বিভীষিকাময় এক বৈশাখ

বিভীষিকাময় এক বৈশাখ

হুইল চেয়ারে বসে বই পড়ছে আসাদ। তার সাত বছরের একমাত্র ছেলে জুবায়েদ টিভি দেখছে। আর স্ত্রী নূরী রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। এই তিনে আসাদের সুখী পরিবার। টিভিতে পহেলা বৈশাখের খবর দেখে জুবায়েদ বলল, “বাবা, কাল আমি মেলায় যাব।” রান্নাঘর থেকে নূরী বলল, “মামা এসে নিয়ে যাবে।” “না, না, আমি বাবার সাথে বড় মেলায় যাব।” নূরী বলল, “যখন বড় হবা, তখন বড় মেলায় যাবা।” জুবায়েদ নাছোড়বান্দার মতো করতে লাগলো। নূরী রেগে বলল, “আমি কিন্তু এখন এসে পিটাবো।”

মা-ছেলের এই যুদ্ধে এবার আসাদ প্রবেশ করে বলল, “ঠিক আছে। বড় মেলাতেই যাব। কোন বড় মেলায় যেতে চায় আমার বাবায়?” জুবায়েদ খুশির সাথে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলল, “আমি রমনার মেলায় যাব। সবাই বলে ওটা নাকি অনেক বড়।” সাথেসাথেই ঘরটা নীরব হয়ে গেল। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসা বন্ধ হয়ে গেল। আসাদও চুপ হয়ে গেল। তখনই নূরী এসে জুবায়েদকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল যেন সে বড় কোনো অপরাধ করেছে তাই শাস্তি দিতে নিয়ে যাচ্ছে। জুবায়েদ কান্নাকাটি করতে লাগল। আসাদ থামানোর চেষ্টা করলো না। সে যেন জড়পদার্থ হয়ে গেছে। অন্য রুমে নিয়ে জুবায়েদকে শাসিয়ে নূরী বলল, “আর যদি কখনো রমনার নাম নিস তবে মেরে পিঠের চামড়া তুলে দিব।”

উদাস মনে বারান্দায় বসে আছে আসাদ। প্রতি বছরই বসন্তের শেষ দিকে একটা বিভীষিকাময় অতীত আসাদকে খুব পীড়া দেয়। এই বছরও তার ব্যতিক্রম হলো না। এখনো সেটা হচ্ছে। “বসে আছো যে? খেতে এসো।” নূরীর ডাকে আসাদ ঘুরে তাকাল। আসাদ “হুম” বলাতে নূরী এসে হুইল চেয়ারটা ধরে খাবার টেবিলের কাছে নিয়ে এলো। তিনজনে মিলে খেয়ে নিলো। অন্যান্য দিন সবাই মিলে খুব গল্পগুজব করে খেত। তবে আজ কেউই খুব একটা কথাবার্তা বলেনি। “বাবা, আমার ওই পুতুলটা লাগবে।””প্রভা, তোমরা এখানে দাঁড়াও। আমি ওটা কিনে আনছি। বাচ্চা দেখলে দাম বেশি চাইবে।”

আসাদ রাস্তার ওপারে গেল। দরাদরি করে পুতুলটা কিনলো। পহেলা বৈশাখ বলে দাম একটু বেশি। পুতুল কিনে রাস্তার ওপারে পা বাড়াতেই একটা বিকট শব্দ হলো। আসাদ ছিটকে যেয়ে ভ্যানগাড়ির উপর পড়লো। আকস্মিক দূর্ঘটনায় আসাদ চেতনা হারিয়ে ফেলল। স্নায়ু যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বেশ সময় লাগল তার হুঁশে ফিরতে। উঠে দেখল নানা রঙের রঙিন বৈশাখ শুধু রক্তের রঙে লাল হয়ে আছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে ওপারে এলো। চারদিকে মানুষের আর্তনাদ ও ছোটাছুটি চলছে। খানিকটা দূরে আসাদ তার মেয়ে আভার নিথর দেহ দেখতে পেল। কাছে যেতে না যেতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

“আভা রাত প্রায় দুটা। আসাদের চিত্কার শুনে নূরীর ঘুম ভেঙে গেল। আসাদকে বসিয়ে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু সান্ত্বনা দেয়ার মতো কিছু বলল না। কেননা আসাদের কষ্টের কি সান্ত্বনা দেয়া যায় তা নূরীর জানা নেই। সন্তান হারানো বাবা ও ভালোবাসা হারানো স্বামীকে কিভাবে সান্ত্বনা দিতে হয় তা নূরীর জানা নেই। নূরীর বুকে আসাদ হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছে। নূরী আরও শক্ত করে আসাদকে আঁকড়ে ধরছে। নূরীর চোখ বেয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে শিশুর মতো নূরীর কোলেই ঘুমিয়ে পড়লো আসাদ। ভোরের আলোতে আসাদ বারান্দায় বসে আছে। এক হাতে বই ও অন্য হাতে চা। এক চুমুক চা খাচ্ছে আর বই পড়ছে। এভাবে কিছুটা সময় কাটালো আসাদ। তারপর চোখ দুটো বন্ধ করতেই অতীত হাজির হলো। বারো বছর পুরানো সেই বিভীষিকাময় অতীত।

ঐ তো আসাদের স্ত্রী প্রভা সাজুগুজু করছে। সাথে সাজিয়ে দিচ্ছে তাদের আদরের টুকরা আভাকেও। আজ তারা বৈশাখ মেলায় যাবে। পহেলা বৈশাখ এলেই যেন পুরো বাংলাদেশ নতুন রূপে সাজে। রঙের খেলা শুরু হয়। পথঘাট “এসো হে বৈশাখ” সুরে ভরে উঠে। বাচ্চা-যুবক-বুড়ো সবার হাতে-চেহারায় বৈশাখের আগমনের ছোঁয়া দেখা যায়। পান্তা ইলিশ না খেলে এবং মেলায় না গেলে যেন বৈশাখকে বরণ করাই হয় না। পুরানো সেই ঐতিহ্য অনুযায়ী সকাল সকাল পান্তা ইলিশ খেয়েছে আসাদ, প্রভা ও আভা। এখন মা-মেয়ে সাজুগুজু করছে। বৈশাখকে বরণ করতে আজ তারা মেলায় যাবে। আভার মুখ থেকে যেন হাসি সরছেই না। মা-মেয়ে ম্যাচিং করে শাড়ি, চুড়ি, কানের দুল, কপালে টিপ পরেছে। এই মুহূর্তে আসাদকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দুটা জিনিসের নাম বলো। তবে সে প্রভা ও আভার নাম বলে দিবে। মেয়েটা গত সপ্তাহ ধরে বায়না ধরেছে রমনার বড় মেলায় যাবে।

“না, আমি বাবার সাথে বড় মেলায় যাব।” জুবায়েদের কান্না মিশ্রিত কণ্ঠ শুনে আসাদের হুঁশ ফিরলো। হুইল চেয়ারটা ঘুরিয়ে সামনের রুমে এলো। নূরীর হাতে একটা বেত, তা দিয়ে জুবায়েদকে শাসাচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে আসাদের শ্যালক মাহবুব। গত ৩/৪ বছর ধরে পহেলা বৈশাখে মাহবুব এসে মেলায় নিয়ে যায় জুবায়েদকে। তবে এই বছর জুবায়েদ কেন যেন জিদ ধরেছে বাবার সাথে যাবে বলে। নূরী জানে এই দিনটা আসাদের জন্য একটা বিভীষিকাময় দিন।

“নূরী, তুমি রেডি হও। আজ আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাব।” নূরী পলকহীন দৃষ্টিতে আসাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাহবুব সায় দিয়ে বলল, “তাহলে তো খুব মজাই হবে।”

“মজা লাগবে না। তুই জুবায়েদকে নিয়ে যা।”
“না, না। আমি বাবার সাথেই যাব।”
“ছেলেটাকে আর কাঁদিও না। আমি নিয়ে যাব।”
“তোমার যেতে হবে না।”
“আমি পঙ্গু বলে আমার সাথে যেতে তোমার আপত্তি আছে?”

আসাদের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালো নূরী। যেন এখনই কেঁদে দিবে। আসাদ জানে কথাটা সে খুব খারাপ বলেছে। তাদের বিয়েটা পারিবারিকভাবে হয়েছিল। আজ প্রায় দশ বছর পেরিয়ে গেল। নূরী আজ পর্যন্ত তার পঙ্গুত্ব নিয়ে খোটা দেয়নি। সমাজে চলাচল করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। সততা ও ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে পরিবারকে। আসাদ প্রায়শই তার অতীত ভেবে কান্নাকাটি করে। তবুও আজ পর্যন্ত নূরী কোনো অভিযোগ তুলেনি। বর্তমানে কোনো মেয়েই এটা মেনে নিবে না যে তার স্বামী পূর্ব স্ত্রীকে ভেবে কান্নাকাটি করে।

নূরী হনহনিয়ে ভেতর রুমে চলে গেল। আসাদও এলো। সে জানে কথাটায় নূরী খুব কষ্ট পেয়েছে। শুধুমাত্র নূরীকে থামাতে আসাদ এই কথাটা বলেছে। “ক্ষমা করে দাও। আমি তোমার মনে কষ্ট দিয়েছি।” আসাদের পায়ের কাছে এসে হাঁটুতে হাত রেখে চোখের দিকে তাকিয়ে নূরী বলল, “কেন তুমি নিজেকে কষ্ট দিতে চাচ্ছো? আমি জানি রমনায় গেলে তুমি খুব কষ্ট পাবে।” নূরীর কথা শুনে আসাদ অবাক হয়ে গেল। নারী কিভাবে পারে, মুহূর্তেই স্বামীর দেয়া কষ্ট ভুলে স্বামীরই কষ্টের কথা চিন্তা করতে? আসাদ হাসিমুখে বলল, “অনেক তো লুকিয়ে রইলাম। আর কত? এবার আমাকে বাস্তবতার সম্মুখীন হতেই হবে।”

রমনার উদ্দেশ্যে আসাদ তার পরিবারকে নিয়ে রওনা হলো। চারদিকের নানান রঙবেরঙের জিনিস দেখে জুবায়েদ খুশিতে যেন নাচতে চাচ্ছে। ঠিক এমনই হয়েছিল আজ থেকে ১২ বছর আগে। সেদিনও পরিবার নিয়ে এই রমনাতে ঘুরতে এসেছিলো আসাদ। মেয়ে আভার মুখেও সেদিন হাসির রেখা ছিল। তিনজনে মিলে দোলনায় চড়েছিলো। নতুন নতুন জিনিস দেখে আভা বারবার জিজ্ঞেস করছিলো বাবা এটা কি? বাবা ওটা কি? আসাদও হাসিমুখে জবাব দিয়েছিলো। আজও তাই হচ্ছে। জুবায়েদ বারবার জিজ্ঞেস করছে বাবা এটা কী? বাবা ওটা কী? আসাদের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বারবার। দ্রুত পলক ফেলতে ফেলতে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আসাদের হুইল চেয়ার টানছে নূরী। যদিও এটা আসাদের ভালো লাগে না। তবে নূরীর বেশ ভালো লাগে। তার মতোে যখন সে হুইল চেয়ার টানে, তখন হাতে হাত রেখে হাঁটার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। আসাদের মস্তিষ্ক বারবার স্মৃতিচারণ করতে লাগলো। আসাদ হাজারো চেষ্টা করে যাচ্ছে বর্তমানে থাকতে। কিন্তু তার মস্তিষ্ক তাকে অতীতে নিয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে বারবার আভা ও প্রভা ভেসে উঠছে। এইতো আভাকে কোলে নিয়ে প্রভার হাত ধরে সে হাঁটছে।
“বাবা, বাবা আমি ওটা কিনবো।”

জুবায়েদের কথায় আসাদের মস্তিষ্ক বর্তমানে ফিরলো। তাকিয়ে দেখলো জুবায়েদ একটা খেলনার দিকে ইশারা করছে। নূরী হুইল চেয়ারটা সেদিকে নিতে লাগলো। আসাদের মনে হচ্ছে সেই বিভীষিকাময় অতীত বর্তমানে এসে হাজির হচ্ছে। জুবায়েদকে কোলে নিয়ে খেলনা পছন্দ করাচ্ছে মাহবুব। আসাদ আস্তে করে পিছে তাকালো। সে স্পষ্ট নিজেকে দেখতে পেলো। হাতে একটা পুতুল নিয়ে সে রাস্তা পার হতে যাচ্ছে। ঠিক তখনই বিকট শব্দ হলো। মুহূর্তেই চারদিক লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল রমনা। সে ছিটকে এসে ভ্যানগাড়ির উপর পড়লো। আসাদ তাকিয়ে রইলো তার দৃশ্যমান কাল্পনিক দেহটার দিকে। ভ্যানগাড়ির উপর পড়ে আছে। আসাদ আবার চোখ বুলালো সামনের দিকে। আভা ও প্রভাকে খুঁজতে লাগলো। আসাদ তার হুইল চেয়ার সামনের দিকে বাড়াতে লাগলো। নূরী তার আঁচল দিয়ে হুইল চেয়ার বেঁধে রাখে। আঁচলে টান পরতেই নূরী তাকালো। আসাদকে যেতে দেখে সেও নিশ্চুপে এগোতে লাগলো যেন আসাদের চলাচলে বাঁধা না আসে।

আভার রক্তাক্ত নিথর দেহটার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে দুই আসাদ। একটা সে নিজে। আরেকটা তার দৃশ্যমান কাল্পনিক চরিত্র। আভার রক্তাক্ত দেহটাকে কোলে নিয়ে, “আভা আভা” করে কেঁদে যাচ্ছে কাল্পনিক আসাদ। চোখে দিয়ে অশ্রু ঝরছে দুজনেরই। আভার নিথর দেহটাকে কোনোমতোে কোলে নিয়ে আসাদ উঠে দাঁড়ালো। ঠিক তখনই বিস্ফোরণের আরেকটা বিকট শব্দ হলো। গাছের একটা ঢাল এসে কাল্পনিক আসাদের উপর পড়লো। আভাকে কোলে নিয়েই আসাদ গাছের নিচে চাপা পড়লো। “আমার আভা, আমার আভা।” বলতে বলতে হুইল চেয়ারে বসে আসাদ সেই গাছের ঢাল উঠাতে লাগলো।

এই চেষ্টায় আসাদ হুইল চেয়ার থেকে পড়ে গেল। তবুও সে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে গাছের ঢাল সরিয়ে আভাকে বাঁচাতে। আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। পাগল ভাবছে। নূরীও বসে পড়লো। কিন্তু কিছুই বলছে না। ছলছল চোখে শুধু আসাদকে দেখে যাচ্ছে। আসাদ যে তার হারানো পরিবারকে ভীষণ ভালোবাসে এটা তারই বহিঃপ্রকাশ। আসাদ যে একটা কল্পনায় আছে এটা নূরী ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। মাহবুব থামাতে এগিয়ে আসতে চাইলো কিন্তু নূরী ইশারায় নিষেধ করলো। কোল থেকে জুবায়েদ নামতোে চাইলো কিন্তু মাহবুব আঁকড়ে ধরে আছে। চেষ্টা করতে করতে এক পর্যায়ে আসাদ “আমার আভা চলে গেল।” বলে অঝোরধারায় কান্না শুরু করলো। নূরী আস্তে করে আসাদকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, “যা আল্লাহ নিয়ে গেছে তা আর ফিরবে না।

আমাদের উচিত মেনে নেয়া। আর তাদের জন্য দোয়া করা।” আস্তে আস্তে আসাদের কান্না থামালো। ভীড় কমে গেল। মাহবুব ও নূরী মিলে আসাদকে চেয়ারে বসালো। রমনার পাশেই একটা কবরস্থান আছে। সেই দুর্ঘটনায় নিহত সবাইকে সেখানেই কবর দেয়া হয়েছিল। আসার সময় আসাদ সেখানে যেয়ে কবর জিয়ারত করলো। দূর থেকে নূরী দেখে যাচ্ছে। মৃত্যুও আসাদের প্রথম ভালোবাসাকে পৃথক করতে পারেনি। মানুষ মরলেও ভালোবাসা যে কখনো মরে না তার ছোট্ট একটা উদাহরণ আসাদ। এই নিয়ে নূরীর কোনো অভিযোগ নেই, বরং গর্ব হয়। নূরী জানে বৈশাখ বাঙালিদের জন্য আনন্দের হলেও, কিছু মানুষের বৈশাখ আসাদের মতো কাটে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত