মা বললো, “ মেয়ের বয়স ত্রিশ। গোলমুখ করে যথেষ্ট লম্বা এবং সাস্থবান। চুলগুলোও বেশ লম্বা, হাসলে এমন মনে হয়। আকাশ থেকে নেমে এসেছে মাত্র। সবচেয়ে বড় কথা হলো মেয়েটার নিজের একটা ছোটখাটো কোম্পানি আছে। পরিশ্রমী মেয়ে। এবার আর না বলিস না! ”
এমন করে মেয়েটার কথা মা বললো। যেন জগতের একমাত্র অবিবাহিত মেয়ে বাকি আছে! তবে আমারও তো বয়স কম হলো না। দেখা যাবে দেখা যাবে করতে করতে জীবনের চল্লিশটা বছর পেরিয়ে গেলো। এবার কারো গলায় মালা ঝুলানোটাই মঙ্গল। মায়ের হাতে মেয়েটার ছবি। আমার সামনে টেবিলে রেখে বললো, “ বাংলাদেশে গড় আয়ু কতো জানিস তো? ” কথাটা বলে উনি চলে গেলেন। কথাটা কেনো বললেন তা আমি ভালোই বুঝেছি। মেয়েটার ছবির দিকে নজর দিলাম।
কালো কোট পরা একটা মেয়ে পাঁচ তারকা কোনো রেস্টুরেন্টে বসে আছে। দেখে বুঝা যাচ্ছে মাত্রই ব্যবসায়ীক কোনো বৈঠক শেষ করেছে। ছবিটা হাতে নিয়ে পিছনের দিকে উল্টে দেখি একটা নাম্বার লেখা আছে। অবশ্যই এটা ছবির মেয়ের নাম্বার। মাকে বললাম দেখা করা যায়। মাথার উপরে সূর্য। দুপুর বেলায় মেয়েটার সাথে আমার দেখা। যদিও হোটেলের ভেতরে সূর্যের তাপ নেই। সে আমার আগেই পৌঁছেছে। ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত ছিলো। আমার আগমন দেখে ফোনটা রেখে মুচকি হেসে বললো, “ বসুন, আমি জাকিয়া মুনমুন। ”
মায়ের কথা মিথ্যে নয়। মেয়ের সম্পর্কে যেমন বলেছিলো সে তেমনই। কানে দুল পরেছে। কানে দুল পরার মানে হলো সে বিয়ে বসতে একদম প্রস্তুত। বললাম, “ আমি হাসানুজ্জামান তারিক। ” কোনো ব্যবসায়ী মানুষের সাথে কথা বললে সে আপনাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করবে, কী করেন? এটাই স্বাভাবিক। তবে সে তা জিজ্ঞেস না করে বললো, “ কী কী বই পড়েছেন? আপনার পড়া সেরা তিনটি বইয়ের নাম কী? ” প্রশ্নটা আমাকে মেয়েটার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দিলো। বললাম, “ যুদ্ধ সম্পর্কিত সকল বই আমার প্রিয়। আপনার? ” মেয়েটা যেন আমার কথার পুনরাবৃত্তি করলো।
“ ব্যবসা সম্পর্কিত সকল বই আমার প্রিয়! ”
এটাও আরেকটা স্বাভাবিক বিষয়। ব্যবসায়ীক মানুষেরা রোমান্টিক, খেয়ে বসে দিন যায় এরকম বই পড়তে পছন্দ করে না। আবার সে বললো, “ কে আপনাকে বেশি মুগ্ধ করে? এডলফ হিটলার না জোসেফ স্টালিন? ” ভেবেছিলাম সে হয়তো এখন জিজ্ঞেস করবে, চা না কফি? উত্তর দিলাম, “ কেউই আমাকে মুগ্ধ করে না। ” মেয়েটা আবারো মুচকি হেসে বললো, “ আপনি একজন সিদ্ধান্ত রোগী। আমার মনে হয় আমি ভুল বলছি না। ” মেয়েটা ভুল বলেনি। সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই আমার বন্ধুবান্ধবদের ছেলে মেয়েরা কলেজে পড়ছে। আর আমি রাত দুপুরে বন্দুক পিস্তল নিয়ে দৌড়ছি!
আমি কোনো জবাব দিলাম না। সে আবারো বললো, “ জাপানে আমার একটি কোম্পানি আছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই পুরো বিশ্বে আমার কোম্পানি পরিচিতি লাভ করবে। সে স্বপ্ন নিয়েই দিনরাত কাজ করে যাচ্ছি। ব্যস্ত জীবনই আমার ভালো লাগে। এই আমি। আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে? ” এর মাঝে সাদা শার্ট গায়ে এক ছেলে এসে বললো, “ স্যার, জুস দিয়ে যাই? ”
সে এটুকু বলেই চলে গেলো। হ্যাঁ বা না বলার সুযোগ দিলো না আমাকে! আমি মেয়েটার কথার জবাব দিতে গিয়ে বললাম, “ আমি একজন স্নাইপার। আমাদের দুজনের জমবে না মনে হয়। দুজনেরই উড়াউড়ির জীবন। ” মেয়েটা খুব স্বাভাবিকভাবে বললো, “ কার সাথে কার জমবে সেটা আল্লাহ্ ভালো জানেন। যাহোক, কী খাবেন? ” কিছু খাওয়া হলো না আমাদের। আমি উঠে চলে আসলাম। মেয়েটা চমৎকার কিন্তু মনে হচ্ছিলো লোহার সাথে লোহার সন্ধি হবে। যদি আমরা বিয়ে করি।
কথাটা মাকে বলার পর তিনি খুব রাগ করলেন। অভিমানে কথা বলছেন না বেশি। তিনি আমার কাজটা একদম পছন্দ করেন না। আমার বাবাও একজন স্নাইপার ছিলেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন চুয়াল্লিশ বছরে! অবাক হওয়ার কিছুই নেই। বিয়ের ছবিতে যেমন দেখি। বাবা তখন দেখতে ছাব্বিশ বছরের তরুণের মতো ছিলো। স্নাইপার হলেই যে দেরিতে বিয়ে করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু বাবাও নাকি সিদ্ধান্ত রোগী ছিলেন! হাত থেকে মেয়েটার ছবি রাখছেন না মা। মেয়েটাকে মনে হয় বেশিই পছন্দ করেছেন। সারাদিন একা একা বাড়িতে থাকেন। এই বয়সে একা একা সময় কাটাতে কারো ভালো লাগার কথা নয়। রাত দুটো বাজে মেয়েটার নাম্বারে ফোন করলাম। এক বার ফোন বাজতেই সে তুলে বললো, “ কে? ”
“ আমি তারিক। ”
“ ওহ, আপনি? এতো রাতে কী মনে করে? ”
“ বিরক্ত করলাম না তো আবার? ”
“ ভোরে আমার ফ্লাইট। তৈরি হচ্ছি। ”
“ আসলে আমার মা তিন দিন হলো ভালো করে কথা বলছেন না। আপনার ছবিটা হাত থেকেও রাখছেন না! ”
“ কেনো? আমার সাথে তো কথা হয়েছিলো। আমি তো বলে দিয়েছি আমাদের মধ্যে হবে না। ”
“ আপনি এক কাজ করতে পারবেন? এয়ারপোর্টে না গিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে পড়ুন না। ”
“ খুবই জরুরী আমার যাওয়াটা সেখানে। কমপক্ষে পনেরো দিন ওখানে থাকতেই হবে! ”
“ আচ্ছা, তাহলে আমি আপনাকে পরে ফোন করবো। ”
“ আচ্ছা। ”
মা কথাগুলো মনে হয় শুনছিলো। তিনি এলেন হাতে এক কাপ চা নিয়ে। কোনো মা তাঁর ছেলেকে রাত জাগতে বলেন না। আমার মাও বলেন না। আজকে তিনি বললেন, “ রাত জাগিস বলেই তোর নিশানা ভুল হয় না। আজ থেকে আমিও রাত জাগবো। ” না হেসে পারলাম না।
“ তোমার আবার নিশানা কী? ”
“ ওটাই তো ভাবতে হবে। ”
আমি মাথা নাড়ালাম। ভাবতে হবে। দুনিয়াতে সবচেয়ে সহজ এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ভাবা। মায়ের অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। বাড়িতে মানুষজনের অভাব নেই। জাকিয়া এলো পনেরো দিন পর। তাঁর বিয়েতে আপত্তি নেই। দুজনের পছন্দ অপছন্দ জানাশোনা হয়ে গেলো। শুক্রবারের বিয়ে হলো। বাসর ঘরে ঢুকতেই জাকিয়া বললো, “ নামাজ পড়ে ঢুকেছেন? ”
“ ইশার নামাজ? ”
“ নাহ, প্রথম রাতে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া ভালো। এতে আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হয়। আর সংসার জীবন আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করেই শুরু করা উচিৎ না? ” কথা সত্য। আমি বের হতে চাইলাম আবার। জাকিয়া বললো, “ রুমেই পড়ে নেন। বাহিরে আবার যাওয়ার দরকার নেই। ” অযু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিলাম। সেও পড়লো। জানালা খুলে দিলো জাকিয়া। জিজ্ঞেস করলো, “ আপনার স্বপ্ন কী? ”
“ আমি স্বপ্নেই বাস করছি। যা হতে চেয়েছিলাম। আজকে আমি তাই। তবে একটা অপারেশন বাকি আছে। যেটা শেষ না করে শান্তি নেই। ”
“ কীসের অপারেশন? ”
“ কিছু ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়। ”
“ আমার স্বপ্ন কী জিজ্ঞেস করবেন না? ”
“ একদিন সারা বিশ্বে তোমার কোম্পানি পরিচিতি লাভ করবে। এই তো, আমি জানি। আচ্ছা, তোমার কীসের কোম্পানি? মানে মূলত কী কাজ করা হয়? ”
“ কিছু ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়! ” বলেই জাকিয়া হাসলো।
“ এসব কথা ছাড়ো। এ রাতে এসব পেশাগত কথাবার্তা বলে সময় নষ্ট করা ঠিক না। ”
“ তাছাড়া আর কী কথা আছে? আচ্ছা, আপনি বুড়ো বয়সে বিয়ে করলেন কেনো? ”
“ আমি বুড়ো? ”
“ তো জোয়ান? ”
“ এর আগে বিয়ে করলে হয়তো কোনোদিন তোমার বিয়েই হতো না! ”
“ এটাও কথা! ” এর মাঝে ফোন বাজতে শুরু করলো। স্যারের ফোন। স্যারের ফোন আসা মানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের আভাস। উনার সাথে কথা বলতে হয় আলাদা হয়ে। দূরে এসে সে ফোনটা তুললো, “ হ্যালো স্যার? ”
“ তারিক। সেই স্মাগলার গ্যাং এর প্রধানের খবর পাওয়া গেছে। সে বাংলাদেশেই আছে। ”
“ কাজটা কী আমি একাই করবো? ”
“ হ্যাঁ, ভোরের আগে তাঁর ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হবে তোমার কাছে, রাখছি। ” তারিক রুমে ঢুকলো আবার। জাকিয়া জিজ্ঞেস করলো, “ কে ফোন করেছিলো? ”
“ স্যার। ”
“ কাজ পড়ে গেছে নাকি? ”
“ হ্যাঁ। কারো হায়াত আজ রাত পর্যন্তই। কালকেই তাঁকে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হবে। ” জাকিয়া থেমে বললো, “ এসব খুনাখুনির কথা এখন না বললে হয় না? আর কালকেই যেতে হবে? আপনার স্যার জানেন না যে আপনি বিয়ে করেছেন আজকে? ”
“ জানেন, তবে এসব কাজ দিন তারিখ দেখে হয় না! ”
হঠাৎ করেই কীসের যেন শব্দ হলো পাশের রুমে। তারিককে জড়িয়ে ধরলো সে। তারিক হেসে বললো, “ কেউ মজা করছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই! ”
“ বাড়িতে ভূতটুত আছে নাকি? এরকম ভয়ংকর শব্দ হলো কেনো? ” তারিক কথা বাড়ালো না। বাতি নিভিয়ে জাকিয়াকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। সকাল ছয়টা বাজে। একজন তারিকের বাড়িতে এলো। গেটে তারিকের মায়ের সঙ্গে তাঁর দেখা। বললেন, “ তারিকের বাড়ি তো এটাই না? ”
“ হ্যাঁ, কেনো কী হয়েছে? ”
“ কিছু না। এই চিঠিটা তারিককে দিতে হবে। ”
“ আমি তারিকের মা। আমাকে দিন। আমি দিয়ে দিবো। ”
চিঠিটা হাতে নিয়ে তারিকের মা উপরে এলেন। তারিক এখন ডিউটি করতে যাক তা উনি চাচ্ছেন না। বিয়ে করেছে এখন কদিন ঘুরে বেড়াবে। আর এসব চিঠিতে কী থাকে তা উনি ভালো করেই জানেন। কাকে খুন করতে হবে তাঁর ছবি সহ সমস্ত পরিচয়। এরকম অনেক চিঠি এর আগেও এসেছে। এবার উনার কৌতূহল হলো ছেলের আগে উনিই দেখবেন কাকে খুন করার আদেশ করা হয়েছে। চিঠির খামটা খুললেন তিনি। খুলার সাথে সাথেই তিনি চমকে উঠলেন! একটা মেয়ের ছবি দেয়া আছে। নিজে তাঁর বিবরণ। উনি চোখের চশমাটা লাগিয়ে ভালো করে দেখলেন। ভুল দেখছেন না তো? মেয়েটা তো দেখতে একদম জাকিয়ার মতো!
একদম সে মেয়েটার মতোই। যে মেয়েটাকে কালই তারিক বিয়ে করলো। বুকে ব্যথা শুরু হলো উনার। আস্তে আস্তে চিঠিতে লেখা মেয়েটার বিবরণ পড়ে নিলেন তিনি। অবিশ্বাস্য যেন কোনো সিনেমার কাহিনী! তিনি তবুও বিশ্বাস করতে পারছেন না। হয়তো কোনো জায়গায় ভুল হয়েছে তারিকের স্যারদের। উনার নব পুত্রবধূ এরকম ভয়ংকর এক স্মাগলার গ্যাং চালাতে পারেন না। চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলবেন কিনা তিনি বুঝতে পারছেন না। তার আগে তাড়াহুড়ো করে তারিকের দরজায় ঠকঠক করলেন।
ভেতর থেকে কোনো জবাব আসছে না। উনি আরো চিন্তিত হলেন। তারিক তারিক করে কয়েকবার ডাকলেন। কেউই সারা দিচ্ছে না। অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে তাই মনে হয় উঠতে চাইছে না। এ ভেবে তিনি চলে এলেন। কিছুক্ষণ পর বৌমা বৌমা করে আবার ডাকলেন। কেউই সারা দিচ্ছে না। হঠাৎ উনার চোখে পড়লো দরজার নিচ দিয়ে রক্ত বেয়ে আসছে! রক্ত দেখেই উনি চিৎকার করলেন!
সবাই জড়ো হলো। দরজা ভাঙ্গা হলো মুহূর্তেই। দরজা খুলে বাড়ির লোকজন দেখলো তারিক লাশ হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে! বুকে ছুরি দিয়ে কয়েকবার আঘাত করা হয়েছে! নতুন বৌয়ের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। জানালা ভাঙ্গা। মেঝেতে রক্তের বন্যা! টেবিলের উপর একটা চিরকুট রাখা। চিরকুটে লেখা আছে, “ আমাকে ক্ষমা করে দিবেন আম্মা। আমি তেমন মেয়ে নই যেমনটা আপনি ভেবেছেন।