লাভ ইন দ্য টাইম অব করোনা

লাভ ইন দ্য টাইম অব করোনা

পাশের বাসায় বেড়াতে আসা মেয়েটা একটা আউলা মাল। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় সেদিন সে ইচ্ছে করেই আমাকে সাইড থেকে ধাক্কা দিয়ে লালচোখে কৈফিয়ত চাইল,”ধাক্কা দিলেন কেন?” ওর দুঃসাহস দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ধাক্কা তো আমি দেই নি। দিয়েছে সে নিজে। তবুও তর্ক করলাম না। ‘স্যরি’ বলে বাসায় ঢুকে গেলাম। একদিন খুব ভোরে ছাদে উঠে সিগারেট টানছি। হঠাৎ পেছন থেকে ওর হুংকার,”এইটা সিগারেট টানার জায়গা?”

ছাদে উঠে সিগারেট সকলেই টানে। বিশেষত বিকেলের দিকে আমরা সব ছেলেরা যখন ছাদে আসি, ধুমায়ে সিগারেট টানি। মাঝেমধ্যে অনেক রাতে বীয়ার এবং কষা মাংসের ব্যবস্থাও থাকে। কাজটা নিঃসন্দেহে অন্যায়। কিন্তু এই অন্যায়টাও আমাদের শহুরে কালচারের অংশ হয়ে গেছে। আধপোড়া সিগারেট পায়ের নিচে পিষে ফেলে বিরক্ত হয়ে নিচে মেনে যাচ্ছিলাম। সিড়ির কাছে গিয়ে পলকের জন্যে একবার পেছনে ফিরে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি, মেয়েটা টবে লাগানো একটা গাছ থেকে পাতা ছিড়ে নিয়ে এসে টিস্যু পেপারের মতো করে আমার আধখাওয়া সিগারেটটা চেপে ধরে ছাদের বাইরে ফেলছে আর রওশন জামিলের মতো চাপা কণ্ঠে ভ্যাজরভ্যাজর করছে।

মেয়েটার মাথায় বোধহয় সমস্যা আছে। নিজেকে সাবধান করে দিলাম। এই মালের সংস্পর্শ থেকে একশ হাত দূরে থাকতে হবে। সময়টা কভিড ১৯ এর দখলে। সারাদিন বাসায় থাকি। মুভি দেখি, বই পড়ি। একটু পরপর চা খাওয়ার বদ অভ্যাস। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় যেতেই রওশন জামিলের দেখা মেলে। বারান্দাটা ঠিক আমাদের পাশেই। সে আমার আওয়াজ পেলেই ছুটে আসে। গুনগুনিয়ে গান করে। কানে হেডফোন গুজে মোবাইল হাতে নিয়ে অদ্ভুত সব কথা বলে,

“হ্যালো আবির, হ্যা শুনতে পাচ্ছিস না? হ্যালো… আচ্ছা দাঁড়া, কেটে কল দিচ্ছি।” আমি জানি ফোনের ওপাশে আবির নামের কেউ নেই। ফিরেও তাকাই না। তবুও বুঝতে পারি সে কল কাটার নাটক করে আবারও নতুন করে কল ডায়ালের অভিনয় করছে। এরপর খুব সিরিয়াস কণ্ঠে বলছে,”হ্যালো অরু, এইবার শুনতে পাচ্ছি? হ্যালো অরু একটু আগেই সে আবির নামের কাউকে ডাকছিল। এখন আবার অরু হয়ে গেল। ওর কান্ড দেখে হাসি পায়। অল্প বয়সী মেয়ে। অনার্স সেকেন্ড কিংবা থার্ড ইয়ারে পড়ে বোধহয়। এই ধারার মেয়েগুলা খুব আউলা কিসিমের হয়।

বারান্দায় যাওয়া কমিয়ে দিলাম। রুমে বসে কাজ করি, রুমে বসেই চা-সিগারেট। রওশন জামিলের দৌরাত্ম থেকে মুক্তি পেয়েছি। মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছি। কিন্তু আনন্দ স্থায়ী হল না। সন্ধ্যায় ডাইনিংয়ে বসে চা পান করছি, আম্মা এবং ভাবী এসে পাশে বসল এবং নানাবিধ নাটকের পর হঠাৎ বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসল। “আমরা একটা মেয়ের সন্ধান পেয়েছি। দারুণ একটা মেয়ে। আশাকরি তোর অপছন্দ হবে না।” হঠাৎ পাওয়া এই বিয়ের প্রস্তাবে আমার অবস্থা হল বিতিকিচ্ছিরি। খুশি হয়েছি নাকি বেজার হয়েছি জানি না কিন্তু বিয়ে করার যোগ্য হয়েছি- এইটা বেশ বুঝতে পারলাম। কৌতুহলী কণ্ঠে জানতে চাইলাম,”মেয়েটা কে?”

“উকিল সাহেবের ভাগ্নী। বাড়ি সিলেট। মামার বাড়ি বেড়াতে এসে হোম কোয়ারেন্টাইনে আটকে গেছে!” ওদের কথা শুনে হেসে ফেললাম। উকিল সাহেবের ভাগ্নি মানে পাশের বাসার সেই আউলা মালটা?! দারুণ বটে!!! প্রতি শীতে রাশিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল হতে লাখে লাখে পাখি আসে খাদ্য ও আশ্রয়ের আশায়। সেইসব পাখিদের কিছু অংশ এখানে এসে বাচ্চাকাচ্চা ফুটিয়ে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। কিছু অংশ লোভী শিকারীর হাতে বেঘোরে মারা খায়। রওশন জামিলের ভাগ্যে কোনটা আছে?

“মেয়েটা দারুণ। করে ফেল বিয়ে।”

আম্মার দিকে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে বললাম, “দুনিয়ায় মানুষ আতংকে মারা যাচ্ছে আর তোমরা আছ বিয়া নিয়া। এইটা তোমাদের বিয়ার সময়?” “আংটি পরায়ে রাখি? বিয়া পরে হবে।” “আরে নাহ, এখন নয়।” খুব জোর গলায় আপত্তি করলাম কিন্তু আপত্তিটা নিজের কাছেই খুব দুর্বল ও হাস্যকর বলে মনে হল। ভাবী এবং আম্মা যেতে যেতে চোখ ঠারাঠারি করল। ওদের ধারণা আমি রাজি হয়ে গেছি। ওরা ভুল ভাবছে। নিজের রুমে এসে পালঙ্কের উপর বসলাম।

অদ্ভুত লাগছে। বিয়ে? তাও রওশন জামিলের মতো ডেঞ্জারাস একটা মেয়েকে? নাহ ঠিক… মেয়েটা অবশ্যি দারুণ… এবং খুব সাহসী… মন্দ হয় না ওর সাহসের নমুনা পেলাম রাত এগারটার দিকে। অচেনা এক নাম্বার থেকে ফোন। রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তেজস্বী কণ্ঠে জানতে চাইল,”আপনার সমস্যা কী বলেন তো?”

“হ্যালো কে? হ্যালো!”

“এত হ্যালো হ্যালো করতে হবে না। পাশের বাসার দজ্জাল মেয়েটা আমি। আপনি নাকি না করে দিয়েছেন?”

“না মানে কী?”

“বিয়ে করবেন না আপনি জীবনে? আমার চেয়ে ভালো মেয়ে পাবেন? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেছেন কখনো? লম্বা কানের গরু একটা!” রাগ হবার কথা। কিন্তু আমি হেসে ফেললাম। বাপের জন্মে কোন মেয়ে আমাকে এইভাবে ঝাড়ি দেয় নি। এতটা হিম্মৎ নিয়ে কথা বলেনি। ওর রাগ তখনও শেষ হয় নি। সে ক্ষোব্ধ কণ্ঠে বলল,

“আপনাকে আমি ভাইয়া ডেকে ভুল করেছি। আপনাকে আসলে মামা কিংবা চাচা ডাকা উচিত ছিল।”

“ভাইয়া ডাকলে কখন?”

“মুখে ডাকি নাই। মনে মনে ডেকেছি।”

“বিয়ের পর কী ডাকবে?”

“বাল ডাকমু। চামার কোথাকার।”

এইবার সত্যিই গায়ে লাগল। সাহসী বলে প্রসংশা করছিলাম। সে আসলে শিষ্টজ্ঞান শূন্য ফালতু একটা মেয়ে। ফোন কেটে দিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ পাওয়া উস্কানিতে আমারও বুকের ভেতর ফুলসজ্জার বাদ্য বাজতে শুরু করেছিল। নিজেকে ধিক্কার দিলাম। মাঝেমধ্যে স্টুপিডের মতো কাজ করে ফেলি৷ ফালতু একটা মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম। সকালে নাস্তার পর বিছানায় আধশোয়া হয়ে মাথার উপর ঘূর্ণায়মান ফ্যানের ডানাগুলি আলগা করার চেষ্টা করছি এই সময় মোবাইলে ক্রিংক্রিং মেসেজ, “স্যরি। আমি বোধহয় বেশি বলে ফেলেছি। আসলে আপনার হাবাগোবা চেহারা দেখলেই শাসন করতে ইচ্ছে হয়। মায়া হয়।” মেসেজ পড়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। উত্তরে কিছু একটা লিখা উচিত। কী লিখব? ‘ইটস ওকে’ টাইপ আঁতেলা কোন রিপ্লে না দিয়ে আমি ওর কাছে জানতে চাইলাম,

“ঘূর্ণায়মান ফ্যানের ডানা আলগা করে গোণা যায় না কেন?”

সে লিখল, “প্রচন্ড গতির কারণে একটা আরেকটার সাথে লেপ্টে যায়!”

“তুমি প্রচন্ড গতিশীল একটা মেয়ে। আমাকেও গতিশীল করতে হবে। ফ্যানের ডানার মতো লেপ্টা যাওয়া গতি। পারবে?”

“ফ্যানের ডানা তিনটা। আমরা তো মাত্র দুইজন।”

“কিছুদিন পরেই তিনজন হব।”

“হু।”

“এরপর চারজন হব।”

“হু।”

“এরপর পাঁচজন হব।”

“থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব। দুইটি সন্তানের বেশি নয়। একটা হলে ভালো হয়।”

নাহ, এই মেয়েকে বিয়ে করা কিছুতেই উচিত না। কথায় কথায় ক্ষ্যাপে যায়। আউলাঝাউলা গালি মারে। সিলেটের মেয়েরা শুনেছি গুণবতী হয়, এইটা দেখি পুরাই অন্য। কিন্তু এই দুঃসহ হোম কোয়ারেন্টাইনের কালে যেহতু আর কিছু করার নাই, বিয়েটা করে ফেলা যায়। বিয়ের পর ওকে আমি বুঝাব কে কাকে থাপ্পড় দেয়, আর কার দাঁতে কত বিষ!!! রওশন জামিলকেই বিয়ে করব। কমপক্ষে এক ডজন বাচ্চাকাচ্চা নিব। দজ্জাল মাইয়্যাকে আমি এতএত বাচ্চাকাচ্চা দিয়ে জব্দ করব। বাচ্চা থাকবে খাটের উপর, বাচ্চা থাকবে খাটের নিচে, কিচেনে, বারান্দায়, রান্নাঘরে, ওর কোলে, ওর কাঁধে… সারাদিন ডজনখানেক বাচ্চাকাচ্চার চ্যাঁ-চ্যাঁ ভ্যাঁ-ভ্যাঁ সামলাবি এই হবে তোর শ্রেষ্ঠতম শাস্তি!

পরিশিষ্টঃ

করোনা আগ্রাসনের ভয়ে কাউকে দাওয়াত দিতে পারি নি। ঘরোয়া আয়োজনে বিয়ে হয়েছে। আজ রাতে আমাদের বাসার। রওশন জামিল মাথায় ঘোমটা দিয়ে একান্ত বাধ্যগত মেয়ের মতো মাথা নুইয়ে বসে আছে। বাচ্চাকাচ্চা কোম্পানি লিমিটেডের যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছি আজ। খুব ভাব নিয়ে রুমে ঢুকলাম। দরজা বন্ধ করে খাটের উপর উঠলাম। হাত বাড়িয়ে ঘোমটা সরাতে যাব এইসময় সে হঠাৎ মাথা থেকে ঘোমটা ফেলে সাপিনীর মতো ফুঁসে উঠল, “সাবান দিয়ে হাত ধুইছিস?”

“হু।”

“হাতে এখনো নিকোটিনের গন্ধ লেগে আছে কেন? সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে সামান্য একটা সিগারেটের গন্ধ দূর করতে পারিস না, কভিড-১৯ কেমনে দূর করবি বোকাচন্ডাল বাঙালি?” আমি ওকে পাত্তা দিলাম না। বিসমিল্লাহ বলে খাটের উপর ঝাপ দিলাম। আজ রাতে আমি বাঙাল কভিড উনিশের চেয়েও ভয়ংকর। আজ রাতে আপনাদের সিলেটি রওশন জামিলের খবর আছে বাচ্চাকাচ্চা কোম্পানি লিমিটেড শুভ উদ্বোধন

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত