পরিস্থিতি

পরিস্থিতি

– মামনি, আমাকে চকলেট কিনে দেও না!
– না সোনা, দাঁত নষ্ট হবে রোজ চকলেট খেলে।
– দাও না, দাও না

(মেয়ে মীরাকে নিয়ে রাস্তা পার হবার জন্য কৃষ্ণপ্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। মেয়ে চকলেটের জন্য বায়না করছে। মেয়ের বয়স পাঁচ কি ছয়। কিছু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে এক দম্পতি তাদের মেয়েকে নিয়ে। তাদের মেয়ের বয়স সাত হবে। হঠাৎ ছেলেটা এগিয়ে আসে কৃষ্ণপ্রিয়ার দিকে)

– কৃষ্ণ!!!
– (কিছুটা অবাক হয় প্রিয়া) জ্বি কিছু বলবেন
– তুমি এখানে?
– আমার ট্রান্সফার হয়েছে এ শহরে।
– তোমার মেয়ে? বিয়ে করেই নিলে? বলেছিলে তো, অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মানতে পারবে না।
– আমার মেয়ে, মীরা। বয়স সাড়ে পাঁচ। আপনার মেয়ে শ্রেয়া, বয়স সাত।
– কি বুঝালে?
– এই যে আপনিও অনেক কিছু প্রমিজ করেও রাখেন নি
– আমার পরিস্থিতি….
– ব্যাস, মি: শান্তনু।

আমি যদি বিয়ে করে থাকি আর মেয়ে হয়েই থাকে, আপনার কি? এতে কি প্রমান করতে চান, আমি বিশ্বাসঘাতিনী, প্রতারক? তাইলে তাই। আর পরিস্থিতি? কাকে বলেন পরিস্থিতি। চারবছর প্রেম করার পর, বিয়ের কথা বলার পর হুট করে আপনার পরিস্থিতি চলে আসলো। আর এমন পরিস্থিতি যা কিনা একদম বিয়ে করে বিয়ের একবছরের মাথায় বাচ্চাও হয়, তার নাম কিনা রাখেন আমার পছন্দের নামে, শ্রেয়া, যা কিনা আমি চেয়েছিলাম আমাদের সন্তানের নাম রাখতে…..

– কৃষ্ণ আসলেই আমি পরিস্থিতির শিকারে পড়েছিলাম
– আর না, আর শুনতে চাই না। আর রাস্তায় অপমান করতে চাই না। আপনি আসতে পারেন।
– মামনি, তুমি এই লোকটার সাথে কথা বলছো কেন? কে ইনি? তুমি জানো না, অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতে নেই।
– মি: শান্তনু আপনি যান, আমার মেয়ের সামনে আর আমাকে ছোট করবেন না। মীরা মা, চলো।

শান্তনু আর কৃষ্ণপ্রিয়ার পরিচয় বহুদিনের। ভালবাসার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু শান্তনু প্রিয়ার থেকে ভাল কাউকে পেয়ে পরিস্থিতি আর পরিবারের দোহাই দিয়ে বিয়ে করে নেয়। আজ বহুবছর পর দুজন মুখোমুখি হয়। শান্তনু নিজের দোষের কথা ভুলে প্রিয়াকেই দোষী ধরতে থাকে, স্বার্থপর প্রতারক বলতে থাকে। কিন্তু আসল সত্য সে কখনোই জানে না। সারাদিন শুধু এই ভেবে কেটে গেলো, কেন আবার দেখা হলো শান্তনুর সাথে। কৃষ্ণপ্রিয়া সেদিন বিকেল পার করে মোহিনীর সমাধির পাশে বসে থেকে, সাথে মীরাও থাকে। মোহিনী, প্রিয়ার বান্ধবী, সন্তান জন্ম দেবার সময় মারা যায়, আর সন্তান মেয়ে হওয়ায় তাকে মোহিনীর শশুড় ঘরের লোক মানতে পারে নি বলে ছেলের বিয়ে দেয়, সেই সন্তানকেই নিয়ে আসে কৃষ্ণপ্রিয়া, যে কিনা আজকের মীরা।

শান্তনু ছেড়ে যাবার পর জীবনের প্রতি তিক্ত হয়ে যায় প্রিয়া, স্বপ্ন এভাবে ভেঙে যাবে ভাবে নি। এর মধ্যে মোহিনীর এভাবে চলে যাওয়ায় আরো ভেঙে পড়ে, কিন্তু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখে প্রিয়া। মীরাকে নিয়ে নতুন শহরে যায়, ছোট একটা কোম্পানিতে চাকরি নেয়। দুইবছর পর সেটা ছেড়ে একটা মাল্টিন্যাশনালে সেলস ডিপার্টমেন্টে জয়েন করে। তার তিন বছর পর কোম্পানি থেকে বদলি করে ওকে আবার পুরোনো শহরে পাঠিয়ে দেয়। অবশ্য এতটা পথ ও একা আসে নি। ওর এক বন্ধু আর বড় ভাই ওকে সাহায্য করেছিলো। যখন পরিবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো ওর বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে আর মীরাকে নিজের সন্তান হিসেবে মানুষ করতে, তখন ও শহর ছাড়ে বড় ভাইয়ের ভরসায় আর নতুন করে ঘরবাড়ি গোছাতে সাহায্য করে ওর বন্ধু দীপ্ত, যে কিনা আবার মোহিনীর দেবর হয়। এত চড়াই উতরাইয়ের পর আজ কৃষ্ণপ্রিয়া মীরাকে নিয়ে একজন সফল মা, যে সফলতায় সে কলঙ্ক রাখতে চায় না। কিন্তু হঠাৎই শান্তনুর সাথে দেখা যেন বিষিয়ে দেয় প্রিয়াকে।

– মাম্মাম, তোমার কি মন খারাপ?
– কেন মা?
– এই যে এখানে এসে বসে আছো?
– না রে মা, এমনিতেই।
– আচ্ছা এখানে কে আছে?
– এটা একটা সমাধি, যেখানে ঘুমিয়ে আছে একটা পরী, যে পরীটা তোমাকে আমার কাছে দিয়ে গেছে যত্নে রাখতে।
– আমি পরী দেখবো!
– পরী দেখা যায় না মা, কিন্তু পরী তোমাকে আকাশ থেকে দেখছে।
– আচ্ছা মা, পরীটা খুব সুন্দর ছিলো?
– হুম, তোমার মত!
– তাই?
– হুম! এখন চলো বাসায় যাই, যাবার পথে এক বক্স চকলেট কিনে দিবো!
– ইয়ে, চলো চলো।

(উঠে যাবার সময় মনে মনে প্রিয়া বলে, ” আমি যেন তোর মেয়েকে সঠিকভাবে মানুষ করতে পারি, যেন কষ্ট পেতে না দেই। তুই সেই প্রার্থনাই করিস উপর থেকে।)

[জন্ম দিলেও অনেকসময় মা হওয়া যায় না, আবার জন্ম না দিয়েও মা হওয়া যায়। মা দিবসে শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা সকল মায়েদের প্রতি]

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত