প্রাক্তনের মতো দেখতে যে মেয়েটা, তার সাথেও একদিন ম্যাসেঞ্জারে আলাপ হয়ে গেলো। কী সুন্দর শুদ্ধ বাংলা বনানে ম্যাসেজ পাঠায়! ইচ্ছা করে পড়তেই থাকি। শুরুতে ভাবিনি সে আমার ম্যাসেজের রিপ্লাই দিবে তবুও লিখে পাঠালাম -“আপনি সুন্দর দেখতে।”
কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমার ম্যাসেজ পৌঁছানোর পরের মিনিটেই সে লিখে পাঠালো, -“আপনার পছন্দ হয়েছে?” আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। নিজের উচ্ছ্বাস গিলে খেয়ে লিখতে লাগলাম-“এরকম সুন্দরী মেয়ে যেকোনো ছেলেরই পছন্দ।” সে বললো-“আপনার কথাটা সত্যি না। অনেকেই আমাকে পছন্দ করে না।” আমি অবাক হলাম, এতো সুন্দর মেয়েটাকে কেউ আবার অপছন্দ করতে পারে নাকি! আবার ভাবলাম দুনিয়ার মানুষের পছন্দ-অপছন্দের কোনো ব্যাকরণ নাই। এখানে অনেক মানুষ নিজের গ্যারেজে বিএমডাব্লিউ রেখে রাস্তার আনফিট লোকাল বাসে চড়তে পছন্দ করে।
এই যে কথা শুরু হলো আর যেনো শেষ হতেই চায় না। দুই দিনেই মনে হলো তার সঙ্গে আমার জন্ম-জন্মান্তরের জানাশোনা। তিন দিনের দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে যখন তার ম্যাসেজ পেলাম না। বুকের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভব করলাম। যদিও তার সাথে আমার কিছু নাই। জাস্ট দুইদিন কথা হয়েছে তারপরও কী ভীষণরকম একটা টান অনুভব করলাম। সাধারণত কম বয়সে প্রেমে পড়লে এরকম অনুভূতি হয়। সকাল সকাল মনটা চুপসে গেলো। ভাবছি অফিসে যাবো নাকি যাবো না! যাওয়া উচিত, না গেলে একদিনের অসুস্থতার ছুটি নিতো হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম ছুটিই নেবো। এমন একটা দিনে নিজেকে সময় দেয়া দরকার।
নাস্তা করে, মোবাইল হাতে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। না কোনো ম্যাসেজ আসেনি এখনো। চৈত্রমাসের খোলা মাঠের মতো ইনবক্সটা খাঁ খাঁ করছে। এতোটাই খালি ইনবক্স যে বন্ধু নামক কয়েকটা চিল-শকুন ছিলো তাদেরও দেখা নেই। খানিকটা হতাশ হয়ে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালাম। বাইরে একটা কাক আমগাছে বসে ‘কা কা’ করছে। পাখীদের মধ্যে এই জাতিটা সবচেয়ে অবহেলিত। সম্ভবত তার সহজলভ্যতার জন্যই এমনটা হয়েছে। যে জিনিস যতটা সহজলভ্য মানুষ তাকে ততটা কম মূল্যবান মনে করে। কিন্তু আসলেই কি তা ঠিক!
জানি না আমি, জানতেও চাইনা। এই মুহূর্তে জানতে চাই মেয়েটা কোথায় গেলো? সে ম্যাসেজ দিচ্ছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে আমায়? আপাতত মেয়েটাই পারে উত্তর দিতে। বাধ্য হয়ে আমিই ম্যাসেজ লিখলাম, -“শুভ সকাল। কেমন আছেন।” মেয়েটা অফলাইনে, একটিভ ছিলো আট ঘন্টা আগে। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন সে আসবে! অপেক্ষার ক্ষণ দীর্ঘ হয়, অনেক দীর্ঘ, যেমন দীর্ঘ নির্ঘুম অমাবস্যার রাত ঠিক তেমনি!
আজানের শব্দ কানে ভেসে আসছে। চোখ মেলে দেখি চারিদিকে আলো। কোন সময়ের আজান হচ্ছে বুঝতে পারছি না। নিশ্চিত হতে মোবাইলের পাওয়ার বাটন টিপলাম, চারটা বেজে একুশ মিনিট, ০৮-মার্চ-২০১৭। ধীরে ধীরে মনে পড়লো সকাল থেকে আমি এক নতুন পরিচিত নারীর ম্যাসেজের অপেক্ষা করছি, ছুটি নিয়েছি, জানালার ধারে আমগাছটায় একটা কাক ডাকছিলো, দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম, এখন বিকাল দ্রুত ডাটা কানেকশন অন করলাম। উদগ্রীব হয়ে ম্যাসেঞ্জার খুলতেই টুং শব্দে বহুল প্রতীক্ষিত ললানার ম্যাসেজ -“আপনি বিকালে দেখা করতে পারবেন? টিএসসিতে, বিকাল পাঁচটায়।”
আমি খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। মাত্র দুইদিনের কথায় দেখা করতে চাইছে! একি কোনো ফ্রড নয়তো! নাহ্ ফ্রড হলে টিএসসিতে দেখা করতে চাইতো না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যাবো দেখা করতে, যা হবার হবে। রিপ্লাই দিলাম-“আমি পথে, আসতেছি।” দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে, গায়ে শার্ট চাপিয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগলাম। গলির মুখে এসেই রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে কল দিলাম। পাঁচ মিনিটের মাথায় একটা বাইক এলো। উঠে বসলাম। বাইক চলছে শনশন করে, বাতাসের তোপে হেলমেট উড়ে যেতে চাইছে মাথাসহ। এসবে আমার খেয়াল নেই দ্রুত পৌঁছাতে হবে, পাঁচটার আগে, যত দ্রুত বাইক চলবে ততই ভালো।
শাহবাগ মোড়ে এসে আর যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বামদল রাস্তা অবরোধ করে রেখেছে। বাধ্য হয়ে বাইকওয়ালার বিল দিয়ে নেমে পড়লাম। জাতীয় জাদুঘরের বিপরীতে ফুলের দোকানগুলো থেকে গোলাপ, রজনীগন্ধাসহ নাম না জানা বহু ফুলের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে। আমি জোড় পায়ে ছুটি, দেরী করা যাবে না। পাঁচটা বেজে ছয় মিনিট। রাজু ভাষ্কর্যের নিচে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করলাম। একটা ম্যাসেজ এলো কাঙ্ক্ষিত একাউন্ট থেকে- “টিএসসির গেটে বাম পাশের চায়ের দোকানে আসেন।”
অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছোলাম। চায়ের দোকানের একপাশে অর্ধবৃত্তাকারে দুটো বেঞ্চ পাতা। যে বেঞ্চের একমাথা গিয়ে ঠেকেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সীমানাপ্রাচীরে। বাম পাশের বেঞ্চে দুটো মাঝ বয়সী লোক চায়ের কাপ হাতে গল্প করছেন। ডান পাশে উদ্যানের প্রাচীরঘেষে একটা মেয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে বসে সিগারেটের ধোঁয়া ওড়াচ্ছে। ডিপ লেয়ার চুলের কাট, পরণে টপস, রিপ জিন্স, পায়ে কনভার্স, বাম হাতে দুটো আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে যখন বার্গেন্ডি রঙের লিপস্টিক রাঙানো ঠোঁটে ছোঁয়াচ্ছে; সেই ছোঁয়া পেয়ে পুড়ে গিয়েও যেন সিগারেটের জীবন ধন্য হচ্ছে। নয়নাভিরাম দৃশ্য। আমার চোখ থমকে গেলো, ধোঁয়া সরতেই লক্ষ্য করলাম মেয়েটা অবিকল আমার প্রাক্তনের মতো দেখতে। ছবি দেখে যতটা মনে হয়েছিলো বাস্তবে তার থেকেও বেশি মিল যেন!
আমি তার কাছে গেলাম। গলা খাঁকারি দিয়ে মনোযোগ নিতে চেষ্টা করলাম, সে আমার দিকে তাকাতেই বললাম- “হাই, আমি শিমুল।” মেয়েটা নির্বিকারচিত্তে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলছে-“হ্যাঁ জানি আপনি শিমুল, বসেন।” নিরাপদ দূরত্ব রেখে মেয়েটার পাশে বসলাম। দুইকাপ চা অর্ডার করা হলো। পাশের বেঞ্চে যে দুটো লোক বসেছিলো তারা উঠে চলে গেছে। চায়ে চুমুক দিতে মেয়েটা আমার দিকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিতে দিতে বললো- “ধরুন, ব্যানসন রেগুলার।”
এবার আমার বিস্ময় মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো। মেয়েটা খাচ্ছিলো ইজি লাইট, সে বেনসন রেগুলার কোথায় পেলো? আর আমি যে এটাই খাই তা সে কোথায় জানলো? তার থেকে বড় কথা, তার বলার ধরণটাও অবিকল আমার প্রক্তনের মতোই। আমার ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটাতে মেয়েটা আবার বললো-“কি হলো নিন।” আমি সিগারেট হাতে নিয়ে জ্বালালাম। চা খেতে ভুলে গেছি। সিগারেট টানছি আর ভাবছি কিভাবে সম্ভব এটা, দুইটা মানুষের এতো মিল! “মেসেঞ্জারেতো অনেক কথা বলেন এখন চুপ করে যে?”
আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। ঠিক চোখের দিকে, এতোক্ষণ যা সন্দেহ করেছি তাই সত্যি। এই চোখ আমার খুব পরিচিত, অপরিচিত পোষাকে এই মানুষ আমার চেনা। তার প্রশ্ন এড়িয়ে আমি বললাম, -“মৃত্তিকা?”মেয়েটা আমার দিকে না তাকিয়েই হাসছে, তার হাসিতে প্রেম নেই, নেই আনন্দ কিংবা ভালোবাসা, ঠোঁটের হাসির আড়ালে তার চোখ ছলছল, যেন এই বুঝি আসবে কালবৈশাখী!
গোধূলিবেলায় বসে আছি খোলা মাঠে, মৃত্তিকা আমার পাশেই বসে। আমাদের চারপাশে ঘিরে রয়েছে এক জন্মের স্মৃতি, হাজার হাজার রাত জাগা স্বপ্ন, ভুল বোঝা, ভুলে যাওয়া, শত শত অসমাপ্ত গল্পের পান্ডুলিপি…