সেদিন ভার্সিটিতে নবীনবরণ অনুষ্ঠান চলছিল। ভার্সিটির সব বিভাগের ছেলেমেয়েরা একটা স্থানে জড়ো হয়েছে। সবাই নিজেকে ভালো পোশাকে সুসজ্জিত করেছে। ব্যতিক্রমী নয় সোহেলও! সে ভার্সিটির এক কোণে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছে। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হন বাবা।
‘তার ছেলে এখানে পড়াশোনা করছে।’ সিকিউরিটি গার্ডকে এ কথা বলে বাবা সোজা ক্যান্টিনে গিয়ে ওকে খুঁজতে থাকে। বাবার পোশাক-পরিচ্ছেদ দেখে একজন গার্ড তার পেছন পেছন যায়। ক্যান্টিনে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে,’’কার কাছে আসছেন?’’ বাবা সোহেলের নাম বলল কিন্তু গার্ড ওকে চিনতে পারল না। পরে জিজ্ঞেস করল কোন বিভাগ? কোন সেমিস্টার? বাবা সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারলেন না।
এর মধ্যেই আশপাশের কিছু শিক্ষার্থী কৌতূহলী হয়ে ছুটে আসে। গার্ডকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? গার্ড জানায়, ‘উনি বলছেন, ওনার ছেলে নাকি এখানে পড়াশোনা করেন। কিন্তু বিভাগ, সেমিস্টার কিছুই জানেন না। তার ফোন নম্বরও নাকি বন্ধ।’ ছেলেগুলো বাবার সঙ্গে কথা বলা শুরু করে। তা দেখে আশপাশের ছেলেমেয়েরাও জড়ো হতে থাকে। সোহেল দূর থেকে জটলা দেখে। কি হচ্ছে তা দেখতে ও এগিয়ে আসে। কাছাকাছি এসে বাবার চোখে চোখ পড়ে ওর। দুজনই থমকে যায়। সোহেল কোনো কথা না বলে অন্যদিকে চলে যায়। দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাবা ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা বিষয়টি বুঝতে পারেন। তাকে এই কাপড়ে দেখে ও পরিচয় না দিয়ে এড়িয়ে গেল!
বাবা চোখ দুটোকে নিচে নামিয়ে ফেলেন। তার চোখগুলো যেন অপলকভাবে ফ্লোরের স্কয়ার টাইলসগুলোর পরিমাপ করছিল। টাইলসের এই পরিমাপই যেন তার একমাত্র কাজ! সে নির্লিপ্তিভাবে তাকিয়ে ছিল টাইলসের দিকে, আর ছেলেগুলো তাকিয়ে ছিল বাবার দিকে। বাবা এতক্ষণ নিজের পোশাকের দিকে দৃষ্টিপাত করেনি। কিন্তু সোহেল যখন এভাবে চলে গেল বাবার তখন ভাবান্তর হলো। পুরাতন জামাকাপড় পড়ায় ও বন্ধুদের সামনে বাবাকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারল না! বাবাকে ঘিরে থাকা ছেলেমেয়েরা তখনো বাবাকে নানা প্রশ্ন করছিল। উদ্দেশ্য যেন বুড়োটি যেন তার ছেলেকে খুঁজে পায়। বাবা ভাবলেন,তার এখানে থেকে আর কাজ নেই। ছেলে তাকে দেখে এড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ সে চায় না এভাবে তার বাবাকে দেখতে, এভাবে তার বাবার সঙ্গে অন্য কাউকে পরিচয় করিয়ে দিতে। কাজেই আর ছেলের পরিচয় দিয়ে ওর সম্মানকে খাটো করা ঠিক হবে না।
বাবা নিচে রাখা ব্যাগ দুটো হাতে তুলে নিলেন। চারদিকে একবার তাকিয়ে ভার্সিটির গেটের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। খুব ইচ্ছে করছিল ছেলেটিকে আরেকটি বার দেখতে। কথা না বলুক। বাবা বলে ডাক না দিক। তবুও সন্তানের চাহনি, সন্তানের স্পর্শ বাবা-মায়ের কাছে স্বর্গসুখের মতো। সে রকম একটু সুখ পেতে বাবার বুকটা খা খা করছিল। তাই বাবা শেষবারে মতো গেট থেকে ক্যান্টিনের দিকে তাকালেন।
কিন্তু তার অতৃপ্ত মনটা অতৃপ্তই রয়ে যায়, দেখতে পেলেন না সোহেলকে। বাবার সঙ্গে সোহেলের শেষ দেখা সেখানেই। এরপর আর দেখা হয়নি তাদের। কিন্তু আজ দেখা হয়ে গেল দুজনের! বাবা শুয়ে আছেন। কবরে শুয়ে আছেন। সোহেলে দাঁড়িয়ে আছে বাবার কবরের পাশে। পাথরের মূর্তির মতো সে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে নিষ্পলক বাবার করের পানে। স্মরণ করছে বাবার সঙ্গে কেমন আচরণ সে করেছে! দৃষ্টির অগোচরে ফুলের সৌন্দর্যে মাটির যে অনস্বীকার্য অবদান থাকে, তেমনি সোহেলের জীবন পরিস্ফুটিত হওয়ার পেছনেও একচ্ছত্র অবদান রয়েছে ওর বাবার। মানুষ যেমন ফুলের সৌন্দর্য দেখে, মাটির অবদান দেখে না তেমনি সোহেলও নিজের শহুরে জীবন দেখে, কিন্তু এর পেছনে তার বাবার অবদান দেখে না! এদিক দিয়ে বাবার সঙ্গে সোহেলের সম্পর্ক মাটির সঙ্গে ফুলের সম্পর্কের মতো!
বাবা টুকটাক ডায়েরি লিখত এটা ও জানত। বাবার না বলা কথাগুলোর কিছু হয়তো সে ডায়েরিতে থাকতে পারে। এ কথা ভেবে সোহেল বাবার ঘরে ঢুকল। টেবিলের ওপরে রাখা চাবি দিয়ে ট্রাংক খুলল। কিছু জামাকাপড়ের নিচে লালচে রঙের ভারি একটি ডায়েরি পাওয়া গেল। সেখানকার শেষ লেখাটি- আমার কলিজার টুকরা সন্তান। তোমাকে অনেক ভালোবাসি। শিশু বয়সে তোমার মা তোমাকে এতিম করে চলে গেল ; কিন্তু আমি তো যেতে পারলাম না! যে বয়সে মানুষ স্ত্রীকে নিয়ে সুখের ঘর করে সে বয়সে আমি তোমার মাকে হারাই। তোমার মাকে হারানোর কষ্ট বুকে চেপে তোমার মুখের দিকে চেয়ে বিয়ের কথা কখনো চিন্তাও করিনি। তোমার সুখের মাঝেই আমার সুখকে খোঁজার চেষ্টা করেছি সারাজীবন।
দোয়া করি আল্লাহ তোমাকে স্বাবলম্বী করেন। ভালো রাখেন। তোমার কোনো ভুলই আমার কাছে অপরাধ না। তুমি যত বড়ই হওনা কেন আমার কাছে তুমি চিরদিন সেই ছোট্ট খোকাই হয়ে থাকবে। আর তোমার ভুলগুলোও আমার কাছে ভুল নয়, ছেলেমানুষি হয়ে থাকবে। ভালো পরিবেশে আমাকে খারাপ কাপড়ে দেখে তুমি লজ্জা পেয়েছো। কিন্তু একই রকমভাবে এই পোশাকে সেখানে যেতে আমারোও কম লজ্জা লাগেনি। কিন্ত তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা লজ্জা অপেক্ষা বেশি নয়। তাই আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল ওই পোশাকে তোমার কাছে ছুটে যাওয়া। অনিচ্ছাকৃত তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে আমাকে ক্ষমা করে দিও।
এখন তুমি সুন্দর এক জোড়া জুতা, সুন্দর একটা শার্ট দেখে কল্পনা করো তোমাকে এই পোশাকে কেমন লাগবে! আর যখন তুমি বাবা হবে তখন কল্পনা করবে এই সুন্দর পোশাকে তোমার সন্তানকে কেমন দেখাবে! এটাই হচ্ছে সন্তান আর বাবার মধ্যে পার্থক্য। তোমার সন্তান যেন তা বুঝতে পারে। আমার সঙ্গে তোমার যা হয়েছে তার জন্য আমি কখনোই তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়নি! তবে দোয়া করি,তোমার সন্তান যেন কখনোই তোমার সঙ্গে এমনটা না করে। আমি চাই না আমার সন্তান সেই যন্ত্রণা ভোগ করুক। আমি আমার কষ্ট সহ্য করতে পারলেও তোমার কষ্ট হবে, এমনটা সহ্য করতে পারব না। আমি যে তোমার বাবা। বাবারা যে সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে পারে না।
আমি চাই আল্লাহ তোমাকে সম্পদশালী করুন! তুমি মন ভরে তোমার সন্তানের প্রয়োজনীয়তাগুলো পূরণ কর। বাবা হয়ে সন্তানকে দিতে না পারার মধ্যে যে তীব্র যন্ত্রণা, আল্লাহ যেন কখনোই তোমাকে তার মুখোমুখি না করেন। দোয়া করি তোমার সন্তান যেন তার প্রতি তোমার ভালোবাসাকে বুঝতে পারে। তোমার ভালোবাসার প্রতি অবজ্ঞা না করে। কেননা সেটা পাঁজর ভাঙার যন্ত্রণা থেকেও বেশি যন্ত্রণাদায়ক।