আমাদের মেসের পাশেই একটা প্রাইভেট ক্লিনিক।তো আমরা প্রায়ই বন্ধুরা মিলে সেখানে যাই বিনা কারণেই। আসলে ক্লিনিক শীততাপনিয়ন্ত্রি ত হওয়ায় গরমে সবাই বিনা কারণেই ক্লিনিকে ঢুকে ঘুরাঘুরি করি শরীর ঠান্ডা করার জন্য।এই কাজটা প্রায়ই হতো। কিন্ত একদিন আমি কাউকে না পেয়ে একাই গেলাম। ওয়েটিং রুমে বসে বসে মোবাইল টিপছিলাম আনমনে।
তখনই কেউ একজন বললো,”তুমি কি জানো কত গল্প এখানেই শুরু হয় আর কত গল্পের শেষ ও হয় এখানেই” কথাটা শুনেই আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আমার পাশে এক বৃদ্ধ লোক বসে আছে।আমি আশেপাশে তাকিয়ে আর কাউকে পেলাম না। তার মানে কথাটা উনি আমাকেই বলেছেন। বৃদ্ধের গায়ের রং ফর্সা চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা আর পাশেই একটা লাঠি। সম্ভবত বেশি বয়স হওয়ায় লাঠিতে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন।বৃদ্ধ আমার অবাক চাহুনি না দেখেই আবারও বললো,”কি অবাক হলে কথাটা শুনে! দাড়াও পরিষ্কার করে বলছি”। আমি চুপ করেই রইলাম। কিছুই বলছি না।সাধারণত বৃদ্ধ লোকেরা খুবই গল্প করতে ভালোবাসে।কিন্ত এরা গল্প করার সঙ্গী খুব কমই পায়। আজ কালকের দিনে তো নাতী নাতনী রা মোবাইল ল্যাপটপ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। বৃদ্ধদের সময় দেয়ার মতো কেউ নেই।
বৃদ্ধ উনার পাশে রাখা পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি গিলে নিলো।গল্পের মাঝে মাঝে কিছু মানুষ থেমে যায়।কেউ আবার আয়েশ করে সিগারেট জ্বালায় আবার কেউ পানি খেয়ে শুরু করে। এই সময়ে এরা নিজেদের হার্ট বিট ঠিক করে নেয়।সাংঘাতিক একটা নিয়ম।আবারও বলতে লাগলো,”কতশত গল্প এই হাসপাতালের কেবিনে এসে থেমে যায়। ছেলে বাবাকে হারায়, মা সন্তানকে হারায়। তারপর নার্স এসে সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটার গায়ের উপর একটা সাদা চাদর জরিয়ে দেয়। ব্যাস থেমে যায় একটা গল্প।” আমি চেয়ে রইলাম বৃদ্ধের দিকে। উনি একমনে সামনে তাকিয়ে আছেন। আর নিজের গল্প বলতে একদম ব্যস্ত। আমি শুনছি কিনা সেদিকে উনার মনোযোগ নেই।
আবারও বললো,”শুধু যে গল্প থেমে যায় তা কিন্ত নয়। এই হাসপাতালের কেবিন থেকেই আবার অনেক গল্পের সূচনা হয়।কেউ বাবা হয়,কেউ মা হয়, কেউ মামা আবার কেউ খালা।ওদিকে যেমন কেউ কাউকে হারিয়ে কাঁদছে এদিকে তেমনই খুশির জোয়ার বয়। এই হাসপাতাল একেকজনের কাছে একেকরকমের হয়। কারো কাছে কষ্টের জায়গা তো কারো কাছে খুশির।এই হাসপাতালেরই কোনো এক কেবিনে কেউ বাবা হয়ে মিষ্টি বিলিয়ে দিতে থাকে সবার মাঝে আবার কেউ আপনজনের চিকিৎসার জন্য এক ব্যাগ রক্তের সন্ধানে হন্য হয়ে ছুটে বেড়ায় কত লোকের দারে দারে। এই হাসপাতাল বড়ই বিচিত্র জায়গা।” আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম বৃদ্ধের দিকে। বৃদ্ধের চোখের কোণায় এক ফোটা জল জমেছে তা যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়বে। এখনো একমনে সামনেই তাকিয়ে আছেন উনি। আমি শুনেই যাচ্ছি।
চট করে একটা প্রশ্ন করে ফেললাম, “আপনার ব্যপারটা কি ছিলো? গল্পের শুরু? নাকি শেষ? ” বৃদ্ধের চোখের সেই অশ্রুফোটা গড়িয়ে পড়তে লাগলো এবার।প্রশ্নটা করে কি ভুল করলাম! নিজের কাছেই খারাপ লাগলো।কিন্ত বৃদ্ধ শক্ত মনেই বললো,”আমার একসাথে দুটো অভিজ্ঞতাই হয়েছিলো।আমার স্ত্রী হাসপাতালে আমার মেয়েটাকে জন্ম দিয়েই মারা গিয়েছিলো। একটা গল্পের শুরু হতেই আর একটা গল্পের সমাপ্তি হয়ে গেলো সেদিন।সে এক অন্যরকম অনুভূতি।বড়ই বিচিত্র এই হাসপাতাল নামক জায়গাটা।” আমি নির্বাক হয়ে গেলাম।আসলেই কখনো ভেবে দেখিনি যে হাসপাতাল কতটা বিচিত্র।অথচ এই হাসপাতাল নামক জায়গাটার নাম জন্মের পর থেকেই জানি আমরা।সাধারণ একটা জায়গা কতটা বিচিত্র হতে পারে তা আমরা কজনই বা ভেবে দেখি।
বৃদ্ধ আবার কিছু একটা বলতে লাগলো কিন্ত কোথা থেকে একজন মেয়ে এসে থামিয়ে দিয়ে বললো,”বাবা চলো, আমাদের ফিরতে হবে “। সম্ভবত ইনি বৃদ্ধের মেয়ে।বৃদ্ধ হাতরে হাতরে উনার লাঠিটা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে পড়লেন। তারপর হাটতে লাগলেন। হাটা দেখে এটা বুঝতে পারলাম বৃদ্ধ অন্ধ ছিলো।কিন্ত বৃদ্ধ আমাকে দেখলো কিভাবে! নিশ্চয়ই পারফিউম এর গন্ধ শুকে। অন্ধ লোকদের চোখের দৃষ্টি শক্তি না থাকলেও বাকি ইন্দ্রিয় গুলো খুবই শক্তিসম্পন্ন হয়।চলে যাওয়ার সময় বৃদ্ধের মেয়েটি বললো,”কিছু মনে করবেন না ভাইয়া,বাবা আসলে কাউকে কাছে পেলেই গল্প শুরু করে দেয়। বয়স্ক মানুষ বুঝতেই পারছেন “। বলেই তার বাবাকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। আমার ইচ্ছে করছিলো লোকটাকে ডেকে এনে বসিয়ে দিয়ে বলি, “আসুননা গল্প করি আজ সারাদিন ” কিন্ত সেটা সম্ভব না।
আমরা সবাই কান্নার গল্প গুলো এড়িয়ে চলতে চাই আর হাসির গল্প শুনতেই বেশি আগ্রহ দেখাই। মানুষ যতটা না হাসির গল্প বলে হাসাতে পারে তারচেয়ে বেশি কষ্টের গল্প শুনিয়ে মন খারাপ করিয়ে দিতে পারে । হিউম্যান সাইকোলজি বলছে ‘ হাসির মুহূর্ত গুলো মানুষ বেশিদিন মনে রাখতে পারে না , একি টাইপের কোন ঘটনা চোখের সামনে পড়লেই অবচেতন মন জেগে উঠে ‘ ! আর কষ্টের গল্পের প্রতিটা লাইনে লাইনে অবচেতন মন সাড়া দেয়।ইচ্ছে করছিলো পুরো দিনটা কষ্টের গল্প শুনে কাটিয়ে দিতে পারলে ভালো লাগতো।বৃদ্ধকে এরপর আর কোনোদিনও দেখিনি কোথাও। কিন্ত তার একটা কথা সারাজীবন মনে থাকবে।
“এই হাসপাতাল বড়ই বিচিত্র জায়গা”।