আমি মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত

আমি মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত

-ঘরে কিন্তু চাল নেই। অন্য বাজারও নেই।
– বলো কি? আর সপ্তাহ খানেক চালাও। আমার হাত একেবারে খালি।
-আমি কি কম হিসেব করে চলি? আর একদিনও চালানো সম্ভব না। ছেলেটার কেমন অবস্থা হয়েছে না খেয়ে না খেয়ে। এখন তাকানো যায় না চেহারার দিকে।

আজ পনেরো দিন যাবৎ ডাল, আলু ভর্তা আর ভাজি দিয়ে চলছে। চার বছরের ছেলেটা ভাত মুখেই দিতে চায় না। সে আবার হয়েছে তার দাদার মতো নবাবজাদা। প্রতি বেলায় হয় মাছ নয় মাংস চাই। না পেলে একটা চিপ্সের প্যাকেট খেয়ে পুরো দিন পার করে দিতে পারবে। হাড্ডিসার শরীর। কিন্তু স্বভাবে তবুও নড়চড় নেই। মাছ মাংস কিনে আনলে তানিয়া আমার স্ত্রী, জমিয়ে রেখে চার টুকরো রান্না করে বেশিরভাগ সময় যার তিন টুকরো ছেলের জন্য তিন বেলার আর এক টুকরো মেয়ের জন্য। মেয়েটার বয়স আট বছর। বেশ বুঝদার হয়েছে। আমাদের মতো মাছ মাংসের ঝোল আর তরকারি দিয়ে খেয়ে উঠতে পারে। কোনো আব্দার নেই। ছোট ভাইয়ের মর্জি রক্ষায় সদা তৎপর।

ওর প্লেটে মাছ কিংবা মাংসের টুকরো দিলে বলবে – আম্মু তুমি এটা নিশানকে দিও। ও তাহলে পেট ভরে ভাত খেতে পারবে। তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবে। তখন আর তোমাকে মাছ মাংসের জন্য জ্বালাবে না। আমার মতো পিয়াজ মরিচের ভর্তা দিয়েও পেট ভরে খেতে পারবে। তোমার আর চিন্তা করা লাগবে না ওর খাবার নিয়ে।

আমাদের ঈশানা, এই বয়সেই আল্লাহ ওকে এতো বুঝ দিয়েছেন মাশাল্লাহ। নইলে কিভাবে চলতাম দুজন একই রকম হলে? এবার ক্লাস থ্রিতে উঠেছে। ফার্স্ট গার্ল ক্লাসের। বাইরের টিচার দিতে পারিনি ওর মা ই পড়ায়।

বউও আমার কখনো সাধ্যের বাইরে কিছু আব্দার করেনি। যখন যা দিয়েছি এক কথায় যা দিতে পেরেছি তাতেই সুখী। এককেজি তরকারিও দারুণ সাদ করে অর্ধেক রান্না করতো বাকি অর্ধেক রেখে দিত। আমাদের সল্প আয়ের সুখী সংসার বলা চলে।

গ্রামের বাড়িতে বাবা মা থাকেন বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য। কতোবার বলেছি চলে এসো একসাথে থাকি। যা জোটে তাই খাবো। কিন্তু না– মায়ের সেই এককথা, বাবা বাড়িতে কিছু ধান সব্জি হয়, কিছু গাছ পালা আছে, দুই চারটা হাঁস- মুরগী পালন করতে পারি, তারপর তোর বোন দুটো মাঝে মধ্যে বেড়াতে আসতে পারে এখানে। তোর কাছে সেই ঢাকায় গিয়ে পড়ে থাকলে ওদের মুখ তো আমি বছরেও দেখতে পারবো না। তারচেয়ে এইযে তুইও বউ মাকে, নাতি নাতনীকে নিয়ে আসিস মাঝে মাঝে এটাও তো আনন্দের। আমরা ভালোই আছি বাবা গ্রামে।

মায়ের কথার উপর আমি আর কথা বলতে পারি না।আসলেই তো ঠিক বলেছেন। একসাথে থাকতে গেলে বড় একটা বাসা নিতে হবে সে সামর্থ্যও তো আমার নেই। আমি প্রতি মাসে তাদের জন্য মাছ মাংস, ঔষধপত্র কেনার জন্য ৫ হাজার টাকা দেই। বাবা মা তাতে অনেক খুশি। আমি সামান্য বেতনে একটা এনজিওতে চাকরি করি। মোটামুটি ভালো থাকি ক’টা টিউশনি করিয়ে মাসে হাজার দশেক টাকা পাই বলে। নাহলে ১০ হাজার টাকা বাসাভাড়া দিয়ে এই অল্প বেতনের চাকরির টাকা দিয়ে আমার মতো আনোয়ারের এই ঢাকা শহরে থাকা সম্ভব ছিলো না। বিএ পাস করিয়েছেন বাবা মা অনেক কষ্ট করে। আমরা চার ভাইবোন ছিলাম। ছোট ভাইটা লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সে এক কষ্টের অধ্যায়। তখন বলতে গেলে সর্বস্বান্ত হয়ে যাই। কিন্তু ভাইটাকে বাঁচানো গেলো না।

তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি মাত্র ২০০২ সাল। আমাদের ছয় সদস্যের সংসার। ভাইয়ের চিকিৎসা খরচ মেটাতে বাবা জমি বিক্রি করে দিলেন তাতেও আমাদের অভাব ঘোঁচে নি। কঠিন দিন গেছে তখন আর আমার অনার্সে ভতিও বন্ধ হয়ে গেলো। আমি তখন শহরে একটা কাপরের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ শুরু করি। ধরেই নিয়েছিলাম আর লেখাপড়া করা হবে না। সেই দোকানে কাজ করেই চলছিল বড় সংসারে একটু জোড়াতালি দেয়ার কাজ। ২০০৪ সালে আমি উন্মুক্ত বিশবিদ্যালয়ে ভর্তি হই এবং বিএ পাশ করি। দশ সালে ফিল্ড অফিসার হিসেবে এই এনজিওতে যোগদান করে আজ এ পর্যন্ত আসছি। অভাব অনটন থাকলেও বলতে গেলে সুখেই আছি।

এখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সারাদেশে। চলছে ছুটি আর লকডাউন। সারাক্ষণ বাসায় থাকতে হয়। আমার টিউশনি বন্ধ হয়ে গেছে। গতমাসে বাবার চোখের ছানি অপারেশন হওয়ায় ১০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম। ভাবছিলাম এমাসে পুষে যাবে। কিন্তু একি হলো? বাসাভাড়ার টাকা দেয়ার পরে সামান্য বাজার করতে পেরেছিলাম। ডাল, ভাত, আলুভাজি, ভর্তা খেয়ে এতোদিন কাটলেও এখন কিভাবে কাটবে? এখন তো চাল কেনারই সামর্থ্য নেই। এনজিও’র সব লেনদেন বন্ধ হয়ে আছে, পরবর্তীতে চাকরি করা যাবে কি না তাও জানি না। বেতন পেতেও অনেক দেরি আছে কিভাবে চলবে দিন?

তিনটি মুখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চোখের লজ্জা ফেলে কার দিকে তাকাবো? কোনো ত্রাণের লাইনে গিয়ে দাঁড়াবো? আমার পেটে ক্ষুধা কিন্তু চোখে যে লাজ! কারণ আমি মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত