আর্তনাদ

আর্তনাদ

আজ দীর্ঘ বারো বছর পর আসাদ জেল থেকে মুক্তি পেল। বাসস্ট্যান্ডে এসে নিমতলীর টিকিট কেটে বাসে উঠলো। বারো বছর আগে সেখানের এক বস্তিতে আসাদ তার পরিবারকে নিয়ে থাকতো। পরিবারে ছিল তার ছোট বোন অনু, ছোট ভাই অন্তু ও মা রোকেয়া। দীর্ঘ বারো বছর পর তাদের সাথে দেখা হবে ভেবেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে আসাদ। মা ও ভাইবোন তাকে দেখে নিশ্চয়ই খুশি হবে। জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করবে। যদিও সবুর সন্দিহান তার ভাইবোন নিমতলীতেই আছে কিনা! সময়ের সাথে মানুষের সবকিছুর পরিবর্তন হয়। অনুর বিয়ে হয়েছে তা জেলে বসেই জেনেছিল আসাদ। নিশ্চয়ই এতদিনে অন্তুরও বিয়ে হয়েছে। তাহলে নিশ্চয়ই মা আমার কাছে থাকবে এই নিয়ে তাদের মধ্যে যুদ্ধ চলে। এই ভাইবোনদের মানুষ করতে আসাদ ও তার মা অনেক সংগ্রাম করেছে।

আজ থেকে সাতাশ বছর আগে আসাদের জীবনের সংগ্রামী অধ্যায় শুরু হয়। তখন তার বয়স মাত্র তেরো। বাবাকে হারিয়ে চার সদস্যের পরিবারকে নিয়ে চরম দুর্ভোগে পড়ে তাদের মা। খেলার বয়সেই আসাদ বুঝে যায় মায়ের পক্ষে একা এই দায়ভার নেওয়া সম্ভব না। তাই বাবার রেখে যাওয়া একমাত্র সম্বল ভ্যানগাড়িটা নিয়েই আসাদ জীবন যুদ্ধে নেমে পড়ে। আসাদ সারাদিন রোদে পুড়ে ভ্যানগাড়ি চালিয়ে মহল্লা ও রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াত। তখন আসাদের বোন অনুর বয়স ছিল ১০ বছর আর অন্তুর বয়স ৪ বছর।

তাদের মা রোকেয়া মানুষের বাসায় কাজ করত। সেখান থেকে পাওয়া ভাত তরকারি দিয়ে কোনোমতে তাদের দিন চলতো। আসাদ নিজে পড়ালেখা করতে না পারলেও ভাইবোনকে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে। অনুর যখন পনেরো বছর হয় তখন তাদের এক প্রতিবেশী রীমা কাকী অনুকে গার্মেন্টসে চাকরি দিতে চায়। রোকেয়া রাজি হলেও আসাদ রাজি হয়নি। সেদিন দৃঢ়তার সাথে মাকে বলেছিল, “আগে ওদেরকে মানুষের মতো মানুষ করব। তারপর চাকরি। প্রয়োজনে রক্ত বেঁচে ভাইবোনদের পড়ালেখা করাব।”
অনেক কষ্ট করেছে এই ভাইবোনের জন্য। আজ সেই ভাইবোনের মুখোমুখি হবে আসাদ।

“এই নিমতলী, নিমতলী।” বাস হেল্পারের উচ্চস্বরের চিল্লানীতে আসাদ চোখ খুলল। বাস থেকে নেমে পড়লো। বারো বছর আগের দেখা নিমতলী। যদিও আগের কিছুই নেই। রাস্তার ধারে এই ল্যাম্পপোস্টের নিচে থাকা মানিক চাচার সেই চায়ের দোকান আজ আর নেই। ওখানে এখন একটা রেস্টুরেন্ট দেখা যাচ্ছে। নেই আশেপাশের সেই খোলা মাঠ, নেই সেই বস্তিও। আছে সেখানে বড় বড় অট্টালিকা ও দোকানপাট। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রীমা কাকীকে পেল। আগেরমত নেই।

বয়সের ছাপ পড়েছে। তার থেকে জানতে পারলো আসাদ জেলে যাওয়ার বছরখানেক পরেই তার পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। আসাদ বেশ চিন্তায় পড়ল। চোখ দুটো মা ও ভাইবোনকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু এখন তাদেরকে কোথায় পাবে? জেলে যাওয়ার পর দেখা করতে আসাদই নিষেধ করেছিল। তবুও মা, অনু ও অন্তুকে নিয়ে মাঝেমাঝে আসত। আসাদ তার মাকে বলত, “এখানে এসো না। এতে ওদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। ওদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলো। আমার কথা ভুলে যাও।” মায়ের মন কি আর তা মানতো? রোকেয়া মাঝেমাঝে একাই আসতো। তবে বছরখানেক পর আর আসেনি।

গাজীপুরের উদ্দেশ্যে বাসে উঠেছে আসাদ। অনুর কলেজ থেকে ঠিকানা জোগাড় করেছে। কলেজ থেকে জানতে পারলো অনু এখন ডাক্তার। আসাদ খুব খুশি হলো। আসাদের স্বপ্ন ছিল অনুকে ডাক্তার বানাবে আর অন্তুকে পুলিশ। অনুকে ডাক্তার বানানোর লক্ষ্যে দশ বছর ধরে আসাদ তার নিজের জমা করা টাকা নির্দ্বিধায় মেডিক্যাল ভর্তির জন্য ব্যয় করেছিল। সেদিনটা আসাদের আজও মনে আছে। মেডিক্যালে সুযোগ পাওয়ার পর অনুর মনটা উদাস ছিল। খুশির দিনেও উদাস কেন জানতে চাওয়ায় অনু বলেছিল এডমিশন ফি অনেক। আসাদ শুধু অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, “তুই একদম চিন্তা করিস না। আমি আছি তো।” এত বছর ধরে জমানো টাকা আসাদ সেদিন অনুর জন্য খরচ করে দেয়। সেদিন রোকেয়ার চোখে অশ্রু ছিল। তবে সেটা গর্বের। আসাদ নিজ চোখে অনুকে ডাক্তার হতে দেখেনি। তার আগেই জেলে চলে যায়।

আসাদ গাজীপুর নামলো। ঠিকানা অনুযায়ী রূপসী এপার্টমেন্টে এলো। অনুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় দারোয়ান অপেক্ষা করতে বলল। বেশ কিছুক্ষণ পর একটা ফুটফুটে বাচ্চা সহ অনুকে আসতে দেখল। আসাদ বুঝলো যে এটা অনুর ছেলে। আসাদ এক নজরে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘ বারো বছর পর আদরের ছোট বোনকে দেখে আসাদের চোখে পানি চলে এলো। সামনে আসতেই আসাদ বলল, “কেমন আছিস অনু?” পলকহীন দৃষ্টিতে আসাদের দিকে তাকিয়ে আছে অনু। চেনা চেনা লাগছে কিন্তু দাড়ি, গোফের কারণে ঠিক চিনতে পারছে না।

হাসিমাখা মুখে আবেগ ভরা কণ্ঠে আসাদ বলল, “কিরে চিনতে পারছিস না? আমি আসাদ। তোর ভাই।” অনুর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। খুশির পরিবর্তে যেন আতংকিত হয়েছে। আসাদকে এক পাশে নিয়ে গেল। তারপর বলল, “আমার সোজা কথা শুনো। আমি এখন একজন ডাক্তার। ওর [ছেলে] বাবাও একজন ডাক্তার। এই সমাজে আমাদের একটা মান সম্মান আছে। এখন কেউ যদি জানে একটা আসামী আমার ভাই। তাহলে আমাদের মান সম্মান কোথায় দাঁড়াবে, তা তুমিই চিন্তা কর। ওর বাবা খুব রাগী মানুষ। তাছাড়া আমি কাউকে বলিনি যে আমার আরও একটা ভাই আছে।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল অনু। নিঃশব্দে শুনে গেল আসাদ।

তার মনে হলো এতক্ষণ কেউ একটা ছুরি দিয়ে বুকের ভেতরে অনবরত খুঁচিয়েছে। তবুও মুখে হাসি নিয়ে বলল, আমি তোর ক্ষতি চাই না। মা আর অন্তুর সাথে একবার দেখা করে চলে যাব।” বেশ কিছুক্ষণ অনু চুপ করে রইল। তারপর বলল, “মা দুই বছর আগে মারা গেছে।” কথাটা শুনে কষ্টের তীব্রতায় দাঁড়ানোর শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে আসাদ। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। চোখ দুটো ছলছল করতে লাগল। অনুর যেন তাড়া আছে। সে বলল, “ওর বাবা আসার সময় হয়ে গেছে।” অনুর এই বাক্যটা পাল্টে গিয়ে আসাদের কানে বেজে উঠল, “এক্ষুণি চলে যাও।” আসাদ কোনোমতে বলল “অন্তু?” অনু একটা কার্ড দিয়ে বলল, “অন্তু এখানে থাকে।”

“মায়ের কবরটা কোথায়?”
“অন্তুর বাসার পাশেই।” ভাগ্নের দিকে ইশারা করে বলল, “ওর নাম কি?”
“আয়ান।”

রাত প্রায় এগারোটা বাজে। অনু এখনও ঘরে ফিরেনি। মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে অনু একটু দেরি করে ফিরে। এই নিয়ে আসাদ কিছু বললেই অনু পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে। তবুও আজকের মতো দেরি আগে কখনো হয়নি। অনুর বন্ধুবান্ধব থেকে খবর নিয়ে জানতে পারল অনু তার এক বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে গিয়েছে। আসাদ ঠিকানা নিয়ে সেখানে চলে এল। কিন্তু পার্টির কোনো আভাস পেল না। বাড়ির সামনে যেতেই অনু চিত্‍কার চেঁচামেচি শুনতে পেল। “প্লিজ ছাড়ো শুভ।” আসাদ ঢুকে পড়ল। “ওই, কে রে তুই? যা বাইরে যা।”

অপ্রীতিকর পরিস্থিতি দেখে আসাদের মাথায় রক্ত উঠে গেল। হাতের কাছে থাকা একটা ভারী বস্তু দিয়ে শুভকে জোরে আঘাত করল। এতে ঘটনাস্থলেই শুভ মারা যায়। অনু নির্বাক হয়ে যায়। আসাদও যেন বুঝতে পারল এটা তার ভুল হয়েছে। আসাদ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর অনুকে বলল, “তুই বাসায় যা। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি সব ব্যবস্থা করব।” কাঁদতে কাঁদতে অনু চলে গেল। আসাদ আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আর্থিক লেনদেনের কথা উল্লেখ করে রাগের মাথায় এই ঘটনা ঘটেছে বলে স্বীকার করে আসাদ। এটার জন্যই তার বারো বছরের জেল হয়েছে।

অতীত মনে পড়তেই আসাদের চোখে বেয়ে জল গড়িয়ে এলো। আসাদ ভাবতে লাগল, এই কি সেই অনু, যার সম্মান বাঁচাতে গিয়ে জীবনের বারোটা বছর হারিয়েছি? সেদিন নিজের কথা চিন্তা করিনি। বোনের সম্মান ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেছিলাম। অথচ আজ সেই বোন পরিচয়ই দিল না। তার কাছে আজ আমি ভাই না, একজন আসামী। অথচ এই খাতে নামটা তার জন্যই লিখিয়েছিলাম। ইঞ্জিনিয়ার অন্তু আকন্দ। ভাবতেই আসাদের বুকটা ফুলে উঠল, তার সেই ছোট অন্তু আজ ইঞ্জিনিয়ার। বেশ কিছুক্ষণ ধরে অন্তুর বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আসাদ। “ভাই সাইডে চাপেন। স্যারের গাড়ি আসছে।” দারোয়ান বলল।

আসাদ গাড়িটার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে। গাড়িটা তার সামনে দাঁড়াল। গ্লাস নিচে নামলো। অন্তু আগেরমত নেই। তবে খানিকটা মিল আছে। আসাদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। অন্তুর গাড়ির কাছে যেতেই অন্তু কিছু টাকা ও কার্ড দিয়ে বলল, “এই নাও টাকা এবং আমার কার্ড। নেক্সট টাইম এখানে আসবে না। টাকার প্রয়োজন হলে কল দিবা শুধু। এখানে আমার একটা ফ্যামিলি আছে, স্ট্যাটাস আছে। কেউ যদি জানতে পারে একটা আসামী আমার___। তবে আমার স্ট্যাটাস ডাউন হবে। তাছাড়া আমার শ্বশুর একজন পুলিশ কমিশনার।”

অনুর সুরই যেন অন্তুর গলায় পেল আসাদ। মন আগেই ভেঙেছে তাই অন্তুর কথায় খুব একটা কষ্ট পেল না আসাদ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসাদ বলল, “আমি শুধু একবার মায়ের কবরটা দেখতে চাই। খুব সুন্দর করে মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধিয়েছিস তো?” “না, মানে তখন এত টাকা পয়সা ছিল না। তাই পাশের কবরস্থানেই কবর দিতে হয়েছিল।” আসাদের বুকটা হাহাকারে ভরে উঠল। না, আর দাঁড়ানো যাবে না। অন্তুর দেওয়া টাকা এবং কার্ড অন্তুর হাতে দিয়ে নিরুদ্দেশ ভাবে হাঁটা দিল আসাদ।

“না, না, না আমার একটা বড় ছবি লাগবে।” অন্তু অনবরত কান্নাকাটি করে কথাটা বলেই যাচ্ছে। অন্তু জিদ ধরেছে ঘরের মধ্যে তার একটা বড় ছবি লাগবে। রোকেয়া অনেক বুঝাল যে পরে বানাবো। কিন্তু অন্তু নাছোড়বান্দার মতো করতে লাগল। মাসের শেষ দিক। হাতে এখন তেমন একটা টাকা পয়সা নেই। তবুও ছেলের বায়নার কাছে রোকেয়া হার মেনে একটা বড় ফ্রেম করে অন্তুর ছবির অর্ডার দিল। দুদিন পর যখন নিয়ে এলো তখন ছবিটা দেখে অন্তুর খুশির সীমা রইল না। তা দেখে রোকেয়ার বলল, “আমার টাকা উসুল হয়ে গেছে।” পুরানো কথাগুলো মনে পড়তেই লোনাজলে আসাদের চোখ ভেসে উঠল। আচ্ছা এটা কি সেই অন্তু? যার খুশির জন্য মা সবকিছু করত। অথচ আজ সেই অন্তু মায়ের কবরের চিহ্নটা পর্যন্ত রাখেনি। টাকা তখন ছিল না তো কি হয়েছে? পরে যখন হয়েছে তখন তো পারত মার্বেল দিয়ে কবরটা বাঁধতে।

“এই প্রস্তাবে তুমি রাজি হয়ে যাও আসাদের মা। তাহলে আর কোনো কষ্ট থাকবে না।” “নারে ভাবী, বিয়ে আর করব না। এখন এই সন্তানদের ভরণপোষণই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।” রোকেয়ার জন্য ভালো একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে রীমা। পাত্রের দুইটা ট্রাক আছে। ভালো ইনকাম করে। ছেলেমেয়ের দায়িত্বও নিবে। খুব সুখে রাখবে। এমন আরও অনেক কথা বলে বুঝানো চেষ্টা করলো রীমা কিন্তু রোকেয়া রাজি নয়। তার একটাই কথা সন্তানই তার জীবন। আড়াল থেকে সবই শুনেছে আসাদ। সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞতা করলো মায়ের চোখে কোনোদিনই পানি আসতে দিবে না। আসাদ জেলে যাওয়ার পরে এই মায়ের চোখে কত যে অশ্রু গড়াগড়ি করেছে তার হিসাব নেই। অনু ও অন্তু যে বিন্দু পরিমাণ মায়ের খেয়াল রাখেনি তা নিয়ে আসাদের কোনো সন্দেহ নেই। অথচ এই সন্তানদের জন্য রোকেয়া অন্যের সাথে সুখের সাগরে পাড়ি দেয়নি। মায়ের আত্মত্যাগের কথাগুলো ভাবতেই আসাদের বুকটা হাহাকারে ভরে উঠলো।

অন্তুর বাড়ির পাশের কবরস্থানে এলো আসাদ। শুধু কেঁদে যাচ্ছে আর বলছে মা তুমি কোথায়? কোন কবরে তুমি আর্তনাদ নিয়ে শুয়ে আছ? এই দেখ তোমার অধম ছেলেটা চলে এসেছে। একটিবার আসাদ বলে ডাক দাও না মা। তোমার বুকে তো আর ঠাঁই পাব না। তোমার কবরটাকে জড়িয়ে ধরেই না-হয় কিছুক্ষণ কাঁদবো। মা, মাগো কোথায় তুমি? আসাদ একটা কবরের ওপর শুয়ে পড়ে অঝোরধারায় কাঁদতে লাগল। আর বলতে লাগল, আমাকে মাফ করে দিও মা। তুমি সন্তানদের জন্য শত ত্যাগ স্বীকার করেছ। বিনিময়ে কিছুই পাওনি। সুখ দেখার সৌভাগ্য তোমার হয়নি। মাগো, এই স্বার্থপর দুনিয়ায় আমার না আর ভালো লাগছে না। আমাকে তোমার কাছে নিয়ে নাও। আমি তোমার কাছেই সুখে থাকবো। আসাদ কাঁদতে লাগল আর মনের কষ্ট গুলো বলতে লাগল। জানো মা, যে অনুর জন্য জেল খেটেছি। সেই অনু নাকি আজ আমাকে ভাই বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়। যে অন্তুর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য নিজের রক্ত মাংসে গড়া সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছি সে অন্তু আজ আমাকে টাকার গরম দেখায়। খুব কষ্ট লাগে মা।

আর্তনাদে বুকটা ফেটে যায় মা। আচ্ছা মা, তুমি কি ওদের দেওয়া কষ্ট সহ্য করতে না পেরে চলে গিয়েছ? এই কথাটা ভাবতেই আসাদের অশ্রুসিক্ত চোখ দুটো লাল হতে লাগল। চোখমুখ মুছে বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তুমি ওদের দেওয়া কষ্ট সহ্য করতে না পেরে চলে গেছ। আমি এর প্রতিশোধ নিব। ভয়ানক প্রতিশোধ নিব। ঠিক তখনই আসাদের সত্ত্বা নাড়া দিয়ে উঠলো। আচ্ছা ভুলটা তো অনুর। তাই বলে আয়ানকে মাতৃহীন করা কি ঠিক হবে? ভুলটা অন্তু করেছে। তাই বলে একটি স্ত্রীকে স্বামী হারা করা কি একই ভুল নয়? এ তো পাপ। আসাদ বসে পড়লো। যাইহোক ওরা তো আমারই ভাইবোন। এই দুই হাতে ওদের মানুষ করেছি। এই দুই হাতেই ওদের ক্ষতি করতে পারব। এভাবে বিড়বিড় করতে করতে আসাদ কবরের ওপরই ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে উঠে আসাদ নিমতলী চলে এলো। বাকি জীবনটা এই নিমতলীতেই কাঁটাবে। এখানে মায়ের স্মৃতি আছে। ওই তো, এই পানির কল থেকে তার মা রোজ সকালে কলসি করে পানি নিত। ওই তো, এই মুদি দোকান থেকে মা হাজারো অনুরোধ করে সদাপাতি নিত। এই তো, এখানে রীমা কাকীর ঘর ছিল। মা এখানে বসে গল্প গুজব করত। এই তো, এই ঘরে তার মা তাদের নিয়ে থাকত। যদিও এখন আর নেই সে পানির কল, মুদি দোকান ও ঘর। তবুও স্মৃতি আছে। চোখ বন্ধ করলে আসাদ সেই স্মৃতি দেখতে পায়। তা দিয়েই বাকি জীবন কাঁটাতে পারবে। ল্যাম্পপোস্টের নিচে আসাদ বসলো। পাশে লক্ষ্য করলো তার মাও তার সাথে বসে আছে।

“মা, তুমি!”
“আমি তোর সাথে সবসময়ই আছি।” ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গেল রোকেয়া। সেই সাথে গড়িয়ে পড়ল আসাদের চোখের জল। মনে মনে বলল, “ভালো থেকো মা।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত