লকডাউনে ব্যাচেলরের আত্মকাহন

লকডাউনে ব্যাচেলরের আত্মকাহন

করোনার জন্য যখন সরকারী নির্দেশ আসলো ২৬তারিখ থেকে সব পরিবহন বন্ধ এবং সাধারন ছুটি ঘোষণা করা হয়।তখন অনেকেই কর্মক্ষেত্র ছেড়ে বাড়ির পথে পাড়ি জমায়।অনেকে অবশ্য অনেক আগেই চলে গেছে। আমারো অফিস ছুটি হয়ে যায় ২৬-৩০ মার্চ পর্যন্ত।মাসের শেষের দিক হওয়াতে হাতে টাকা খুব অল্প ছিল।তাই আমার আর বাড়ি ফেরা হলো না।ভেবেছিলাম বেতন পেলে বাড়ি যাবো।

আমাদের অফিস যেদিন বন্ধ হয়ে যাবে, সকলে বাড়ি যাওয়ার জন্য রেডি হয়েই অফিসে আসে।আমাদের বস এসব দেখে মনে মনে ব্যাধিত হলেও তার কিছুই করার ছিল না।অশ্রুসিক্ত চোখে সকলের উদ্দ্যেশ্যে বলে,আপনারা stay home করেন সাবধানে।আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল এই ভেবে যে কোম্পানি বন্ধ না হয়ে যায়। একদিনেই আমার ফ্লাট খালি হয়ে গেলো।পুরো ফ্লাটে খাঁ খাঁ শূন্যতা বিরাজমান।শুধু পড়ে রইলাম আমি। এমনিতেই পরিবহন বন্ধ তার ওপর হাতের অবস্থা ভালো না।লজ্জায় বাবাকে কিছু বলতেও পারছি না।আর এমনিতেও না যাওয়ার আরো একটা কারন ছিল।ওই শহরে অনেক খারাপ স্মৃতি জমে আছে।তাই ঢাকায় থাকাটাই নিরাপদ মনে করেছি।আমি নিজেও অনেকটা সতর্কতা অবলম্বন করেছি এবং ১০০%সুস্থ ছিলাম।আর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস তো ছিলই।

প্রথম রাত কেমন যেন লাগছিল।শুন্যতা যেন চারিদিক থেকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছে আমায়।হুমায়ুন আহমেদের একটা কথা বার বার মনে প্রতিধ্বনি হতে থাকে, “কিছু মানুষ আছে, যারা আসলেই আলাদা,তাদের সব থেকেও আসলে শূন্যতা ছাড়া কিছুই থাকে না।তারা একা আসে,একা ঘুরে,একাই থাকে, একাই চলে যায়।”আমার ক্ষেত্রেও হয়তো এমনি।তাই পরের দিন থেকে আমিই যেন আমার শক্তি।

রুমে কি করে সময় কাটতো জানেন? অফিসের ছুটি ক্রমাগত বেড়েই চলছিল।রাত আর দিন দুটোই সমান হতে থাকলো আমার জন্য।খাওয়া আর ঘুমের মাঝেই জীবন অতিবাহিত হতে থাকে।যখন তখন জোর করে নিজেকে ঘুম পাড়াতাম।সকাল ৫:৩০ এ উঠে নামাজ পড়ে আবার ঘুম দিতাম।তারপর উঠে দুইটা বিস্কুট খেতাম।নেটে টাইম পাস করতাম।কিন্তু কথা বলার কেউ ছিল না।রুমে টুকটাক কাজও করতাম।কিছুদিন পর এমন মনে হচ্ছিল যে আমি বোবা হয়ে যাচ্ছি।এদিকে হাতে যা টাকা ছিল শেষ।এবার কি খাবো??ফেক্সিলোডের দোকানো বন্ধ হয়ে যায়।

২৪ ঘন্টা রুমে বন্দি থেকে বুঝেছি বন্দি জীবন কতো কষ্টের।বুঝলাম পাখি কেন মুক্ত আকাশ চাই।মাঝে মাঝে বিকালে বেলকুনিতে গিয়ে বসতাম।বাইরে তাকিয়ে দেখতাম আশেপাশের অনেক ছাদে, বেলকুনিতে মানুষ বসে আছে।ছেলেমেয়েরা আড্ডা দিতো। এমন মনে হতো ওদের যেন ঈদ। এরমধ্যেই আমার খাওয়ার বেশ কষ্ট হতে থাকলো।কিছু দূরে আমার কাজিন এক বড় ভাই আর ওনার স্ত্রী থাকতো।ভাইয়া আমাকে তাদের সাথে খেতে বলে।এরপর কিছুদিন আর খাওয়ার কষ্ট হয় নি।ভাইয়ারা যেহেতু সাবলেটে থাকতো তাই তাদের বাসায় আমার আগমন অনেকেই মেনে নিতে পারে না।তখন ভাইয়া পড়লো মসিবতে।এমনিতেই ভাবি প্রেগন্যান্ট ছিল।তাই তাদের বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিলাম।তখন ভাইয়া আমার জন্য রাস্তায় খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।

এই কিছুদিন আগের কথা,আমি অফিস থেকে বেতন নিয়ে পায়ে হেটে বাসায় ফিরছি।রাস্তার একপ্রান্তে আমি আর অন্য প্রান্তে খাবার নিয়ে মানুষের কাড়াকাড়ি। তখন আমি ঢাকার রাস্তায় মানুষের ক্ষুদার হাহাকার দেখেছি নিজ চোখে।আমি আরো দেখেছি,না পাওয়ার বেদনা,নিষ্ঠুর বাস্তবতা,নিরব কান্না,কষ্টের অনুভূতি আর মুঠো ভাতের আত্মচিৎকার।খুব কষ্ট হচ্ছিল।ছিয়াত্তরের সেই ক্ষুদার আর্তনাদ যেন আবারও প্রতিফলিত হচ্ছে চোখের সামনে এমন মনে হচ্ছিল।

তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এখন থেকে এক বেলা খাবো।আর বাকিটা দিয়ে অসহায়দের সাহায্য করবো নিয়ত করলাম।পরেরদিন থেকেই রোজা রাখা শুরু করলাম যাতে ক্ষুধার্তদের সহায়তা করতে পারি।এরপর দিনে একজনকে একদিনের বাজার,সামান্য কিছু চাউল বা অসহায়দের সামনে পেলে যা পারতাম সাহায্য করতাম।আর নামাজ তো বেশ কিছুদিন আগে থেকেই নিয়মিত পড়া শুরু করেছি।সকলের জন্য দোয়া করা ছাড়া বিশেষ কিছু করার ক্ষমতা ছিল না আমার।

এভাবে বেশ কয়েকদিন কেটে যায়।বাবা মা খুব টেনশন করতো আমার জন্য।কেননা আমি তাদের একমাত্র ছেলে ।একদিন মাঝরাতে মা দুঃস্বপ্ন দেখে আমাকে ফোন দেয়।এতো রাতে মায়ের ফোন পেয়ে আমিও অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম,বাবার কিছু হয় নি তো?তারপর যখন ফোন রিসিভ করলাম ।আমার জন্য মায়ের চাপা কান্না আর কষ্টের অনুভূতি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম।অবশেষে মায়ের কান্না আর উপেক্ষা করতে পারলাম না।বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।পায়ে হেটে হলেও আমাকে বাড়ি যেতেই হবে।

গাড়ি তো ছিল না।তাই একটা এম্বুলেন্স ভাড়া করলাম ১০ই এপ্রিল।বিকাল ৫টাই ঢাকা থেকে রওনা দেয়।এম্বুলেন্স এ অল্প সংখ্যক মানুষ আর একজন রোগী থাকায় পুলিশ কিছুই বললো না।ফেরি পার হওয়ার আগে বৃষ্টি হওয়াতে রাস্তা ফাকা ছিল।আর সমস্যায় পড়তে হয় নি।বাড়িতে চলে এলাম।কিন্তু এখানে এসে যেন পরিবারের মস্ত বড় ক্ষতি করলাম।বাড়ি আসাতে গ্রামের মানুষ আরো বেশি শয়তানি শুরু করে।আমার আসাতে গ্রামের মানুষ আমাদের সাথে খুবই ঝামেলা করতে থাকে।আমাদের নিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করে।

তাদের অভিযোগ আমি নাকি বাইরে অবাধে ঘোরাঘুরি করি।যেখানে বাবা মায়ের সাথে তেমন ভাবে মিশছি না।কিন্তু তবুও তারা আমার বাবাকে জরুরি প্রয়োজনেও মাঠে বা বাজারে যেতে দিচ্ছে না।আমাদের একঘোরে করে রাখে।যেখানে আমারা আল্লাহর রহমতে সম্পুর্ন সুস্থ।আমরা সরকারি নিয়ম মেনে চলছি।কেউ না বল্লেও চলতাম।ঢাকাতে আরো বেশি নিয়মের মধ্যে থেকেছি।তবুও অনেকে হুমকি দিচ্ছে।অথচ এই মানুষগুলাকেই একটা সময় কতই না সাহায্য করেছে আমার পরিবার।এজন্যই বলে হাতি কাদায় পড়লে পিঁপড়াও লাথি মারে।

ঝড়ের সময় একটা বাবুই পাখিও ধৈর্য ধরে আল্লাহর রহমতের আশায়।আর এরা আমাকে নিয়ে পড়ে আছে।
তবুও আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া,এ যাত্রায় নভেল করোনার হাত থেকে যেন সকলকে হেফাজত করে।সকলে ধৈর্য ধরুন,বেশি বেশি প্রার্থনা আর ইস্তেগফার করুন,ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত