আশার আলো

আশার আলো

তরকারিতে লবন কম হয়েছে বলে শাশুড়ি খুব কথা শুনালেন। শ্বশুরতো মুখে দিয়ে চোখ মুখ ছিটকে একপ্রকার বমি বমি ভাব করে বললেন, ‘থু! এটা কোনো তরকারি রান্না হলো? রান্না বান্নার দিন দিন এ হাল হলে তো দেখছি খাওয়া দাওয়াই ছেড়ে দিতে হবে। বলি, বাজারটা তো ঠিকঠাক হয়। তবে রান্নাটা ঠিকঠাক হয় না কেন?’ মাথা নিচু করে চুপটি করে টেবিলের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে আলো। শ্বশুর একবার চোখ কুঁচকে তাকিয়ে চলে গেলেন খাবার রেখেই। শাশুড়ি মা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘বাপের বাড়িতে মা কি কিছু শেখান নি? প্রেমটা তো খুব ভালো করেই শিখিয়েছেন। আমার সহজ সরল ছেলেটার কাঁধে চেপে বসেছো।’

অবশ্য এগুলো তাঁর পুরাতন বুলি। অথচ আজ ভাতের সাথে একটু লবন বেশি নিলেই হয়ে যেত। খুব যে লবন কম হয়েছে এমন নয়। আর সমসময় যে এমন হয় তাও নয়। বেশ কয়েকদিন ধরে আলোর শরীরটা ভালো লাগছে না। জ্বর জ্বর লাগছে, মুখেও কিছু স্বাদ পাচ্ছে না তাই তরকারিটা চে’কে দেখার পরেও লবন কম হয়েছে বুঝতে পারেনি। বাবা মায়ের প্রথম সন্তান আলো। ঘর আলো করে তাঁর জন্ম হয়েছিল বলে বাবা নাম দিলেন আলো। খুব আদরে বড় হলেও বাবার অমতে গিয়ে আলো যখন রায়হানকে বিয়ে করলো তখনই দূরত্বের শুরু। বাবার কড়া নির্দেশ, ‘এ বাড়িতে আর কখনও তুমি এলে আমার মরা মুখ দেখবে।’

বাবাকে খুব ভালোবাসে আলো। মরা মুখ দেখার ভয়ে কখনোই আর ওবাড়িতে পা রাখার কল্পনা করে না। সব ছেড়ে এক কাপড়ে রায়হানের আশ্বাসে এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে সে। আলো এসে এ বাড়িটাও আলোময় করে রেখেছে। প্রথম প্রথম শাশুড়ি আর শ্বশুর মিলে খুব আহ্লাদীপণা করলেও যখন জানতে পারলো আলোর বাবা তাকে ত্যাজ্য করেছে তখন থেকে আস্তে আস্তে শুরু হলো এবাড়িতে আলোর খুঁত ধরা। রায়হান বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। মায়ের কথায় ওঠা বসা তাঁর ছোট থেকেই। তাই আলোকে সংসারে যতই অপমান অপদস্ত করা হোক রায়হান এ বিষয়ে মুখ খোলে না কখনও। প্রথম প্রথম আলো যখন দরজা বন্ধ করে মুখে বলিশ চাপা দিয়ে কেঁদে চোখ ফুলাতো রায়হান আলোর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বলতো, ‘কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরো, দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে। মা-বাবার বয়স হয়েছে তো তাই এমন একটু করছে।’

ধৈর্যের অনেক দিন পেরিয়ে গেছে, যাচ্ছে কিন্তু কিছুই ঠিক হচ্ছে না। এরপর আস্তে আস্তে আলো নিজের অবস্থানটা অনুভব করতে পেরেছে। এ বাড়িতে তার মূল্যায়ন শূণ্য। আলো খুব করে বুঝতে পেরেছে এসব কিছুই আর ঠিক হবে না কোনোদিন। পড়াশোনায় বেশ মেধাবী ছাত্রী আলো। অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করার পর আর পড়ে নি। তাঁর শ্বশুর শাশুড়ির বারণ ছিল। বাড়ির একমাত্র বউ বাড়িতেই থাকুক, এত পড়াশোনা করে কি হবে! চাকুরী তো করবে না। রায়হানের অনুরোধে নিজের পায়ের দাঁড়ানোর ইচ্ছেটাকেও মাটি দিল আলো। অথচ একজন ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন তাঁর ছোট থেকে।

দিনের পর দিন শ্বশুর শাশুড়ির মানসিক অত্যাচারগুলো আলো মুখ বুঝে সহ্য করতো রায়হানের মুখের দিকে তাকিয়ে। রায়হানের কথা একটাই, ‘বাবা মায়ের বয়স হয়েছে, ওনারা অনেক কিছুই বলবে তোমাকে। কিন্তু তুমি কিছুই বলবে না। মনে রাখবে, তারা আমাকে জন্ম দিয়েছে। তাঁদের জন্যই তুমি আমাকে পেয়েছো।’ শ্বশুর শাশুড়ি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন এ বাড়িতে তাদের বউ মাকে সায় দেওয়ার মত কেউ নেই, আর না সে তাঁর বাবার বাড়িতে জায়গা পাবে কোনোদিন। আর এই কারনেই তাদের মুখে যখন যা চলে আসে চিন্তা ভাবনা ছাড়াই নির্দ্বিধায় অকপটে বলে ফেলে। আলো কাঁদতে কাঁদতে এখন কান্না করতেও ভুলে গেছে। যখন তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হয়, সে শুধুই দু’চোখ ভরা অসহায়ত্ব নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

রায়হানের ভাষ্যমতে, ‘চলো আমরা বাবু নিয়ে নেই, তাহলে বাবা মা আর তোমাকে কিছু বলতে পারবে না।’ রায়হানের কথায় সায় দিয়ে নিজের ইচ্ছেগুলোকে মাটিচাপা দিয়ে বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আলো গর্ভবতী হয়। এই খবরে ক্ষনিকের জন্য পরিবারে শান্তি নেমে এলেও যখন জানা যায় সন্তানটি ছেলে নয় মেয়ে, তখন দ্বিগুণ আকারে অশান্তি নেমে আসে আলোর উপরে। ইদানীং রায়হানও তাঁর বাবা মায়ের কথায় সায় দিয়ে আলোকে বলে, ‘এমনটা করোইবা কেন যাতে কথা শুনতে হয়। দিন দিন এসব আর ভালো লাগেনা। শুধু শুধু তো কেউ কাউকে আর কথা শোনায় না!’ আলোর দীর্ঘশ্বাস বাড়ে। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলে না। প্রত্যেকদিন অপেক্ষা করে ‘এই বুঝি সব ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু দিন কেটে যায়, ঠিক হয়ে আর ওঠে না।

বিশ্রামহীন ভাবে বাড়ির সব কাজ করতে করতে আলোর শরীর খারাপটা বেড়ে যাচ্ছে, ওদিকে পেটের বাচ্চার বয়স পাঁচ মাসে পড়লো। জ্বরের সাথে, হাঁচি-কাশি আর সর্দিটা বেড়েছে। অল্প কিছুক্ষণ কাজ করার পরে খুব হাঁপিয়ে ওঠে। তখন নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়ে যায়। শাশুড়ি বেশ খেয়াল করেছেন এগুলো। আর তখনই আকাশে ঘন কালো মেঘের সাথে বিজলীদের আনাগোনা নিয়ে বর্ষা শুরু হওয়ার মত আলোর জীবনেও শুরু হলো যন্ত্রণার। শাশুড়ি বেশ গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। রায়হান বাজার থেকে বাসায় ফিরলেই তাঁকে ডেকে রুমে নিয়ে এলেন। ‘রায়হান বউমার অবস্থা সুবিধার মনে হচ্ছে না।’ ‘কেন মা? কি হয়েছে?’ ‘জ্বর তো আগেই ছিল। এখন আবার সর্দিকাশি, হাঁচি, সাথে শ্বাসকষ্টও শুরু হয়েছে।’ ‘ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে মা। চিন্তা করো না।’ ‘আরে কি ঠিক হবে! কিচ্ছু ঠিক হবে না। দুনিয়া জুড়ে করোনা চলছে। এগুলো ঠিক হবার নয়।’ ‘তাহলে কি হটলাইনের নাম্বারগুলোতে কল দিব?’

‘খবরদার! একদমই না। আশে পাশের লোকজন, আত্মীয় স্বজন জানতে পারলে মানসম্মান আর থাকবে না। সবাই আমাদের এক ঘরে করে দিবে।’ ‘তাহলে কি করবো?’ ‘তুই বউমাকে বাবা বাড়ি যেতে বল।’ ‘ওর বাবা তো ওকে ত্যাজ্য করেছে।’ ‘তাতে কি হয়েছে। তাঁরা বউমাকে জন্ম দিয়েছে। এখন আমরা কি এই রোগ ভোগ করবো নাকি? আমি কিছু জানিনা তুই বউমাকে যেতে বলবি। তা না হলে কিন্তু আমিই চলে যাবো বাড়ি ছেড়ে আজীবনের জন্য।’ মায়ের কথা শুনে বেশ ঘাবড়ে যায় রায়হান। নিজের ভেতর থেকেই একটা দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেলে আলোর প্রতি। রুমে ঢুকতেই আলো দৌঁড়ে এলো এক গ্লাস শরবত হাতে নিয়ে। রায়হান খুব সচেতন ভাবে এড়িয়ে গিয়ে বললো, ‘তুমি খেয়ে নাও, আমি খাবো না।’

অথচ বাহির থেকে এলেই রায়হানের প্রথম চাওয়া হলো এক গ্লাস শরবত। দুই বছরে আজ এর ব্যতিক্রম ঘটলো। আলোকে খুব এড়িয়ে চলতে লাগলো বাসার সবাই। সন্ধ্যায় আলোকে কাশতে দেখে রায়হান আর অপেক্ষা না করে বলেই ফেললো, ‘আলো?’ ‘হ্যাঁ, বলো।’ আমার মনে হয় তুমি তোমার বাবা বাড়ি গিয়ে বাবা মায়ের সামনে দাঁড়ালে তাঁরা তোমাকে ফেলতে পারবেন না।’ অনেকটা অবাক হয়ে আলো জিজ্ঞেস করলো, ‘দুই বছর পর এসে আজ হঠাৎ এমন কথা কেন?’ আমতা আমতা করে রায়হান উত্তর দিল, ‘নাহ্ এমনিই বললাম। তোমার শরীর খারাপ এই অবস্থায় তাঁদেরকে তো তোমার পাশে দরকার।’

আলো রাগ আর অভিমান মিশ্রিত কন্ঠ জবাব দিল, ‘এই দুই বছরে যখন তাঁদের আমাকে দরকার হয়নি আর কখনও দরকার হবেনা বলেই ত্যাজ্য করেছেন, তাহলে আমারও তাঁদেরকে দরকার নেই।’ এবার রায়হান খুব চটে গিয়ে বললো, ‘কিন্তু আমরা চাই তুমি তোমার বাসায় ফিরে যাও। তুমি কি অনুভব করতে পারছো না, তুমি ভাইরাসে আক্রান্ত। তোমার শরীরে করোনা ভাইরাসের সবগুলো লক্ষ্মণ আছে। এই অবস্থায় আমরা চাই তুমি আর এখানে না থাকো। আর এখানে থেকে তুমি সেবা নেও সেটাও আমরা চাই না৷ কারন এলাকা ও আত্মীয় স্বজনের মাঝে আমাদের একটা মানসম্মান আছে। আর তুমি কি চাও আমরা সবাই তোমার জন্য মারা যাই?’

কথাগুলো আলোর কানে বারবার বাজছিল। মাথার ভিতরে আগুনের ফুলকির মত প্রতিটা শব্দ ঘুরছিল। প্রতিত্তোরে সে কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। এই মানুষটাকে সে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল, এতদিন এই মানুষটার সাথে এক বিছানায় তাঁর থাকা হয়েছিল, এই মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর সব ইচ্ছে বিসর্জন দিয়েছিল। মানুষ যতটা হতবাক হলে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় ঠিক ততটাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রায়হানের মুখের দিকে আলো। নিজেকে খুব সহজ করে স্বাভাবিক স্বরে বললো, ‘আচ্ছা তুমি আমাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে পারবে?’ আলোর এমন কথার সম্পূর্ণ বিরোধীতা করে রায়হান জবাব দিল, ‘তুমি একাই যাও। আমার না যাওয়াই ভালো।’

অথচ এই মানুষটিই তাঁকে বলতো, ‘আলো আমি তোমাকে আমার জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসি, তোমাকে আমার সবসময়ের জন্য পাশে চাই। এক মুহুর্তের জন্যও দূরে থাকতে দিব না আমি।’ আর আজ সে পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়েই আলোকে ঘর ছাড়ার আদেশ দিচ্ছে। আলো একটা হাসি দিয়ে উত্তর দিল, ‘আচ্ছা সকাল হওয়ার আগেই আমি চলে যাব।’ সে রাতে আলোর পাশে আর রায়হান ঘুমোয় না। সারারাত ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় আলো, কোথায় গেলে তাঁর জন্য ভালো হবে।

আলোর চোখের গভীরতা জুড়ে শুধু ঘৃণা জমে গেছে, সে চোখ বেয়ে আর অশ্রু গড়ায় না৷ ফজরের আজানের আগেই নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাসা থেকে বের হয় আলো। বের হওয়ার সময় ভালো করে সবার মুখটা একবার দেখে নেয়, দেখে নেয় তাঁর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা সংসারটা। পড়শোনা অবস্থায় আলো একটা সংস্থার সাথে কাজ করতো। যাদের উদ্দেশ্য ছিল, অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। সংস্থার এক আপুর সাথে আলোর যোগাযোগ ছিল। সেই আপুর বাসায়’ই আলো গিয়ে ওঠে।

ওখানেই আলোর সমস্ত চিকিৎসা হয়। দুইবার করোনা পরিক্ষা করা হয়। দুইবারই ফলাফল নেগেটিভ আসে। ডাক্তারের পরামর্শে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠে আলো। এই কয়েকদিন সে অনেক অপেক্ষা করেছে ওবাড়ি থেকে আসা একটা কলের। কিন্তু না আসেনি, এমনকি রায়হানেরও কল আসেনি। এখন আর আলো অপেক্ষা করে না। তাঁর জীবনের ভালো থাকার এখন একমাত্র আশার আলো তাঁর অনাগত কন্যা। তাই আলো ভেবে রেখেছে তাঁর কন্যার নাম দিবে ‘আশা’।

আশার জন্য সে’ই হবে একজন আদর্শ মা এবং একজন আদর্শ বাবা। নিজেকে নিজের স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর জন্য নতুন করে শুরু করবে লড়াই। এ লড়াইয়ে তাঁকে জিততেই হবে। ওই সব মানুষদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও তাঁকে জিততে হবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত