নিভুনিভু দীপ

নিভুনিভু দীপ

আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তুমি কী বললে, বাবা?’ বাবা কেমন জানি কুঁকড়ে গেছেন, কোনোমতে বললেন, ‘পাড়ার ছেলেরা গলির মোড়ে ত্রাণ বিতরণ করছে। তোর মা বলছে, চাল-ডাল নাকি সব শেষ হয়ে গেছে। তাই বলছিলাম কী আক্ষরিক অর্থেই আমি বাক্যহারা হয়ে গেলাম। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলেও এই এলাকায় আমাদের একটা নাম-ডাক আছে।

ছেলে-বুড়ো সবাই বাবাকে সম্মান করে। বাজারে আমাদের যে ছোটখাটো একটা কাপড়ের দোকান ছিল তার আয় দিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারটার ভরণপোষণ বাবা মোটামুটি ভালোভাবেই চালিয়ে নিতেন। ভাইরাসের কারণে গত পনেরোদিন থেকে দোকান বন্ধ। হাতে নগদ টাকা-পয়সা নেই; খাবার যা ছিল তা-ও ফুরিয়ে গেছে। বাজার করার জন্য কারও কাছে টাকা ধার চাইব, সেরকম লোকও নেই। আমাদের মতো সবাই কঠিন সময় পার করছে। আমি একটা ঢোক গিলে বললাম, ‘বাবা, কাজটা কী ঠিক হবে?’

বাবার কাঁধ ঝুলে পড়ল। শব্দ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেলেন, ‘এ ছাড়া আর কী করার আছে, বল? চাল-ডাল যা আছে তা দিয়ে কোনোমতে দুপুর পর্যন্ত চলবে। রাত্রে উপোষ থাকতে হবে।’ বুকে পাথর চাপিয়ে নিলাম, বললাম, ‘চলো!’ দরজার চৌকাঠ পেরুতে যাব, ঠিক সেই সময় পেছন থেকে মা’র ডাক শুনতে পেলাম, ‘বাবু, দাঁড়া!’ দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরলাম। মা দুটো চাদর এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এগুলো দিয়ে তোমাদের মাথা ঢেকে নাও; তাহলে আর কেউ চিনতে পারবে না।’ মা’র কথামতো আমরা তা-ই করলাম।

গলির মোড়ে প্রায় শ’ খানেক মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এলাকার কাউন্সিলারের নেতৃত্বে তাঁর অফিসের সামনে ছেলে-পিলেরা ত্রাণ বিতরণ করছে, সেইসাথে চলছে ফটোসেশনও। বাবা আর আমি কিছুটা ইতস্তত করে লাইনের পেছনদিকে দাঁড়িয়ে গেলাম। মিনিট বিশেকের মধ্যে সামনের লাইন কিছুটা হালকা হলো। তার মধ্যেই আমাদের পেছনে আরও পঁচিশ-ত্রিশজন এসে দাঁড়িয়ে গেল। ‘আরে, বশির চাচা দেখছি! আপনি এই লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’ আমি ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে ওঠলাম! লক্ষ করলাম, কাউন্সিলার আসাদ ভাই আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। ধরা পড়ার ভয়ে চাদর দিয়ে মুখটা ভালো করে ঢেকে নিয়েছিলাম, তাই বেঁচে গেলাম। আসাদ ভাই বাবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘চাচা, আপনি এই লাইনে কেন? এদেরকে তো ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে!’

বাবা আমাতা-আমতা করতে লাগলেন, ‘না… মানে…ইয়ে…’ আসাদ ভাই বাবার হাত ধরে টেনে লাইন থেকে বের করে নিলেন, বললেন, ‘আসুন, আপনার হাতে কিছু ত্রাণ বিতরণ করবেন। ছেলেপিলেরা ছবি তুলছে; আগামীকাল পত্রিকায় যাবে। আপনি এই এলাকার একজন বিশিষ্ট মুরব্বি। আপনার ছবি না থাকলে বিষয়টা কেমন দেখায়! চলুন!’ কাউন্সিলার আসাদ ভাই বাবাকে সঙ্গে নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ছেলেপিলেরা তাঁদের সম্মানে জায়গা ছেড়ে দিল। বাবা নিজের হাতে কয়েকজনকে ত্রাণ দিলেন, ছবিও তোলা হলো বেশ কয়েকটা। পুরো সময়টুকু বাবা মুখভঙ্গিটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হলো না: নিয়তির এই নিষ্ঠুর পরিহাস তাঁর বুকের ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে! আমার মনে হলো, এই মুহূর্তে বাবার মতো অসহায় মানুষ বোধহয় পৃথিবীতে আর একটাও নেই!

ত্রাণ বিতরণ শেষে বাবা বাসার পথ ধরলেন। দেখলাম তাঁর পা দুটো টলছে। লাইন থেকে বের হয়ে ছুটে গেলাম তাঁর দিকে। কাছে যেতেই বাবা এক হাতে আমার কাঁধের ওপর শরীরের অর্ধেক ভার চাপিয়ে দিলেন। আমি শঙ্কিত কণ্ঠে বললাম, ‘বাবা, কী হয়েছে? শরীর খারাপ?’ ‘না, তেমন কিছু না,’ বাবা দুর্বল কণ্ঠে বললেন, ‘প্রেশার একটু বেড়েছে বোধহয়।’ আমি কিছু না বলে বাবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে লাগলাম। বাবা অনেকটা স্বগতোক্তি করলেন, ‘আমার মেয়েগুলো প্রথমেই বাধা দিয়েছিল। খুব চিন্তায় ছিলাম, ত্রাণ হাতে নিয়ে বাসায় ফিরলে ওরা হয়তো রাগ করে সারাদিন আমার সঙ্গে কথাই বলত না! একদিক থেকে ভালোই হলো! কী বলিস?’ হঠাৎ করে মনে হলো, আজকের এই দিনটা দেখার আগে আমি মরে গেলাম না কেন!

রাত নয়টা। কখন যে বাবা আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন টেরই পাইনি! চোখ বুজে চিৎ হয়ে শুয়েছিলাম, বাবার চাপা কণ্ঠ শুনে চোখ খুলে তাকালাম। ‘বাবু, ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি?’ আমি উঠে বসলাম, বললাম, ‘কী হয়েছে, বাবা?’ ‘তোর কাছে টর্চলাইট আছে?’ ‘আছে। কেন?’ ‘ওটা নিয়ে আমার সঙ্গে চল, একটু বাইরে যাব।’ ‘বাইরে তো পুলিশ টহল দিচ্ছে! এ অবস্থায় কীভাবে যাবে?’ ‘এই তো গলির মোড়ে যাব; বেশি দূরে না। চল!’ বাবার কণ্ঠে তাড়ার সুর। কথা আর না বাড়িয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লাম।

বাইরে লোকজনের কোনও চিহ্নও নেই। কয়েকটা কুকুরকে দেখলাম এদিক-ওদিক ঘুরছে। বাবা হাঁটছেন সন্তর্পণে। কারণ না জানলেও তাঁর সতর্কভাব আমার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে; আমি তাঁর মতো হাঁটতে থাকি। গলির মোড়ে কাউন্সিলার আসাদ ভাইয়ের অফিসের সামনে এসে বাবা থমকে দাঁড়ালেন। জায়গাটা অন্ধকার। এখানকার স্ট্রিটল্যাম্প কিছুদিন আগে নষ্ট হয়ে গেছে। বাবা চাপা স্বরে বললেন, ‘টর্চলাইট জ্বালা!’ আমি বেশ অবাক হলাম, ‘কেন?’ বাবা পূর্ববৎ সুরে বললেন, ‘সন্ধ্যার দিকে একবার এদিকে এসেছিলাম। ত্রাণ দিতে গিয়ে বোধহয় কিছু ব্যাগ ছিঁড়ে গিয়েছিল; দেখলাম অনেক চাল-ডাল রাস্তায় পড়ে আছে। ওগুলো তুলে নিই। অন্তত দুইবেলা খাবারের চিন্তা করতে হবে না।’

অনুভূতিগুলো বোধহয় ভোঁতা হয়ে গেছে, তাই বাবার কথাগুলো বুকে স্পর্শ করল না। তাছাড়া পেটে যখন ক্ষুধা থাকে মানবিক সকল অনুভূতি তখন অর্থহীন পড়ে। আমি টর্চলাইট জ্বাললাম। বাবা পকেট থেকে একটা পলিথিনের ব্যাগ বের করলেন। টর্চলাইটের আলো নিচের দিকে তাক করতেই মনটা খুশিতে ভরে ওঠল। রাস্তায়-ফুটপাতে বেশ কিছু চাল-ডাল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে; সঙ্গে কয়েকটা আলুও দেখা গেল। বাবা বললেন, ‘লাইট আমার হাতে দে; আমি ওটা ধরে রাখি। তুই যা পারিস ব্যাগে ভরে নে!’ বাবার হাতে টর্চলাইট দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে নিলাম। খুব দ্রুততার সঙ্গে বেশ কিছু জায়গা চষে পুরো ব্যাগ চাল-ডাল-আলুতে বোঝাই করে নিলাম। বাবা টর্চলাইট নিভিয়ে চাপা স্বরে বললেন, ‘চল, কেউ আবার দেখে ফেলতে পারে!’

পিতা-পুত্র বাসার পথ ধরলাম। বাবা আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘এগুলো যে কুড়িয়ে এনেছি, বাসায় গিয়ে ভুলেও সেটা স্বীকার করবি না।’ আমি বললাম, ‘চাল-ডাল, ধুলা-বালি একসঙ্গে মিশে আছে। এগুলোর ব্যাখ্যা কী দেবে?’ ‘আমার মেয়েগুলোর সামনে ব্যাগটা খুলবি না, ব্যস! তোর মা’কে কিছু বলতে হবে না; ও সব জানে।’
আমি খুব সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন নিঃশব্দে হাঁটতে থাকলাম। রাত বারোটা। বাবা বারান্দায় একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। একটা বেতের মোড়া টেনে তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম। বাবা হয়তো অন্যমনস্ক ছিলেন, আমার উপস্থিতি টের পেয়ে কিছুটা চমকে ওঠলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী রে, ঘুমাবি না?’ ‘ঘুম আসছে না। তুমি এখানে বসে আছ কেন?’

বাবা সিধে হয়ে বসলেন, বললেন, ‘পূর্বপাড়ার মতিনকে তো তুই চিনিস। মুদির ব্যবসায় মার খেয়ে আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। উচ্চবংশের ছেলে, কারও কাছে হাত পাততে পারছিল না। আত্মীয়স্বজনরা সব জেনেও কিছু করতে পারছিল না। যে কখনও কারও কাছে হাত পাতেনি, লোকে তাকে যেচে-পড়ে কোন অজুহাতে সাহায্য করবে? এরই মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল; মতিনের বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। আত্মীয়স্বজনরা তখন দাফন-কাফন, কাঙালিভোজ, চল্লিশা- এসব অজুহাতে বেশ কিছু টাকা মতিনের হাতে দিয়ে দিল। এখন ওর অবস্থা দেখেছিস? বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে সে আবার নতুন করে ব্যবসায় দাঁড় করিয়েছিল। গতকাল শুনলাম ত্রাণের জন্য কাউন্সিলারের তহবিলে ও নাকি দশ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে!’ বাবার কথায় মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না! বললাম, ‘তাতে কী হয়েছে, বাবা?’

‘কিছু হয়নি,’ বাবা অনাবশ্যকভাবে খসখস করে গাল চুলকে বললেন, ‘আসলে আমি বলতে চাইছি, মৃত্যু অনেক সময় একটা পরিবারের জন্য আশীর্বাদ হয়েও আসে।’ ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন বাবা, ‘অবশ্য এখন একটা স্বাভাবিক মৃত্যু আশীর্বাদ তো দূরের কথা, মহা অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। ধর, আজ হঠাৎ করে আমি মারা গেলাম, ভাইরাসে মৃত্যু ভেবে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শি কেউ ধারে কাছে আসবে না! জানাজা পড়ে পুলিশ আমাকে কবর দেবে। এমনকী তোরাও শেষ দেখা দেখতে পাবি না!’ আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে বাবার কথা শুনছিলাম, বললাম, ‘তুমি কীসব আবোলতাবোল বকছ, বাবা! তোমার কী হয়েছে? শরীর খারাপ?’ বাবা হঠাৎ হাসলেন, সবকিছু উড়িয়ে দেয়ার ভান করে বললেন, ‘আরে, ধুর! এমনি বললাম এসব! শরীর আমার ঠিকই আছে। এখন অসুখে ভোগে মরে তোদের আমি বিপদে ফেলব না।’ বাবা প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, ‘চাল-ডালে আর কয় বেলা চলবে?’

আমি মাথা নাড়লাম, ‘সকাল পর্যন্ত। কাল দুপুরে কী হবে বুঝতে পারছি না।’ বাবা আমার মাথায় হাত রাখলেন, সস্নেহে বললেন, ‘তুই চিন্তা করিস না, দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যা, ঘুমাতে যা।’ আমি উঠে দাঁড়ালাম। বাবা চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার সিধে হয়ে বসলেন, বললেন, ‘বাবু, একটা কথা বলি। বাবা যে অভাবের কারণে তোদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারেনি, এই কথাটা কখনও কাউকে বলিস না, বাবা! আমার জন্য সেটা খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।’ হঠাৎ করে আমার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠল। বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠতে চাইলাম। কিন্তু কোনও এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে নড়তে দিল না!

অনেক্ষণ ধরে বিছানায় শুয়ে আছি। চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই। বাবার কথাগুলো বারবার কানে বাজছে। মতিন মিয়ার প্রসঙ্গটা বাবা কেন তুলেছিলেন? তাঁর মনে একটা ধারণা পাকাপোক্ত হয়ে আছে: মৃত্যু কখনও কখনও একটা পরিবারের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। কী অদ্ভুত একটা উপলব্ধি! কোনও মানুষ এভাবে ভাবতে পারে, বাবার কথা না শুনলে আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না! ধীরে-ধীরে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছিল, হঠাৎ একটা ভাবনা আমাকে সচকিত করে তুলল। কাল দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে- বাবা এত নিশ্চিত হয়ে কথাটা কীভাবে বললেন? ‘অসুখে ভোগে মরে তোদেরকে বিপদে ফেলব না’- এর মানে কী? বাবা কি কোনও ইঙ্গিত দিলেন আমাকে? তার মানে!

আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে ওঠলাম। পাগলের মতো ছুটে গেলাম বাবার ঘরে। মা বিছানায় এককোণে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। বাবা নেই! সদর দরজা ভেজানো। দড়াম করে খুলে ফেললাম দরজাটা। বারান্দায় পা রেখেই ব্যাকুল চোখে খুঁজলাম বাবাকে। ছোট এনার্জি বাল্বের আলোতে তাঁকে আগের জায়গাতেই বসে থাকতে দেখলাম। শব্দ শুনে বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তাঁর ঠোঁটে হালকা হাসি, যেন তিনি জানতেন আমি আসব! আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল! নিজেকে সংযত করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম, ‘অনেক রাত হলো, বাবা, ঘুমাবে না?’ বাবা হাত ইশারায় আমাকে ডাকলেন। আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাবা হালকা সুরে বললেন, ‘কী রে, আমি আত্মহত্যা করে বসলাম কি না, সেটা দেখতে এসেছিস?’ মনেমনে বেশ অবাক হলেও চেপে গেলাম, বিব্রত কণ্ঠে বললাম, ‘কী যা তা বলছ, বাবা! ঘুম আসছিল না, তাই বাইরে এলাম!’

বাবার চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম আমার কথা বিশ্বাস করেননি। তিনি উদাস কণ্ঠে বললেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম, মরেই যাই; তাতে যদি তোদের পেটে কয়েকবেলা ভাত পড়ে! পরে আবার মনে হলো, মরে হবেটা কী? লজ্জায় কারও কাছে হাত পাততে পারছি না। না হয় তাতে কিছুদিন উপোষ থাকব। কয়েকদিন উপোষ থাকলে তো আর মানুষ মরে যায় না! কী বলিস? কাল না হলে পরশু, খাবারের বন্দোবস্ত হয়তো একটা হয়ে যাবে। কিন্তু আমি যদি মরে যাই আমার সন্তানরা সারা জীবনের জন্য মাথার উপর থেকে ছায়া হারিয়ে ফেলবে।’ আমি উবু হয়ে বসে পড়লাম। বাবার দুই হাঁটুতে হাত রেখে নরম সুরে বললাম, ‘বাবা, ঘুমাতে যাও, শরীর খারাপ করবে।’

মূল রাস্তার পাশেই আমাদের বাসা। সীমানা প্রাচীর নেই, তাই রাস্তার বেশ কিছু অংশ দেখা যায়। হঠাৎ কুকুরের কুঁইকুঁই ডাক, হুটোপুটি রাতের নিস্তব্ধতা অনেকটাই ভেঙে দিল। দেখলাম কয়েকটা কুকুর রাস্তার ধারের ডাস্টবিনে ময়লা ঘাঁটছে। বাবা উঠে দাঁড়ালেন, সেদিকে তাকিয়ে কেমন জানি ঘোর লাগা কণ্ঠে বললেন, ‘কুকুরগুলোর সঙ্গে আমাদের কত মিল! তাই না রে, বাবু?’ বাবা ক্লান্ত ভঙ্গিতে দরজার দিকে এগুলেন। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম জীবনযুদ্ধে পরাজিত এক বাবার দিকে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত