টানা চার ঘণ্টা টিউশনি করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় এসে দেখি ছোট ভাই মেঝেতে পা ছড়িয়ে কান্না করছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। নিজেকে খুব দুর্বল লাগছে।তাও জিজ্ঞেস করলাম
–কি হয়েছে?? কান্না করছো কেন??
নিঃশব্দে কান্না করেই চলেছে। উত্তর না পেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করি কেন কান্না করছে? মা বলল
–তানভীরের মা নাকি তানভীরের জন্য ঈদের নতুন জামা কাপড় আনছে। তখন থেকেই কান্না করছে জামার জন্য।
কিছু না বলে চলে আসলাম।এই মাসের টিউশনির টাকাটা গত মাসেই অগ্রিম নিয়ে মাকে ডাক্তার দেখেছি। ডাক্তার বলেছিল অতিরিক্ত টেনশন ও মানসিক চাপের কারণে এই অবস্থা। কিছু ঔষধ লিখে দিয়েছিলো।যার দাম খুব চড়া। ডাক্তাররাও কসাইয়ের মতো কাজ করে ,, একজন রোগী দেখার ভিজিট অনেক আর ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় লাইনে দাঁড়িয়ে। তখন যে তিনটি টিউশনি ছিল তাদের দুই জনের কাছ থেকে গতমাসসহ চলতি মাসের টাকা অগ্রিম নিয়ে ঔষধের ব্যবস্থা করেছিলাম। ফ্রেশ হয়ে ভাত খেতে গিয়ে দেখি ভাত খুব অল্প। মা বলল
–নূরী তুই খেয়ে নে।তর খাওয়া শেষ হলে তর বাবার জন্য ভাত রান্না করে রাখব।
— হাবিবা (ছোট বোন)খেয়েছে??
— না। রান্না হলে খাবে। এখন তুই খেয়ে নে।
মা খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম না। জানি উত্তর টা কি হবে। সব সময় আমার বেশি খেয়াল রাখে। আমার মনে হয় এটা। কিন্তু মা বলে তার কাছে সবাই সমান। কতো রাত যে না খেয়ে শুধু পানি খেয়েই থেকেছে তার হিসাব নেই। আমি আমার বাবাকে ঘৃণা করি। খুব বেশীই ঘৃণা করি। কেননা সে সংসারের কোনো খরচ বহন করে না। সারাটি জীবন মাকে কষ্ট করতে দেখেছি।মাঝে মাঝে নেশা করে অসম্ভব অত্যাচার করত। যখন ছোট ছিলাম দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতাম কিভাবে মারতো ,ভয়ে সাহস হয়নি ছুটে গিয়ে আটকাতে তাকে। কিন্তু পারি নি। এখন বড় হয়েছি কিন্তু বাবার অত্যাচার বাড়ছে রোজ রোজ।আটকাতে গেলেও নিজেকে যখম হতে হয়।তবুও ছুটে যাই।মাঝে মাঝে মাকে বলি
— আপনি কেন তাকে তালাক দেন না?? সে না থাকলে আমরা আরও ভালো জীবন যাপন করতে পারব।
— সম্পর্ক ছিন্নকারী কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না। কথাটা বলেই কান্না করত।
আমি নিস্তব্ধ হয়ে ভাবতাম একটা মানুষ কি করে কাউকে এত ভালোবাসতে পারে। মায়ের প্রতি আমার খুব ক্ষোভ। কেন বাবাকে কিছু করে না। কিন্তু ক্ষোভটা প্রকাশ করতে পারি না। যখন প্রথম টিউশনি করাতে যাই আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আমার বাবা কি করে?? আমিও বলেছিলাম
— He is seriously a drug addicted person.
তার পরে ওনি বাবার সম্পর্কে কিছু জানতে চাইনি। অল্প কয়েদিন পরেই ঈদ। আজকেই সব টিউশনি বন্ধ। ছোট ভাইটা ওইদিন নতুন জামার জন্য কান্না করে না খেয়েই গিয়েছিল। ছোট বোনটার ও মন খারাপ। কিছু বলে না তাও বুঝতে পারি মলিন মুখটার দিকে তাকালে। রোজার ঈদেও নতুন জামা কাপড় দিতে পারেনি। ছোট ভাইটাকে মা বলেছিল কোরবানির ঈদে নতুন জামা কিনে দিবে।ভাইটা আমার পুরানো কাপড়গুলো পড়েই ঈদগাহে গিয়েছিল।
হঠাৎ মনে হল আমার বিকাশ নম্বর তিন হাজার খানেক টাকা জমা হয়েছে।বাটন ফোন ছেড়ে স্মাটফোন কিনার জন্য জমিয়েছি। কেননা সবাই এখন স্মার্টফোন ব্যবহার করে তাই। আমি তো এই টাকা থেকেই কাপড় কিনতে পারব।টাকা দিয়ে অনেক ফোন কেনা যাবে কিন্তু ঈদটা ফিরে পাওয়া যাবে না। শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। টিউশনি শেষ করে হাঁটা শুরু করলাম মার্কেট এর উদ্দেশ্য। ছোট ভাই বোন আর মায়ের জন্য নেওয়ার পর টাকা ফুরিয়ে গেল। একটুখানি কষ্ট হলো । বাসায় পৌঁছে দরজার কড়া নাড়তেই ছোট বোন খুলে দিল। আমার হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
— আপু এগুলা কি??
— কাপড়। মিলন কোথায়?? ( ছোট ভাইয়ের নাম) ওরে বলার সুযোগ না দিয়ে মায়ের কাছে গেলাম। আমাকে দেখে মা শুয়া থেকে উঠে বসল। ভাইটা ছুটে আসল দেখার জন্য। প্রথমে ওরে দিলাম কাপড় । বললাম
— দেখো ভাইয়া এটা তোমার জন্য। সুন্দর না অনেক??
খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠল ।আর কাপড় উল্টে পাল্টে দেখছে। ছোট বোনকে ও দিলাম। অবশেষে মায়ের জন্য আনা শাড়িটা দিলাম।মা টাকার কথা জিজ্ঞেস করাতে সত্যি কথা বললাম। মায়ের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সবাই কতো খুশি ।ভাই দৌড়ে চলে গেল কাপড় নিয়ে তার বন্ধু তানভীরের কাছে। কতো দিন পর সবাইকে খুশি দেখলাম। আমার জন্য না নিয়ে কেন মায়ের জন্য এনেছি এই কারণে মা অনেক কথা শুনিয়ে দিলেন। অল্পতেই এত খুশি দেখে আমার হৃদয়টা যেন খুব তৃপ্তি পাচ্ছে। কিছু দেওয়ার মাঝে এতো আনন্দ থাকে আগে কখনো উপলব্ধি করতে পারি নি। আনন্দে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।