বেতনের খামটা হাতে নিয়ে ঝিম মেরে বসে আছে আসাদ। ঈদের বোনাস সহ তিরিশ হাজার টাকা পেয়েছে। সাংসারিক যাবতীয় খরচ বাদেও এই মাসে ঈদের খরচ যোগ হয়েছে। আসাদ মধ্যবিত্তদের একজন। আমাদের সমাজের এই শ্রেণিটা না পারে ছাড়তে, না পারে ধরতে। ভালো পরিবেশ তারা ছাড়তে পারে না আর উচ্চ পরিবেশ তারা ধরতে পারে না। তাদেরকে অনিচ্ছার সত্ত্বেও সবকিছু চালিয়ে যেতে হয়। পাশের বাসায় একটা ভালো ফ্রিজ আছে। নিজের বাসাতেও একটা ভালো ফ্রিজ লাগবে। এভাবেই মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে চলে একধরণের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আসাদও তাদের একজন। ঈদ উপলক্ষে স্ত্রী এবং সন্তানদেরকে ভালো কিছু দেওয়া যে সে নিজের দায়িত্ব মনে করে।
বেতনের খামটা পকেটে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল আসাদ। স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ে ও গ্রামে থাকা বাবা এই চার সদস্যের দায়িত্ব আসাদের কাঁধে। তবে ঈদ উপলক্ষে এই দায়িত্ব কিভাবে যেন বেড়ে যায়। আত্মীয়স্বজনও যোগ হয়। বাবাকে বলেছে শহরে চলে আসতে। কিন্তু তার মন নাকি শহরের বন্দী পরিবেশে টিকে না।
ঘরে প্রবেশ করতেই আসাদের ছয় বছরের ছোট মেয়ে আভা নাচতে নাচতে বলল, “বাবা, কাল আমরা শপিংয়ে যাব তাই না?” আজ রোজা পঁচিশটা শেষ। ঈদের চার কিংবা পাঁচ দিন বাকি। তারমধ্যে আগামীকালই শেষ শুক্রবার। তাই শপিং আগামীকালই করতে হবে। এছাড়া আর সময় পাবে না। আসাদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ মা, কালই যাব।” আভা নাচতে নাচতে নূরীর কাছে গিয়ে বলল, “কালকে আমরা বাজার করতে যাব। বাবা বলেছে।” খুব সুন্দর করে টেনে টেনে কথা বলে আভা। শুনলেই আসাদের পরানটা জুড়িয়ে যায়।
পরেরদিন জুমার নামাজ পড়েই আসাদ পরিবার নিয়ে শপিংয়ের উদ্দেশ্যে বের হলো। রোজার শেষ দিকে রাতে শপিংয়ে খুব ঝামেলা হয়। লোকজনের ভীড়ে পা ফেলতেও কষ্ট হয়। তারওপর পকেটমারের উপদ্রব। এছাড়াও রাতে বের হলে তারাবী মিস হয়। তাই আসাদ দুপুরেই বের হলো। শপিংয়ে এসে রংবেরঙের কাপড় দেখে আভা তার মিষ্টি সুরে বলছে, “ওয়াও বাবা দেখছ? কি সুন্দর জামা!” আভা শুধু প্রশ্ন করে যাচ্ছে বাবা এটা কি মা ওটা কি? আসাদ-নূরী দুজনেই উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। বড় ছেলে ফাহাদের জন্য জামা, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, জুতো, ছোট মেয়ে আভার জন্য লেহেঙ্গা, সুতি কাপড়‚ জুতো ও কিছু কসমেটিকস এবং বাবার জন্য পাঞ্জাবি পায়জামার কাপড় কিনলো আসাদ। তারপর আত্মীয় স্বজনদের জন্য কিছু জামা কাপড় কিনলো। টুকিটাকি সবার জন্য কেনার পর নূরীর উদ্দেশ্যে আসাদ বলল, “চল, এবার তোমার জন্য একটা শাড়ি কিনবো।”
“আমার কিছু লাগবে না। তোমার জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনো।”
“আমার তো আছেই। তুমি কিছু কিনো।”
এভাবে কিছুক্ষণ তাদের তর্ক চললো। কেউই কিছু কিনতে রাজি হলো না। নূরী জানে ঈদ এলে ব্যাপক খরচ হয়। তাই সে নিজের জন্য কিছু কিনতে রাজি হয়নি। আর আসাদ জানে পকেটের অবস্থা শোচনীয়। সন্তানদের মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছে এতেই সন্তুষ্ট সে। তবুও ফাহাদের মুখ কিছুটা ভারী। ঈদ উপলক্ষে সে একটা নতুন এন্ড্রয়েড চেয়েছে। নূরী বুঝিয়ে বলেছে, যদি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে তবেই মোবাইল পাবে। শপিং শেষে বাসায় ফিরলো তারা। আভা তার সবকিছু আলমারিতে সাজিয়ে রাখতে ব্যস্ত। ঈদের আগে কাউকে দেখালে নাকি পুরান হয়ে যাবে। ফাহাদ কিছুক্ষণ দুষ্টামি করলো দেখার জন্য। কিন্তু আভা নিজ সিদ্ধান্তে অটল। কোনোমতেই সে দেখাবে না। যখন আভা বুঝতে পারে অবস্থা বেগতিক, তখন দৌড়ে বাবার কাছে ছুটে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার আলমারির দিকে ফিরে আসে। ফাহাদকে দেখে আবার দৌড় দেয়। নূরী শুধু ভাইবোনের কান্ড দেখে যায়। ঈদ মানে তো খুশি ও আনন্দ। এই তো ঈদ। এই তো আনন্দ।
গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ট্রেনের টিকিট আগেই কেটে রেখেছিল আসাদ। আজ ২৮শে রমজান। আসাদ কখনোই অফিস মিস করে না। ঝড়, বৃষ্টি, তুফান‚ অসুস্থতা কোনো কিছুতেই আসাদ সহজে অফিস মিস দেয় না। তাই ঈদ উপলক্ষে তার বস তাকে আগেই ছুটি দিয়ে দেয়। গ্রামে এসে নূরী আত্মীয় স্বজনদের জন্য কেনা জামাকাপড় শ্বশুরের হাতে তুলে দিলো।
“আমাকে দিয়ে লাভ কি? ওরা তো আসবেই। তখন দিয়ে দিও।”
“না বাবা, আমরা চাই আপনি নিজ হাতেই দিন।”
নূরীর মাথায় হাত বুলিয়ে জাকের সাহেব বললেন, “তোর মতো পুত্রবধূ পেয়ে আমি গর্বিত। আমার পরিবারটাকে তুই খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিস।” “এটা তো আমারই পরিবার, বাবা।” নূরী অন্য ব্যাগ খুলে একটা প্যাকেট বের করে শ্বশুরের হাতে দিয়ে বলল, “এই পাঞ্জাবিটা আপনার জন্য।” “কি দরকার এসবের? আমার এমনিতেই অনেকগুলো পাঞ্জাবি আছে। আমি আসাদকে বারণ করেছিলাম। কেন টাকাগুলো নষ্ট করলো?” “আছে তো কি হয়েছে? আরও হোক। প্রতিদিন একটা একটা পরবেন।” নূরীর কথা শুনে জাকের সাহেব হাসলেন।
আজ ঈদ। নূরী ব্যস্ত রান্নাবান্নায়। আভা ব্যস্ত সাজতে, জাকের সাহেব, আসাদ ও ফাহাদ ব্যস্ত নামাজের জন্য ঈদগা যাওয়ার প্রস্তুতিতে। ফাহাদ নতুন জামা পরলো, সুগন্ধি আতর দিলো। জাকের সাহেবও নতুন পাঞ্জাবি পরলো। শুধু আসাদ পুরানো পাঞ্জাবি পরলো। তা দেখে জাকের সাহেবের চোখ দুটো ছলছল করতে লাগল। জীবন বুঝি বৃত্তাকার। যেই বৃত্ত থেকে শুরু হয় একটা সময় সেই বৃত্তে এসেই আবার মিলিত হয়। একটা সময় ঐতিহ্য ধরে রাখতে জাকের সাহেব পরিবারের সবাইকে নতুন কাপড় কিনে দিতেন। অথচ নিজে পুরাতন জামা দিয়ে ঈদ করতেন। এই ঐতিহ্য তার বাপ দাদারা রেখে গেছে। আজ একই জিনিস ছেলে করছে। জাকের সাহেবের প্রতিচ্ছবি যেন ছেলের মাঝে ফুটে উঠেছে। তিনি ছেলেকে এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না। এতে হয়তো ছেলে লজ্জা পাবে। বাবার চোখে যেন আসাদ অনেক কিছুই পড়ে নিয়েছে। মনে মনে বলল যতদিন সুস্থ আছি এই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করব। আচ্ছা এই ঐতিহ্য ধরে রাখা সত্যিই কি খুব দরকার? মোটেই না। ইসলাম বলে, আগে নিজের ঘরে আলো দাও। তারপর পরের ঘরে।
হালকা মিষ্টি মুখ করে আসাদরা বেরিয়ে পড়লো, ঈদগার উদ্দেশ্যে। প্রথমে তারা পারিবারিক কবরস্থানে এলো। এখানে শুয়ে আছে তাদের প্রিয়জন। কবর জিয়ারত করতে লাগল তারা। জাকের সাহেব হাত তুলে দাদা দাদী, বাবা মা ও স্ত্রী সহ পূর্বপুরুষদের জন্য দোয়া করতে লাগলেন। তার দাদা দাদী তাকে অনেক ভালোবাসতেন। মায়ের চোখের মণি এবং বাবার একমাত্র সম্পদ ছিলেন তিনি। পুরানো স্মৃতি গুলো যেন তার চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সেই সাথে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রু। মোনাজাতে তাদের জন্য দোয়া চাইতে লাগলেন জাকের সাহেব। আসাদ হাত তুলে তার মা ও দাদা দাদীর জন্য দোয়া চাইতে লাগল।
তার মা তাকে অনেক ভালবাসতেন। সবসময়ই ভালো খাবারটুকু তার জন্য রেখে দিতেন। আসাদের অসুখ হলে মায়ের চিন্তার শেষ থাকতো না। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিতেন আসাদের পাশে থেকে। আসাদের দাদা দাদীও তাকে খুব ভালোবাসতেন। সকাল সকাল আসাদ তার দাদার সাথে গরু নিয়ে মাঠে যেতো। দাদী তাকে নানারকম পিঠা বানিয়ে খাওয়াতেন। সেই মায়া, মমতা, ভালোবাসা আজ মাটির নিচে শুয়ে আছে। আর তাকিয়ে আছে দোয়ার জন্য। পুরানো দিনের কথা মনে করে চোখের পানি ঝরিয়ে কাঁদতে লাগল আসাদ। আর আল্লাহর নিকট দোয়া করতে লাগল। ফাহাদ তার দাদীর জন্য দোয়া করছে। তার দাদী অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। সবসময় ন্যায়ের কথা বলতেন। পুরানো দিনের সোনালী গল্প শুনাতেন।
ফাহাদের নাকি একটা ছোট ফুফু ছিল। জন্মের পরেই মারা গিয়েছিল। দেখতে নারী পরীর মতো ছিল। সেই কথা বলে তার দাদী আঁচলের আড়ালে চোখের জল মুছতো। এসব মনে হতেই ফাহাদের চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো। ফাহাদ দোয়া চাইলো আল্লাহর দরবারে। মোনাজাত শেষ করে পাশে ফিরতেই জাকের সাহেব দেখলেন তার আত্মীয় স্বজন অনেকেই হাজির। সবাই হাত তুলে জিয়ারত করছে। অনেকেই হু হু করে কেঁদে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য তাদের জন্য পুরানো। বছরের এই দিনে এখানে সবাই হাজির হয়। কেন হবে না? এখানেই যে সবার বাবা-মা, দাদা-দাদী শুয়ে আছে। সবাই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে এটাই চাচ্ছে, রমজানে যেমন কবরের আযাব মাফ ছিল। তেমনি যেন আজ আসরের পর থেকেও মাফ থাকে।
আভা অনেকক্ষণ ধরে নিজে নিজে সাজার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই গুছিয়ে উঠতে পারছে না। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে মায়ের কাছে এসে হাজির হলো। “মা, আমাকে পরী বানিয়ে দাও তো।” মেয়ের কথা শুনে নূরী হাসি দিয়ে বলল, “তুই তো এমনিতেই পরী। আমার চোখের মনি।” কোলে নিয়ে কপালে, গালে চুমো দিলো। তারপর খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো আভাকে। লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং টিকলি, দুল, চুড়ি, জুতো পরিয়ে দিলো। একদম পরীই লাগছে। আভা ঘর জুড়ে দৌড়াচ্ছে আর লেহেঙ্গা ঘুরাচ্ছে। নূরী শুধু নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে। এই তো ঈদ। এই তো আনন্দ।
নামাজ শেষে ঈদগার ময়দানে গ্রামবাসী একে অপরকে আলিঙ্গন করে ঈদ মোবারক বলছে। ফাহাদ তার দাদাকে সালাম করে আলিঙ্গন করলো। জাকের সাহেব নাতিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তুই আমার কাছে থাকলে আমি নিজের মধ্যে অদ্ভুত শক্তি পাই।” নামাজ শেষে তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরতে লাগল। গ্রামে ঈদের আনন্দটাই অন্যরকম। এখানে আশেপাশের সবাই একে অপরের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ। রক্তের সম্পর্ক বাদেও কেউ চাচা হয় তো কেউ মামা, কেউ খালা হয় তো ফুফু।
এভাবে এক অদ্ভুত ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে থাকে গ্রামবাসী। অথচ শহরে পাশের বাসার খবরটাও রাখা হয় না। যান্ত্রিক শহরে ব্যস্ততার আড়ালে ধামাচাপা পড়ে যায় সব আবেগ, অনুভূতি। দাদা-নাতি ও ছেলে মিলে প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি মুখ করতে লাগল। জাকের সাহেব প্রতিটি বাড়ির বাচ্চাকাচ্চাদের ঈদের বকশিশ দিতে লাগলেন। নতুন নোট পেয়ে বাচ্চাদের আনন্দের যেন শেষ নেই। প্রতিটি ঘরে সবার মুখ ভর্ত হাসি দেখে আসাদের অন্তর জুড়িয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, এই তো ঈদ। এই তো আনন্দ।
নূরী ব্যস্ত আপ্যায়নে। তার সাথে আছে তার এক খালা। নাম রহিমা। রক্তের সম্পর্ক নেই। তবুও মানুষটা প্রতিবছর তাদের সাথেই ঈদ করে। তাদের জন্য জামা কাপড় আনে। তার পরিবার থেকেও নেই। ছেলে শহরে গিয়ে ধনী হয়ে আর মায়ের কাছে আসেনি। সেখানেই বিয়েশাদী করে প্রতিষ্ঠিত। নাতি পুতির মুখও দেখেনি রহিমা। মাস শেষে কিছু হাত খরচ পাঠায়। কিন্তু গত বিশ বছরেও গ্রামে পা রাখেনি। মাঝেমাঝে কথা হয়। বলে ব্যস্ততার জন্য আসতে পারছে না।
“এই শাড়িটায় খুব সুন্দর মানাবে আমাকে, তাই না?” নূরীর দেওয়া শাড়িটা হাতে নিয়ে কথাটা বলল রহিমা। নূরী এক চিলতে হাসি দিলো। “তুমি পছন্দ করে নিয়েছ তাই না? তোমার পছন্দ সবসময়ই ভালো হয়।” জবাবে নূরী বলল, “আপনার পছন্দও সুন্দর, খালা।” আভা যেন হিংসায় জ্বলে উঠলো। সে নিজের লেহেঙ্গা ধরে একটা ঘুরানি দিয়ে ভেংচি মেরে রহিমাকে বলল, “আমাকে পরী লাগছে, পরী। এই দেখ আমার জামা কি সুন্দর ঘুরে! তোমার জামা ঘুরে?” রহিমা হেসে উঠলো।
আভাকে কোলে নিয়ে বলল, “ওরে আমার বুড়িটা। আসলেই তো পরী লাগছে। কারও নজর না লাগুক।” নূরী তাকিয়ে আছে রহিমার দিকে। প্রতিবারই রহিমা পরম মমতার সাথে আভাকে বুকে নেয়। মানুষটার অন্তর ভালোবাসার জন্য খাই খাই করে। অথচ তারও এমন নাতি নাতনী আছে। ছেলে আছে, বউ আছে। কিন্তু তারা আসে না। পোড়া কপাল তাদের। কেননা তারা এমন ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেই সাথে বঞ্চিত হচ্ছে মায়ের দোয়া থেকে। কোনো মা সন্তানকে অভিশাপ দেয় না। কিন্তু যখন মা সন্তানের কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তখন সেই নিঃশ্বাসের সাথে অভিশাপ বেরিয়ে যায়।
আসাদরা চলে এলো। ফাহাদ এসে রহিমাকে সালাম করলো। রহিমা তার আঁচলের গিঁট খুলে ফাহাদের হাতে বকশিশ হিসেবে একশো টাকা দিলো। আত্মীয়স্বজন অনেকেই আসতে লাগল। সবাই বড়দের সালাম করতে লাগল। আজ যে সবাই সেলামী পাবে। রহিমাও প্রাণ খুলে সবাইকে বকশিশ দিতে লাগল। তার ঈদটা এই বাড়িতেই কাটে। টাকা ছেলেই পাঠিয়েছে। ফাহাদের সাথে ঝগড়া বেঁধেছে আভা। ফাহাদ বলছে তার জামা সুন্দর, আভা বলছে তার। এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া দুই ভাইবোনের। বাকিরা দেখে শুধু হাসছে। এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। এই তো ঈদ, এই তো আনন্দ।
সময় অতিবাহিত হতে লাগল। দুপুর গড়িয়ে সূর্য আকাশের পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ল। আসরের আযান দিতেই জাকের সাহেবের কলিজায় একটা মোচড় দিল। আর কিছুক্ষণ পরেই যে কবরের আযাব আবার শুরু হবে। দাদা দাদী, বাবা মা ও স্ত্রীর কথা মনে পড়তেই তিনি নামাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। নামাজ শেষে কবরস্থানে এসে জিয়ারত করে আল্লাহর দরবারে কাঁদতে লাগলেন। আমীন বলে মোনাজাত শেষ করতেই আসাদ ও ফাহাদকে দেখতে পেলেন। তারাও দোয়া করেছে। জাকের সাহেব ভাবতে লাগলেন এই তো ঈদ, এই তো আনন্দ। সন্তানেরা বাবা মাকে মনে রেখেছে এর চেয়ে আনন্দ আর কি হতে পারে?
“যাইরে মা।” আবেগ ভরা কণ্ঠে বলল রহিমা।
“আবার আসিয়েন, খালা।”
“আমি তো মাঝেমাঝে এই বাড়ি, ওই বাড়ি আসি। তোরাই তো আসিস না।”
“কি করব খালা? ছেলেমেয়েদের স্কুল আছে। তারওপর ফাহাদের বাবার অফিসে লম্বা ছুটি পাওয়া যায় না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহিমা বলল, “হ্যাঁ রে মা। শহুরে লোকেরা খুব ব্যস্ত। এই যে আমার ছেলেটা আজ কত বছর ধরে মায়ের চেহারাও দেখেনি। এখন দেখলে চিনবে কিনা কে জানে?” কথাগুলোতে একটা চাপা কষ্ট অনুভব করছে নূরী। আভার গালে দুটো চুমো দিয়ে রহিমা বলল, “ও বুড়ি, শহরে গিয়ে আবার এই বুড়িকে ভুলে যেও না।” আভা ভেংচি দিয়ে বলল‚ “আমি বুড়ি না।” রহিমা কিছুক্ষণ নিশ্চুপে আভাকে বুকে জড়িয়ে রাখলো। নূরী কাছে এটা চিরচেনা এক করুণ দৃশ্য। রহিমার চোখ দিয়ে পানি বের না হলেও তার অন্তরে যে ঢেউ চলছে তা নূরী ঠিকই বুঝতে পারছে।
“যাই গো মা। কোরবানীর ঈদে আবার এসো কিন্তু। তোমরা না এলে আমার ঈদ হয় না।” নূরী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। রহিমা বেরিয়ে গেল। যত পা সামনে দিচ্ছে ততবারই পিছনে তাকাচ্ছে। ভালোবাসা যেন তাকে বারবার পিছে টানছে। তবুও রহিমা পা চালিয়ে চলে গেল। যেতে হবে‚ এটাই বাস্তবতা। রহিমার যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে নূরী ভাবতে লাগল, মানুষটার চাহিদা কম। তাদের সাথে একবেলা থেকেই যেন এক বছরের আনন্দ পায়। এই তো ঈদ। এই তো আনন্দ।