জীবন সুন্দর

জীবন সুন্দর

বড়লোক বাবার একমাত্র বাউন্ডুলে ছেলেকে ভালোবেসেছিলাম।সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেরানো আর আমাকে কলেজে নিয়ে যাওয়া আসা করাই ছিলো তার চাকরি। একদিন তার অগোছালো চুল ঠিক করতে করতে বললাম,এবার কি একটু গোছাবে? নাকি আরো কয়েক বছর ঝুলে থাকার ইচ্ছে আছে। এবার অন্তত একটু সিরিয়াস হও।জীবনে সিরিয়াস না হলে কিচ্ছু হবে না।আর আমার বাবাও আমাকে তোমার জন্য বসিয়ে রাখবে না বছরের পর বছর।

বড়লোক বাবার ছেলে হয়েছো বলে যে বাবা তোমাকে মেনে নিবে তা ভেবে থাকলে ভুল করছো।তোমাকে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সে সিগারেট ধরিয়ে পরিবেশ ধোয়ায় একাকার করে দিলো।হেসে দিয়ে বলল,আমি কি এখন তোমার পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি! প্রচন্ড রেগে গিয়ে ওকে ফেলেই হাটা শুরু করলাম।এ ছেলে জীবনেও সিরিয়াস হবে না।যার ভরসায় বাবা আমাকে তার হাতে তুলে দেবে সেই যদি এমন বাউন্ডুলে হয় তবে কিভাবে সম্ভব! পেছন থেকে সে আমার হাত চেপে ধরে বলল,চলো এক্ষুনি বিয়ে করবো তোমাকে।দায়িত্ব নেয়া এমন কি ব্যাপার!

আমি হাত ছিটকে দিয়ে বললাম,এটা সিনেমা না যে বললাম আর হয়ে গেলো।আমার বাবা তার মেয়েকে এমন বখাটে ছেলের সাথে কখনই বিয়ে দেবে না।তোমাকে আগে চেঞ্জ হতে হবে।একটু সিরিয়াস হও প্লিজ তাহলেই হবে।দুম করে বিয়ে করবো বললেই বিয়ে করা যায় না।তোমার বাবাও আমাকে মেনে নেবে না এখন।তাই আগে কিছু একটা করো।অন্তত কোনো রকম একটা কিছু যাতে নিজেদের দুবেলার খাবার আর স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য কখনও আমাদের ফ্যামিলির উপর ভরসা করতে না হয়।

সে আমার কথার কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না।রেগে গিয়ে হুড়মুড় করে বাসায় চলে এলাম।বাবা অলরেডি বিয়ে ঠিকও করে ফেলেছে।খুব উঁচু বংশ ছেলেদের।আমার ছবি দেখেই তারা পছন্দ করেছে।বাবার কথা শুনে মনে হলো কালকেই হয়তো এ্যাংগেজমেন্ট হবে বা বিয়েও হতে পারে।খবু টেনশন হচ্ছে।হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।ইফতিকে বারবার কল করেও পাচ্ছি না।দশটা কল দিলেও খবর থাকে না এই ছেলের। মনি বুয়ার থেকে জানতে পারলাম কালকেই বিয়ে হবে।বাবা আমাকে কিছু জানতে দিচ্ছে না।ইফতিকে বাবা পছন্দ করে না।সারাক্ষণ ঘুরে বেরানো এমন বখাটে ছেলের সাথে কোনো বাবাই তার মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হবেন না।কিন্তু আমি তো জানি ইফতি ছেলে হিসেবে কতটা ভালো।তবে এখন বাসা থেকে পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।

ইফতিকে ফোনে না পেয়ে ওর খুব কাছের এক বন্ধুকে সবটা জানিয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে রাতের আধারে লুকিয়ে চলে এলাম ইফতিদের বাসস্ট্যান্ডে।রায়হান ভাইয়া ইফতিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে।ভয়ে আমার হাত পা কাপছে।কিন্তু আমি ভীষন অবাক ইফতিকে দেখে।আজ ওর চোখে মুখে আমি ভয়,চিন্তা,দায়িত্ববোধ সবটা দেখতে পাচ্ছি।জীবনের মানেটা বোধহয় এবার ও বুঝতে যাচ্ছে একটু একটু করে।

বিয়ে তো হলো কিন্তু সাথে সাথে শুরু হলো ইফতির যুদ্ধ।বাসা ভাড়া আর দুজনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য ইফতিকে শেষ পর্যন্ত নিজের বাবার গাড়ির ড্রাইভারি করতে হলো।বাবাকে ঘুরতে যাওয়ার নাম করে ইফতি গাড়ি নিয়ে বের হয়।আর সেই গাড়িই সারাদিন চালিয়ে বেড়ায় ড্রাইভার হিসেবে।অথচ একদিন সে এই গাড়ির মালিক ছিলো।ইফতি আর সেই আগের মতো নেই।এই ইফতি এখন জানে জীবন মানেই স্ট্রাগল।আমাকেও বসে থাকলে চলবে না।তাই একটার পর একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছি। দুপুরে ইফতি বাসায় ফেরার আগেই আমি তারাতারি চলে এলাম।ইফতি বললাম,জীবনে কখনও রান্নাঘরে যাইনি।কি সব পোড়া পোড়া গন্ধ বেরোয় আমার রান্না থেকে।তাও তুমি কত তৃপ্তি করে খেয়ে নাও সরি ইফতি হেসে দিয়ে বলল,আজকে আর পোড়া খাবার খেতে হবে না তোমার জন্য কাচ্চি নিয়ে এসেছি। আমি খুশি হয়ে বললাম,কতদিন কাচ্চি খাই না।ইয়ে মানে কাচ্চি আমার ফেভারিট।কিনে আনছো?

সে প্যাকেট খুলতে খুলতে বলল,একজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে একটা জন্মদিনের অনুষ্টানে গিয়েছিলাম উনি বললেন খেয়ে যেতে।তাই তোমার জন্যও নিয়ে এলাম।খাওয়ার সময় দেখলাম ইফতিকে খুব চিন্তিত লাগছে।ইফতি বলল,বাবার গাড়ি আর ব্যবহার করা যাবে না।এমনিতেই বিয়ের কথা বাবার কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।আর আমি চাই ও না তার উপর ভরসা করে চলতে।এখন থেকে নিজেকেই যা করার করতে হবে।তুমি না হয় এই সময়টা তোমার বাবার কাছে গিয়ে থাকো।আমি এদিকটা সামলে নিয়েই তোমার বাবার কাছে যাবো।এখন তো আর বিয়ে দিয়ে দিবে সেই ভয় নেই।তুমি অলরেডি আমার হয়ে গেছো।একবার বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে উনি সব ভুলে যাবে দেখো।মেয়ের বাবাদের মন নরম হয় শুনেছি। ইফতির হাতে হাত রেখে বললাম,একবার যখন চলে এসেছিই তখন দুজনে এক সাথে মিলেই স্ট্রাগল করবো।হোক কষ্ট তাতে ভালোবাসা তো থাকবে।একদিন সব ঠিক হবে কিন্তু আলাদা হয়ে গেলে মনের জোর কমে যাবে।আমি চাই দুজন একসাথে নিজেদের সংসারটা সাজাবো।

এরপর একটার পর একটা চাকরির চেষ্টা চালাতে চালাতে অবশেষে একটা কোম্পানিতে আমার চাকরি হলো।ইফতি তখন বারবার ব্যর্থ হয়ে ডিপ্রেশনে চলে গেছে।এই খারাপ সময়ে আমাদের পাশে ছিলো ইফতির বন্ধু রায়হান ভাইয়া।যেকোনো সমস্যায় এক ডাকে চলে আসতো।সেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো ইফতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।সিগারেটের ধোঁয়া আমার সহ্য হয় না।কিন্তু ইফতিকে এতো বলেও অভ্যেসটা ছাড়াতে পারিনি। ইফতির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,আমি তো পারলাম না এবার নিজের বাচ্চার জন্য অন্তত এই সিগারেট ছাড়ো।

ইফতি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে বলল,বাচ্চা! আমার বাচ্চা! কোথায়!! পাগল হইছো নাকি? আমি ডাক্তারের রিপোর্টটা ইফতির হাতে ধরিয়ে দিলাম।ইফতি রিপোর্ট পরে খুশিতে আত্মহারা হয়ে পেটে কান রেখে বলল,হ্যা ঠিক আছে।জো হুকুম।আপনি যা বলবেন তাই হবে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,কার সাথে কথা বলছো!! ইফতি হাসতে হাসতে বললো,মেয়ে বলেছে আর সিগারেট খেতে না।সিগারেটের গন্ধে বাচ্চাদের কষ্ট হয়।আমি আমার প্রিন্সেসের কথা কিভাবে ফেলে দেই বলো! ও আচ্ছা তার মানে আমার কথার কোনো দামই ছিলো না তোমার কাছে বুঝেছি।

দাম ছিলো না মানে! এই যে তুমি আমাকে বকো এই বকাঝকার জন্যই আমার নিজেকে গোছাতে ইচ্ছে করে না।ভালোবাসার এই শাসন কার না ভালো লাগে বলো! তবে এখন সব বদলাবে।আমাদের বাচ্চার জন্য।ডিপ্রেশনে যখন তলিয়ে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন তুমি আমাকে যেই খুশির খবরটা দিলে এখন কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি বাবা হওয়ার খুশি কতটা আর একজন বাবার কতটা কষ্ট হয় তার মেয়েকে কোনো বখাটে ছেলের হাতে তুলে দিতে।আর কয়টা দিন সময় দাও আমি সব ঠিক করে দেবো।এবার চাকরিটা হবেই বুঝলে।আমি প্রমান করে দেবো আমার কাছে এসে তুমি কোনো ভুল করো নি।ভালোবাসা পেলে অগোছালো ছেলেও একদিন সব গুছিয়ে নিতে পারে। আমি ইফতির কাধে মাথা রেখে সেই সুদিনের অপেক্ষা করতে লাগলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত