বিষন্নতা

বিষন্নতা

ঐ যে মেয়েটা আসছে রিকশায় করে যার জন্য দীর্ঘক্ষন যাবত অপেক্ষা করছি।রিকশা থেকে নেমে ভাড়াটা দিয়ে আমার দিকে একটা মুহূর্তের জন্য তাকালো,তাতেই শুষে নিলো আমার ভিতরের সব তরল, এক সাগর পিপাসায় ছেয়ে গেলো বুকটা।চোখ সরিয়ে এরপর হেটে ভার্সিটির ভিতরে চলে গেলো। কিন্তু তার ঐ এক মুহুর্তের তাকানো চোখগুলায় দেখতে পেয়েছি পৃথবীর সব বিষন্নটা জমে আছে। আশেপাশের এই যে এতো মানুষ কেউই আগেরমতো নেই।সবার চোখে তাকালেই বিষন্নতা,অপরাধবোধ দেখা যায়। যাবেই, এই যে আজকের পৃথিবী! করোনা ভাইরাস চলে গেছে ৩ বছর কিন্তু তার ক্ষত এখনো সবাই বয়ে বেড়াচ্ছে। করোনা যখন আসলো তখন আমরা এর ভয়াবহতার বাস্তবতা ভেবেও নেই নি। যারাও নিয়েছে তারাও ভেবেছিলো বড়জোড় কি হবে অনেক মানুষ মারা যাবে তারপর চলে যাবে।

হ্যা সেটা চলে গেছে কিন্তু যাবার আগে কেড়ে নিয়েছে প্রতিটি পরিবারের কোন না কোন সদস্য কে। এই যে একটু আগের মেয়েটা তার পরিবারের কেউ বেচে নেই। সেও থেকেই নেই। আমি তার সাথে মাস্টার্স করছি একসাথে।এইতো শেষ আর কয়েকটা দিন।এরপর হয়তো চলে যাবো যে যার পথে। ক্লাসে এসে ঢুকলাম, অল্প কিছু ছাত্র-ছাত্রী কেউ তেমন কোনো কথা বলছে না।সবাই এক রকম মন মরা। অথচ সবার ফেসবুকে যেয়ে দেখলেই তিন-চার বছর আগের হাস্যজ্জল ছবিগুলো দেখে চমকে উঠতে হবে। আমি তার পাশের চেয়ারটায় যেয়ে বসলাম,তার দিকে তাকালাম আপনমনে ব্যস্ত।

স্যার ক্লাসে আসলো, পড়াতে শুরু করলো।ক্লাসে মন নেই আমার, ভাবছি, এখন বাংলাদেশের জনসংখা অর্ধেকেরও কম। হ্যাঁ আগে ভাবলে হয়ত যে কেউ উড়িয়ে দিতো কিন্তু বাস্তবতা এটাই। করোনায় যখন আমরা একে অপরকে দোষারুপ দেওয়ার খেলায় মত্ত তখন করোনা ছেয়ে গেলো আমাদেরশরীরময়।এটা আক্রান্ত হলেই মারা যাচ্ছিল তা না কিন্তু ডাক্তার, থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য রিলেটেড সবাই একে একে আক্রান্ত হতে শ্ররু করলো তার সাথে সাথেই একে একে পুলিশ,সেচ্ছাসেবী একেরপর এক সিস্টেম তছনছ হয়ে গেলো।

সবার চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করারও নেই।কারন তার পরিবারের প্রিয় মানুষটাকে বাঁচানোর চেষ্টায় দিশেহারা। এরপর করোনা চলে গেলে এর বাহিরেও অসুখ ছিলো সেগুলো কে সামাল দিবে? একই সময়ে পংগপাল এসে ফসল সাবাড় করে দিয়ে গেলো। দুর্ভক্ষের কাছাকাছি অবস্থায় চলে গেলো দেশ। সব আস্তে আস্তে ঠিক হলো। কিন্তু কেড়ে নিয়ে গেলো আমাদের মুখের হাসিটুকুও। ক্লাস শেষ, মেয়েটা ধীরগতিতে চলে যাচ্ছে, আমিও তার পিছে পিছে যাচ্ছি।তার প্রতিটি পদচিহ্নে যেনো এক একটি পুষ্প অংকিত হচ্ছে। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে, ঝুম বৃষ্টি।বর্ষায় বৃষ্টি সব ধুয়ে নিয়ে যায়,আচ্ছা এই যে সবার দুঃখগুলো এগুলো ধুয়ে নিয়ে যেতে পারে না?

গেটের কাছে আসলাম, একটা রিকশা দাড়া করলাম আমি,উঠতে গিয়েও কি ভেবে যেনো মেয়েটিকে যেয়ে বলল,
“হেনা তোমাকে আমি নামিয়ে দেই?” সে ছাতটা একটু সরিয়ে আমার দিকে মুখটা তুলে তাকালো, যেয়ে রিকশায় উঠে বসলো, রিকশাওয়ালা নীল রঙের পলিথিন দিয়ে আমাদের পা’টা ঢেকে দিলো। মাথায় আমি হুডের ধাক্কা খাচ্ছি। রিকশা ধীর গতিতে চলছে। আমি হেনার দিকে তাকালাম এক দৃষ্টিতে নীচের দিকে তাকানো, বৃষ্টির সাদা ফোটা গুলো পিচ ঢালা রাস্তায় পড়ে ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তাই দেখছে নাকি এক মনে ভাবছে কে জানে! এতো কি ভাবে সে!

আমি ডাকলাম” হেনা,” সে শুনতে পেয়েছে বলে মনে হল না, আবার ডাকলাম, “হেনা” সে এবার তাকালো, “তুমি কি পাঁচটা মিনিট কথা বলবে? যেকোনো কিছু বল আমি শুনবো। এরপর আমাদের পরীক্ষা। আবার সুযোগ হবে কিনা কখনো। বছরেরও বেশি সময় যাবত আমি অপেক্ষায় আছি,তুমি জানো হয়ত।কিছু কথা আমার স্মৃতিতে থাকুক।” তার চোখে জল ভরে গেলো, সে খুবই নরম গলায় বলল, “আমিন আমাকে আর কিছুটা সময় দাও প্লিজ। আমি সামলিয়ে নিচ্ছি” আমার হাতটা দু হাতে ধরে, মাথাটা কাধে রাখলো, আমার মনে হলো সে কাদছে। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে,ধীর গতিতে রিকশাটা এগিয়ে যাচ্ছে…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত