আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি,অরুনা কাছে এস খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো’বাসায় আসুন’। আমি তার পিছন পিছন ভেতরে যাই, ছাত্রও আগের মতো পড়তে আসলো, একটু পর অরুনা এসে একটা খাম দিয়ে বলে আপনার বেতন,আমি ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসি।

বাসায় এসে খাম খুলে দেখি দুই মাসের বেতন, সাথে একটা চিরকুট। চিরকুটে লিখা ‘কাল সকাল দশটায় বাসার নিচে থাকবেন’।

ভয়েভয়ে উপস্থিত হই,অরুনা এসে বলে চলেন রাস্তার ওপাশে যাবো,রাস্তা পার হওয়ার সময় সামান্য একটা মাইক্রোবাস দেখে ও চিৎকার করে আমার শার্টের কলার খামচি দিয়ে ধরলো,হয়তো ঘাড় থেকে খানিকটা মাংস উঠে গেছে,ঘাড়ের উপর দিকে জ্বলছে খুব।আচ্ছা,এমনটা কি ও ইচ্ছে করে করেছে? ধূর,এসব কি ভাবছি!

সারাদিন অরুনার সাথে ঘুরাঘুরি করলাম, সে নিজের জন্য অনেককিছু কিনলো,তবে সবি আমার পছন্দের। শেষে আমাকে একটা পাঞ্জাবী কিনে দিয়ে বললো ‘কাল সন্ধ্যায় এটা পরে আসবেন, প্লিজ। আমি জি আচ্ছা বলে সম্মতি জানাই । হঠাত লক্ষ্য করলাম অরুনা কাঁদছে,তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে,আমি তখনো বুঝতে পারিনি ও কেনো কাঁদছে।

পরেরদিন সন্ধ্যায় ওদের বাড়িতে যাই,হয়তো কোনো অনুষ্ঠান,বাড়ি ভর্তি মানুষ,ও আচ্ছা,আজ তাহলে অরুনার জন্মদিন,আর আমি একদম খালি হাতে,ফিরে গিয়ে কি কিছু আনবো? চিন্তা করতে করতে অরুনাকে দেখতে পাই,ও কাল কিনে দেওয়া লাল শাড়িটা পরে আসছে,ওকে যে কি সুন্দরী লাগছে! এমন সুন্দরী মেয়েকে রেখে কিছু কিনতে যাওয়া ঠিক হবেনা,একদম না।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে অরুনা আমার পাশে এসে দাঁড়ালো বুঝতেই পারিনি, অরুনা বিরবির করে কি যেনো বলতে লাগলো, কথাগুলো একটু অস্পষ্ট তবুও কিছুটা বুঝতে পারলাম,তার বিরবির করে বলা কথাগুলো ঠিক এই রকম “ছাত্রের বোনের দিকে কেউ এমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নাকি, মানুষ কি মনে করবে?

আমি কিছু বলার আগেই অরুনা বললো,দাঁড়িয়ে আছেন কেনো,চেয়ারে গিয়ে বসুন,আমি তার কথা মতো চেয়ারে বসতে যাই, এমন সময় অরুনা আমাকে অবাক করে দিয়ে সবার সামনে টেনে ধরে চমকে গিয়ে বললো “ঘাড়ে কি হলো আপনার, মাংস উঠে রক্তাত্ত হয়ে আছে যে!”

আমি সম্পূর্ন ঘাবড়ে যাই, এতো এতো মানুষের সামনে ও আমাকে এমন করে বকা দিচ্ছে,সবাই তাকিয়ে আছে,তবুও অরুনা এক নিশ্বাসে বলতেই লাগলো “নিজের প্রতি একটু খেয়াল রাখা যায়না,ডাক্তারের কাছে তো যাওয়ার দরকার নেই,একবার ওয়াশ তো দূরের কথা,একটা ওষুধ ও খাওয়ার প্রয়োজনও মনে করেন নি,এইসব ফালতু লোক দিয়ে কিচ্ছু হবেনা,কিচ্ছু না”

আমি বারবার বলতে যাই,দেখো আমার কিচ্ছু হয়নি,এটা ঠিক হয়ে যাবে এমনিতেই,কে শুনে কার কথা,ও আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ডাক্তারের কাছে,বাসার সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে,কেউ কিছু বলছেনা,আমি অনেকটা ঘাবড়ে যাই,অরুনার বাবা আমার দিয়ে তাকিয়ে আছে, আত্মীয়স্বজন সবাই অবাক দৃষ্টিতে অরুনার কর্মকান্ড দেখছে।

বাসা থেকে বের হয়ে অরুনা একটা রিক্সা নিলো,আমরা বাংলাদেশ মেডিকেলের দিকে যাচ্ছি,ওকে কি বলবো কিংবা কি জিজ্ঞাসা করবো বুঝতে পারছিনা,ও খুব বিরবির করছে রাগে,আর আমাকে বকা দিয়েই যাচ্ছে,এতো সুন্দর একটা মেয়ে শাড়ি পড়ে এমন করে বকা দিতে পারে তা কখনো চিন্তাও করিনি,মনে মনে ভাবছি ‘আচ্ছা অরুনা কেনো পাগলামি করছে? ও কি তাহলে আমাকে ভালোবাসে, কখনো তো বলেনি,নাকি অন্য কিছু?’

অরুনার তৃষ্ণা পায়,আমি রিক্সা থামিয়ে পানি কিনে নিই,সাথে একটা আইসক্রিম ও,ভাবলাম এতে যদি খুশি হয়ে বকা দেওয়াটা বন্ধ করে আইসক্রিমটা খায়,আইসক্রিম দেওয়াতে অরুনা আরো জোরে বোকা দিয়ে উঠলো “আমাকে আইসক্রিম খেতে আপনি কখনো দেখেছেন? আমি বলেছি আমি আইসক্রিম খাবো? কথাগুলো বলতে বলতে অরুনা আইসক্রিমটা খেতে লাগলো,একটু পর আমার দিকে তাকিয়ে বলছে,এমন করে তাকিয়ে আছেন কেনো?প্রতিদিন পড়াতে আসলে কাশি দিতে থাকেন,আপনার আইসক্রিম খেতে হবেনা। আমি অবাক হইনি,এখানে অবাক হলে খুব বেশি পাপ হয়ে যাব।

যাইহোক, পকেটে সামান্য কিছু টাকা ছিলো, তার অর্ধেক চলে গেলো ডাক্তারের ভিজিট দেওয়াতে,যেখানে ১০ টাকার ওষুধ খেলেই হতো,সেখানে ওষুধ আর ভিজিট সহ ৭০০টাকা শেষ,মাসের শুরুতেই এতো বড় অংকের টাকা খরচ করা একদম ঠিক হয়নি,কিভাবে চলবো সেটাই ভাবছি,যদিও এমন সুন্দরী একটা মেয়ের পাশে বসে এসব ভাবতে নেই,এই পাপ ক্ষমার অযোগ্য।

ওষুধ কিনে অরুনা আমাকে ওষুধ খাওয়ালো,দোকানে দাঁড়িয়ে ক্রিমটাও ঘাড়ে লাগিয়ে দিলো,তারপর আবার রিক্সা, আমরা কোথায় যাচ্ছি অরুনার কাছে জানতে চাইলাম’ওর কন্ঠ শীতল হয়ে আসলো,ও কান্না করতেছে,নরম কন্ঠে বললো আমার সাথে যেতে সমস্যা হলে কিংবা ভয় করলে নেমে যান,যেতে হবেনা,এই কথা বলে ও তার শাড়ির আঁচলের খানিকটা আমার ঘাড়ের উপর দিয়ে বললো, ক্ষততে ধূলাবালি পড়বে।

অরুনা কাঁদছে,তার চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়ছে,এতো সুন্দর একটা মেয়ের কান্না আমার একদম সহ্য হয়না,একদম না,তবুও চুপচাপ ওর পাশেই বসে আছি,কিছুসময় পর অরুনা বললো আপনি কাঁদছেন যে?আমিও অবাক হয়ে খেয়াল করলাম,সত্যিই তো,আমার চোখেও জল।

রিক্সায় অরুনার চুলগুলো উড়ে যাচ্ছে,চোখের কাজলগুলো একটু নিচে নেমে লেপ্টে গেছে,অসম্ভব সুন্দরী লাগছে ওকে,মনের ভেতর থেকে কেউ বলছে,বিক্সায় অরুনার পাশের সিটটা যেনো সারাজীবনের জন্য আমার করে নিই,কিন্তু মুখে বলার সাহসটুকু হয়নি।

যাইহোক,অরুনাদের বাসা চলে আসলো,বাড়ির সবাই কেমন যেনো বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে,কিছু বুঝে উঠার আগেই অরুনার এক বান্ধুবী এসে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,তাড়াতাড়ি আসো,সাজ নষ্ট হয়ে গেলো,আবার সাজতে হবে।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অরুনার চলে যাওয়া দেখছি,কেনো যেনো আমার এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব ইচ্ছে করছে,অরুনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেই ইচ্ছে আর স্থায়ী হলোনা,অরুনার বাবা পাশে এসে বললো,আজ চলে যাও,কাল আসিও। আমি ভদ্র ছেলের মতো প্রস্থান করিলাম।

মেসের রুমটায় আজ খুব হাসপাস লাগছে,কেমন যেনো দমবন্ধ লাগছে,কিছুতেই ঘুম আসছে না,উঠে ছাদে গিয়ে কিছুক্ষন হাঁটাহাটি করলাম। রুমে এসে দেখি,ফোনে অরুনার ম্যাসেজ,’কাল বিকালে একবার স্টেশনে আসবেন?’ ম্যাসেজটা দেখে আমার নিশ্বাস দীর্ঘ হতে লাগলো,বেশ কয়েকবার ঘড়ির দিকে তাকালাম,কিছুতেই সময় যাচ্ছে না,তখনও ছিলো রাত বারোটা বেজে ১২ মিনিট,এখনো তাই।

সারারাত ঘুমাতে পারিনি,সকালে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম,এদিকে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেলো,দরজার টুংটাং শব্দে হুট করে ঘুমটা ভেঙে গেলো,উঠে দেখি দরজার ওপাশে কেউ নেই,তাহলে কে শব্দ করলো?

তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হয়ে ছুটলাম স্টেশনের দিকে,এতোক্ষনে হয়তো অরুনা চলে আসলো,এই লোকাল বাসের ভিড়ে একটা ছেলে বকুলের মালা নিয়ে আসলো,তার থেকে একটা মালা আমিও বুক পকেটে তুলে নিই,স্টেশনে পৌঁছে দেখি অরুনা নীল শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে,একটু দূরে ওর বাবা মা বসা। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে অরুনার দিকে ফুলের মালাটা বাড়িয়ে দিই,অরুনা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,’খোঁপায় পরিয়ে দিবেনা?’

আমি অরুনার খোঁপায় ফুলের মালাটা পরিয়ে দিতে দিতে জানতে চাইলাম,তোমরা কোথায় যাচ্ছ? অরুনা বেশ কিছুটা সময় চুপ করে থাকে,পরে চোখের জল মুছে বলে,যেখানে গেলে হয়তো আর কখনো ফিরে আসা যায়না। এদিকে ট্রেন চলে আসলো,আমার দীর্ঘশ্বাস গাড় হতে লাগলো,অভিমান করে বললাম,বলবেনা কোথায় যাচ্ছ? অরুনা বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিয়ে বললো,বাবা বলেছে তার পছন্দের ছেলেটাকে বিয়ে না করলে তিনি আত্মহত্যা করবেন,তুমি ভালো থেকো,কষ্ট হলেও।

আমি অরুনার চলে যাওয়া দেখছি,অরুনা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে ট্রেনে উঠলো,আমার খুব ইচ্ছে করলো চিৎকার করে বলি,ভালোবাসি,ভালোবাসি। তার আগেই ট্রেনটা ছেড়ে দিলো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত