জোৎস্নার পাড়ে

জোৎস্নার পাড়ে

মাঝরাতে হঠাৎ ছোট চাচা তাড়াহুড়া করে আমার রুমে ঢুকেই বলল “আকাশ তাড়াতাড়ি বের হ।” আমি হকচকিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কেন চাচা কী হয়েছে? ” উনি বললেন “আরে ব্যাটা বের হ। একটা ভয়ঙ্কর জিনিস দেখবি চল।” আমার গা শিউরে উঠলো। আমি বললাম “রাত এখন প্রায় মধ্যরাত্রি। এখন কোথায় কী দেখব? আবার ভয়ানক, না চাচা আমি পারবো না।” উনি বললেন “আরে বের হ না তুই। এত ভয় পাস কেন?” উপায় না পেয়ে বের হলাম।

ছোট চাচাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। আমার বাবা-মা যখন আমাকে বকা দিতো বা মারতো ছোটবেলা থেকেই আমি ছোট চাচার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিতাম। নিজের সবটুকু দিয়ে শ্রদ্ধা করি ও ভালোবাসি লোকটাকে। এখন বড় হয়ে যাচ্ছি। ভার্চুয়ালে কানেক্টিভিটি বেশি, বাস্তবে কম। তাই হয়তো আগের মতো এতো চলাফেরা করতে পারিনা উনার সাথে। কিন্তু উনাকে সবসময়ই ভালোবাসি। মোবাইলটা চার্জে লাগিয়ে চাচার সাথে বের হলাম। চাচা আমাকে নিয়ে বাড়ির গেইট দিয়ে বের হয়ে সামনের সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম “চাচা আমরা যাচ্ছি কোথায়? ” উনি বললেন “তুই কথা কম বলতো বাবা। আমার পেছনে পেছনে আয়।ভূত দেখবি আজ।”

আমি ভয় পেয়ে বললাম “না চাচা আমার দেখার দরকার নাই। আমি বাসায় যাব। ” উনি বললেন “চুপ কর। যা বলতেছি তাই কর। আমার পেছনে পেছনে আয়।” তখন ছিল পূর্ণিমার রাত্রি। চারপাশে ভয়াবহ নীরবতা। আমাদের হেঁটে চলার শব্দও যেন বিকট আওয়াজ তুলছিল। মেঠোপথ ধরে হাঁটছি চারপাশে গাছপালা। বুনোলতার আঁশটে গন্ধ মেখে আছে এখানকার স্তব্ধ বাতাসের গায়ে। কোথাও কোন অচেনা একটা পাখি ডাক দিয়েই যেন আবার চুপ। যেন কিছুই বলেনি পাখিটা। আলো ও কালোর লুকোচুরি।

আশপাশ জনমানবহীন। যেন এক ভিন্নজগতের আভাস। মাঝেমধ্যে আমাদের পায়ের আওয়াজ শুনে পাশের ঝোপ থেকে হয়তো শিয়াল বা এই ধরনের কিছু একটা লাফিয়ে ঘন জঙ্গলের দিকে দৌড় দেয়। আমার গা ছমছম করছে। আমি বললাম “মুখুজ্জে বাড়ির পুরোনো ভিটের কাছে চলে এলাম চাচা। আরো কী যাবে?” উনি বললেন ” এইতো চলে এসেছি। আর কিছুটা।” খানিক বাদে উনি আমাকে বললেন “এখানে বস। ” একটা পুরনো জারুল গাছের নিচে দুজনে বসলাম। উনি বললেন ” এবার সামনের দিকে তাকা। ” আমি সামনের দিকে তাকালাম। একটা ছোট্ট ডোবার উপরে চাঁদের আলো পড়েছে। আলোতে ডোবার পানি যেন চিকচিক করছে। চাচা বললেন “খুব মনোযোগ দিয়ে দেখ দৃশ্যটা আর পাশের বনের কোনো উঁচু ডালে বসে যে কোকিলটা সুমধুর কন্ঠে গান গেয়ে যাচ্ছে কোকিলের সেই শব্দটা কানের ভেতরে প্রেরণ কর। ”

আমার প্রকৃতপক্ষে খুবই বিরক্ত লাগছিল। কেননা আমি ঘরে বসে মেসেঞ্জারে আমার বন্ধুদের সাথে মজার মজার গল্প করছিলাম, চ্যাটিং করছিলাম এই সব ছেড়ে চাচা আমাকে কোথায় নিয়ে এলেন। আমি বিরক্ত নিয়ে উনার কথামতো দৃশ্যটা দেখতে শুরু করলাম আর কোকিলের সেই শব্দটা নিজের কানের মধ্যে নিতে লাগলাম। কিন্তু অদ্ভুত রকম ভাবে দেখতে পেলাম কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার সকল বিরক্তি যেন চলে গেল। আমার কাছে ভয়াবহ রকমের ভালো লাগতে শুরু করল এখানকার সবকিছু। সত্যিই তো কত মুগ্ধকর জ্যোৎস্না পৃথিবীতে নেমে এসেছে। কত মধুর চারপাশের শব্দগুলো। অনুভব করলাম আমার মনের মধ্যে একটা নতুন প্রাণ সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। আমি নিরব হয়ে, নিস্তব্ধ হয়ে এক মনে এসব দেখতে লাগলাম আর অবাক হতে শুরু করলাম।

আসলেই এত সুন্দর রাত আমাদের পৃথিবীতে আসে। কই কখনো তো এইভাবে, এতো তীক্ষ্ণ ভাবে দেখতে পারিনি।
প্রায় একঘন্টা হয়ে যাবে ছোট চাচা যদি আমাকে গায়ে ধরে ধাক্কা না দিত আমার হুশ ফেরতোনা। চাচা বললেন “আকাশ এবার উঠ। বাসায় যাওয়া যায়।” কিন্তু আমার কোনোভাবেই ওই জায়গাটা ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। ছোট চাচার কথা শুনে আসতে হল। বাড়িতে ফেরার পথে ছোট চাচা গল্প করতে করতে আসছিলেন। আর আমি উনার গল্প শুনছিলাম আর ভাবছিলাম “সত্যি এরকম একটা মানুষ আমার কাছের মানুষ হয়েছে বলে আমি ভাগ্যবান। এরকম অনেক কিছুই হয়তো দেখতে পেতাম না ছোট চাচা না থাকলে। চাচাকে দেখে দিনদিন শুধু অবাকই হবো।”

একটা মানুষ কতটা সাবলীলভাবে চলে। কত হাস্যজ্জল, কত রসিক। অথচ এই লোকটারই অগনিত চাপা কষ্ট আছে। যেটা কাউকে কখনো বুঝতে দেয় না। কে জানবে উনাকে দেখে যে উনারো একটা ভালোবাসার মানুষ ছিল। কে বুঝবে উনাকে দেখলে যে উনি একটা মানুষকে সারা জীবনের জন্য পাবার স্বপ্ন দেখেছিল। অথচ সেই মেয়েটা আজকে ঠিকই সুখের সংসার করছে। মিথ্যা অজুহাতে বাবা মাকে দোষারোপ করে বড়লোকের বিবি সেজে বসে আছে দালানের উপরে। তার হয়তো কোনো বিষাদ নেই চাচাকে নিয়ে। সব মেয়ে এমন তা বলছিনা। তবে কিছু মানুষ বিবেকহীন। এরা তাদের বিরক্তিকর সময়ের ব্যবহার করে অন্য কারো জীবনের কুড়ি নিয়ে।

চাচা বিয়ে করেননি। সেই মানুষটার জন্যই হয়তো তার বিয়ে করা হয়নি। বিয়ে পরে আর করবেন কি না সেটাও অজানা। সব সময় হাসিখুশি, সবসময় আমোদে থাকা এই লোকটার ভেতরের কষ্টগুলোর একটা ক্ষুদ্র অংশ আমার জানা, আর তাতেই আমার মন খারাপ হয়। অথচ উনি উনার মত সব লুকিয়ে রাখে, অবহেলায় লালিত সকল তীক্ষ্ণ আঘাত লুকানোই থাকে। সত্যিই অদ্ভুত এই পৃথিবীর প্রকৃতি, সাথে অদ্ভুত এখানকার মানুষেরা। কারো কষ্ট, কারো বুকে আঘাতের পরিমাণ কেউ কখনো হিসাব করে না। কেউ হয়তো কোনদিন এসে সেসবের হিসাব করবেও না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত