আজকের খবরের কাগজটা পড়েছিস?”- খবরের কাগজ ভাঁজ করতে করতে বাবা আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন।
যদিও সচারাচর খবরের কাগজ আমার পড়া হয় না তা বাবা ভালো করেই জানেন। তারপরেও কেন যে সকাল সকাল এমন প্রশ্ন করে বসলেন তা ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে পুরোপুরি না বুঝলেও এতটুকু নিশ্চিত যে আজ খবরের কাগজে বিশেষ কিছু ছাপিয়েছে যেটা বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
অবশ্য খবরের কাগজে রোজই তো বিশেষ কিছুই ছাপায়, আর এটাই তো স্বাভাবিক। অবশ্য কোনো বিশেষ খবর নিয়েই আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। কেননা খবরের কাগজ না পড়লেও এতটুকু বুঝতে পারি দেশটা দিন দিন গোল্লায় যাচ্ছে। আর এই গোল্লায় যাওয়া আটকানো আমার একার পক্ষে সম্ভব না। কেননা এগুলো উপর মহলের ব্যাপার। আমার মতো চুনো পুঁটি এতে নাক গলিয়ে কোনো কাজের কাজই হবে না। বরং যারা নাক গলালে কাজ হতে পারে তারাই নাক ডেকে ঘুমাতে ব্যস্ত। বাবা কথার কোনো জবাব না পেয়ে আবার বলে উঠলেন, “কী রে, আমি তোকে কিছু…” আমি চায়ের কাপে শেষবারের মতো চুমুক দিয়ে বাবার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রতিত্তোরে বললাম, “না, আজ খবরের কাগজ পড়া হয়নি। কেন কোনো বিশেষ কিছু ছেপেছে কি?” বাবা খবরের কাগজটা হাতে দিতে দিতে বলে উঠলেন, “রোজই তো পড়িস না। এটা আর নতুন কী। তিন নম্বর পৃষ্ঠাটা দেখ।”
আমিও বাধ্য ছেলের মতো বাবার হাত থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে তিন নম্বর পৃষ্ঠাটা বের করে কিছুটা গলা চড়িয়ে হেডলাইনটা পড়তে লাগলাম, “বিখ্যাত শিল্পপতি সৈয়দ শামসুল হক আর নেই”-এতটুকু পরেই একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। তারপর খবরের কাগজটা নিয়ে আবার পড়তে লাগলাম,”গত রাত ৩টার সময় বিখ্যাত শিল্পপতি সৈয়দ শামসুল হক পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তার নিজস্ব বাসভবনের সিলিং ফ্যান থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আত্মহত্যার কারণ এখনো জানা যায়নি। তদন্ত চলছে…” নাহ, আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। এই রকম মামুলি নিউজ পড়ে কোনো মজা নেই। কত মানুষই তো রোজ আত্মহত্যা করে। এই নিয়ে আলাদাভাবে মাতার কোনো কারণ নেই।
“জীবন মানে হলো যুদ্ধ। প্রতি মুহূর্তে লড়ে বেঁচে থাকার নামই জীবন। হঠাৎ করে দুম করে মরে গেলেই যদি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত তবে তো কাজেই লাগতো। যারা কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তাদের উপর রাগের চেয়ে বেশি ঘৃণা হয়। লোকটাকে এতদিন ভালো বলে জানতাম, সম্মান করতাম। কিন্তু আজ তীব্র ঘৃণা হচ্ছে।”বাবার কথাগুলো কানে যেতেই আমার মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো, “নিজের জীবনের প্রতি ঘৃণা ছিল জন্যই মরে গেছে। জীবনের প্রতি ভালোবাসা থাকলে কেউ আত্মহত্যা করে না। তাই তোমার ঘৃণা করাতে কারো কিছু যায় আসবে না।” কথাগুলো শেষ করে উত্তরের অপেক্ষা না করেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। না, আজ আর অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না। কী করা যায় ভাবতেই প্রিয়তির কথা মনে পড়লো। মেয়েটাকে আজ সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়?
প্রিয়তির সাথে পরিচয়টা প্রথম কলেজ লাইফে। তারপর কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভার্সিটি… সে অনেক কথা। যদিও আগে বন্ধুর বাইরে কিছু ভাবতাম না। কিন্তু একটা সময় পর বুঝতে পারলাম সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ নেই।
অবশ্য বন্ধুত্বের বাইরে আর কোনো সম্পর্কে জড়ানোর মতো ইচ্ছে আমার ছিল না। কারণ ওর আর আমার ধর্ম আলাদা। তাই আমাদের লাইফস্টাইলও পুরোপুরি আলাদা। সেটা ও’কে বহুবার বোঝানোর চেষ্টাও করেছি। কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। বরং ও যেদিন আমাকে প্রপোজ করে বসলো সেদিন কেন জানি না করতে পারিনি। নিশ্চয়ই ওর প্রতি কোনো দুর্বলতা থাকার কারণেই পারিনি। কিন্তু কী সেই দুর্বলতা তা আজও উদঘাটন করতে পারিনি। তবে ওর প্রতি যে আমার দুর্বলতা আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি জানি বাবা ও’কে কোনোদিনও মেনে নেবে না। ও’কে বিয়ে করতে চাইলে বাড়ি থেকে আমাকে বের করে দেবে। আর পালিয়ে বিয়ে করলে জীবনেও আর বাড়িতে তুলবে না। সবমিলিয়ে বাড়ি যে আমাকে ছাড়তেই হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সে যা হবে পরে দেখা যাবে। এসব নিয়ে এখন মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করছে না।
প্রিয়তির সাথে দেখা করা দরকার। কয়দিন ধরেই দেখা করার জন্য পাগল করে দিচ্ছে। অফিসে কাজের অনেক চাপ বলে ম্যানেজ করে এসেছি। ওর বাড়ি এখান থেকে খুব একটা দূরে না। বাসে করে গেলে ২০-২৫ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। আচ্ছা সরাসরি যদি ওর বাড়ির সামনে গিয়ে ও’কে বলি, “একটু ব্যালকনিতে আসবে প্লিজ, তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে”- কথাটা শুনে কি ও অবাক হবে? নাকি উল্টে আমাকে পাগল বলে সম্বোধন করে বসবে?
একটা সময় মনে হতো প্রিয়তি খুব চালাক একটা মেয়ে। কিন্তু সময় যতই যাচ্ছে ততই যেন মনে হচ্ছে মেয়েটা কিছুটা ইমোশনাল আর অনেকটাই বোকা। বোকা না হলে কী আর আমার সাথে প্রেম করে। অবশ্য যারা প্রেম করে তারা সবাই আমার কাছে একেকটা গাধার ডিম। কথাগুলো আনমনে ভাবতেই কেমন যেন হাসি পাচ্ছে।
আমি একবার আড়চোখে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় কত তা দেখে নিলাম। সকাল ৯টা বেজে ১৪মিনিট। এখান থেকে বাসস্টপেজ খুব একটা দূরে না। আর বাসে চাপলে ২০-২৫মিনিটের বেশি লাগবে না। সবমিলিয়ে ১০টার মধ্যে চলে যাওয়া যাবে। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে বাস আসার অপেক্ষা করছি। হঠাৎ একটা মেয়ে এসে বারবার হাত টানছে আর বলছে, “ভাইয়া ফুল নেবেন ফুল? একদম টাটকা টাটকা ফুল। নেন না ভাইয়া।” মেয়েটার বয়স কত হবে? ৭-৮বছরের বেশি না। এই সময় তো ওর স্কুলে যাওয়ার বয়স, অথচ ও ফুল বিক্রি করছে!
আমি মেয়েটাকে প্রশ্ন করে বসলাম, “কী রে স্কুলে যাস না? ফুল বিক্রি করছিস কেন?”
আমার কথাটা শুনে মেয়েটা যেন খুব মজা পেয়েছে। একগাল হেসে কিছুটা বিদ্রুপের সুরে বলে উঠলো, “গরীবের আবার স্কুল। ফুল বিক্রি না করলে ট্যাকা পামু কই? ফুল নিলে কন, নয়লে আমার অন্য খদ্দের ধরতে হইবো।”
মেয়েটার কথা শুনে আমার সেই স্কুলের কথা মনে পড়ে গেল। স্কুলে মাস্টারমশাই প্রায়ই বলতেন, “ধনী-গরীব সবাই সমান। সবার সমান অধিকার।” এখন এক নিমেষেই মনে হচ্ছে মাস্টারমশাইয়ের সেদিনের বলা কথাগুলো মিথ্যে ছিল। ধনী-গরীব কোনোদিনও সমান হতে পারে না। এই নির্মম সত্যিটা কত সহজেই না এই মেয়েটা বুঝে গেছে। আমাদের থেকে অনেক বেশি যেন মেয়েটা পৃথিবী সম্পর্কে জেনে গেছে।
মেয়েটা আবার হাত ধরে টানায় আমার সম্বিৎ ফিরলো। এতক্ষণে বাসও চলে এসেছে। আমি মেয়েটাকে বললাম, “সবক’টা ফুল দিয়ে দে।” আমার কথা শুনে মেয়েটা হা করে দাঁড়িয়ে রইলো। বুঝতে পারলাম মেয়েটা আমার কথা শুনে বেশ অবাক হয়েছে। হঠাৎ করেই মনে হলো মেয়েটার সাথে প্রিয়তির খুব মিল আছে। প্রিয়তিও অবাক হলে এমন হা করে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্তত ৩০সেকেন্ড কোনো কথা বলে না। আমি আবার মুচকি হেসে বলে উঠলাম, “কী রে, খদ্দের কি পছন্দ হয়নি? দাম কত দিতে হবে বল?” মেয়েটা নিচের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে উঠলো, “২১০ট্যাকা।” আমি মানিব্যাগ থেকে তিনটে ১০০টাকার নোট বের করে হাতে ধরিয়ে দিলাম। মেয়েটা হয়তো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ততক্ষণে আমি ফুলগুলো নিয়ে বাসে উঠে গেছি।
বাসের সিটে গা এলিয়ে দিতেই চোখ দুটো যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। হঠাতই যেন মনে হলো বন্ধ চোখে আমি সেই ফুল বিক্রেতা মেয়েটাকে দেখতে পেলাম। আগে তো কখনো চোখ বন্ধ করলে কাউকেই দেখতে পেতাম না। এই নিয়ে প্রিয়তির সাথে কত ঝামেলা হয়েছে। ও বলতো আমি নাকি ও’কে একটুও ভালোবাসি না। আসলে ওর ধারণা কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে চোখ বন্ধ করলে নাকি তাকে দেখা যায়। ও চোখ বন্ধ করলে নাকি আমার মুখটাই দেখতে পায়। কিন্তু আমি চোখ বন্ধ করলে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পেতাম না। তাই ও’কে ক্ষেপানোর জন্য বলতাম, “লোডশেডিং হয়ে গেছে, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।” আনমনে নিজেকেই প্রশ্ন করে বসলাম, “আচ্ছা আমি কি প্রিয়তিকে ভালোবাসি না? ভালোবাসলে কেন চোখ বন্ধ করলে ওর মুখটা দেখতে পাই না?” চোখ বন্ধ করলে যদি ভালোবাসার মানুষের মুখ দেখা যায়, তবে কেন আজ চোখ বন্ধ করে ফুল বিক্রেতা মেয়েটাকে দেখতে পেলাম? মেয়েটার সাথে আলাপ তো মাত্র কিছুক্ষণের। এই সময়ের মধ্যে নিশ্চয়ই কাউকে ভালোবেসে ফেলা যায় না।
পরক্ষণেই পুরো ব্যাপারটার পেছনে একটা যুক্তি দাঁড় করলাম। যুক্তিটা নিজেরই খুব ভালো লাগল। আসলে মস্তিষ্ক যখন কাউকে নিয়ে ভাবে, চিন্তা করে তখন না চাইতেও চোখ বন্ধ করলে সেই মানুষটার মুখ আমরা দেখতে পাই।
এতক্ষণ আমি ফুল বিক্রেতা মেয়েটার কথা যেহেতু ভাবছিলাম তাই চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে মেয়েটার মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আচ্ছা প্রিয়তি কি তাহলে সবসময় আমাকে নিয়ে ভাবে জন্যই চোখ বন্ধ করলে আমাকে দেখতে পায়? আচ্ছা এই লজিকটা যদি ও’কে বলি তাহলে কি ও বিশ্বাস করবে? নাকি বলে বসবে, “তুমি তাহলে আমাকে নিয়ে একটুও ভাবো না?” আচ্ছা সবগুলো ফুল কিনে নিতে চাওয়ায় মেয়েটা কেন ওইভাবে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল?
মেয়েটা কি ভেবেছিল সবগুলো ফুল কিনে নেওয়ার মতো টাকা আমার কাছে নেই? নাকি কেউ কোনোদিন সবগুলো ফুল একবারে ওর থেকে কেনেনি? হয়তো তাই হবে। আসলে প্রথমবার নতুন কিছু ঘটলে মানুষ কিছুটা অবাক হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার নিশ্চয়ই সবগুলো ফুল কেউ একবারে কিনে নিতে চাইলে মেয়েটার মধ্যে সেই বিস্ময়বোধটা আর কাজ করবে না। তখন তার কাছে সেটাই স্বাভাবিক মনে হবে। হঠাৎ করে বাস কন্ডাকটরের হাঁক শুনে আমার চৈতন্য ফিরলো। বুঝতে অসুবিধে হলো না গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। বাস থেকে নেমে একটা রিকশা ডেকে ঠিকানা বলে তাতে চড়ে বসলাম। ১০মিনিটের মধ্যে প্রিয়তির বাড়ির সামনে চলে আসতেই রিকশাওয়ালাকে বললাম নামিয়ে দিতে। তারপর ভাড়াটা পরিশোধ করে নেমে পড়তেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করতে শুরু করেছে।
বেশকিছুক্ষণ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলাম একদৃষ্টিতে। বাড়িটা ঠিক আগের মতোই আছে। একটুও পরিবর্তন নজরে আসছে না। বেশ কয়বার কলেজ লাইফে বন্ধুত্বের অজুহাতে এখানে আসা হয়েছে। তারপর অনেকদিন আর এই পথ মাড়ানো হয়নি। হঠাৎ করেই একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে খচ করে উঠলো। আচ্ছা প্রিয়তির বাবা-মা কি আমাকে দেখলে আগের মতো স্নেহ করবে? নাকি প্রিয়তির সাথে কেন এখনো যোগাযোগ রেখেছি সেটা বলে বসবে? অবশ্য এখানে আসা শুধুমাত্র প্রিয়তির সাথে দেখা করার জন্য। কে কী ভাবলো সেসব ভেবে লাভ নেই। আমি পকেট থেকে ফোনটা বের করে প্রিয়তিকে কল দিলাম। রিং বেজে চলল কিন্তু রিসিভ হলো না। তাহলে কি ওর ঘুম ভাঙেনি এখনো?
চট করে কত বাজে সেটা দেখে নিলাম। ১০টা বেজে ৪মিনিট। এত বেলা পর্যন্ত ও ঘুমায় না তো। আরেকবার রিং বাজতেই রিসিভ হতে আর সময় লাগল না। রিসিভ করেই বলে উঠলো, “স্যরি আকাশ, ট্রেনের মধ্যে শব্দের কারণে শুনতে পাইনি। প্রচণ্ড ভীড় গো। আমি তোমাকে একটু পর কল দিচ্ছি।” কথাটা বলেই লাইনটা কেটে দিলো। সকাল বেলা ও ট্রেনে করে কোথায় যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারলাম না। আর কোথাও যাওয়ার হলে আমাকে কেন আগে থেকে জানালো না? তাহলে আর কষ্ট করে এতটা পথ আসতে হতো না। অবশ্য ও জানবে কীভাবে আমি এখানে আসবো। ও’কে তো আগে থেকে কিছু বলিনি আমি। ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে। কিন্তু এখানে এসে যে এইভাবে নিজেকে সারপ্রাইজড হতে হবে তা কে জানতো। নিজের উপর নিজেরই ভীষণ রাগ হচ্ছে এখন। মনে হচ্ছে এতটা প্রেমিক পুরুষ না সাজলেও চলতো।
প্রিয়তির বাড়ির গলি ছেড়ে বেশ অনেকখানি পথ চলে এসেছি। এর মধ্যে কোনো রিকশা বা অটো চোখে পড়েনি।বুঝতে পারছি এখানে গাড়ির খুব সংকট। প্রিয়তি যে কীভাবে রোজ এইখান থেকে যাতায়াত করে কে জানে। ইতোমধ্যে ভালোভাবেই বুঝতে পারছি কিছু উৎসুক জনতা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এইভাবে তাকিয়ে থাকার কারণটা ঠিক ধরতে পারছি না। পাড়ায় নতুন কাউকে আসতে দেখলেই কি এরা এইভাবে তাকিয়ে থাকে? পরক্ষণেই হাতের দিকে তাকাতেই খেয়াল হলো সেই ফুলগুলো এখনো আমার হাতের মুঠোয়। হয়তো এই কারণেই সবাই তাকিয়ে আছে। সে যাই হোক, অত ভেবে লাভ নেই। ফুলগুলো কী করবো সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না। হাজার হলেও টাকা দিয়ে কিনে ফেলে দিতেও মায়া লাগছে।
আর কিছুদূর সামনে যেতেই একটা বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। কিছু মানুষ একটা খাটিয়ার চার মাথা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে, আর সবার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে “বলো হরি..হরি বল…” পেছন থেকে বেশ কয়টা অল্পবয়স্ক ছেলে সেই সুরে সুর মেলাচ্ছে। সবমিলিয়ে বুঝতে অসুবিধে হলো না কেউ একজন মারা গেছেন। আর যিনি মারা গেছেন তিনি হিন্দু কেউ। নিশ্চয়ই এখন তাকে দাহ করার জন্য শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যেই আমার আজ সকালের খবরের কাগজের সেই শিল্পপতির কথা মনে পড়ে গেল। কী যেন নামটা…। ওহ মনে পড়েছে সৈয়দ শামসুল হক। আচ্ছা তাকেও কি এইভাবে খাটিয়ায় করে “বল হরি হরি বল…” করে নিয়ে যাওয়া হবে? না, তা কীভাবে হয়। সৈয়দ শামসুল হক তো মুসলমান। তাকে নিশ্চয়ই শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হবে না।
আমি হুট করেই সেই একদল শ্মশানযাত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর মৃতের উপর ফুলগুলো দিয়ে নিজের মতো হাঁটতে শুরু করলাম। বুঝতে পারলাম আমার এইরকম ব্যবহারটা কেউ ভালো মনে নেই নি। দুই একজন বেশ অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। হঠাৎ করেই মনে হলো মানুষকে অবাক করা খুব একটা কঠিন বিষয় না। স্বাভাবিকের বাইরে কিছু ঘটলেই মানুষ অবাক হয়ে যায়। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর হাবিজাবি চিন্তা করছি। আসার সময় খেয়াল হলো যারা মৃতকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে সামনের দুজন খুব কাঁদছিলেন অার বিলাপ করছিলেন। পেছনের কারো মধ্যেই শোকের কোনো ছাপ দেখা যাচ্ছিল না। তখনই মনে হলো কেউ মারা গেলে নিকট আত্মীয় ছাড়া কারো উপর তেমন শোকের কোনো প্রভাব পড়ে না। পৃথিবীতে প্রতিদিন এত মানুষ মারা যায় কিন্তু কোনো কষ্ট আমরা অনুভব করি না। তাহলে কষ্ট কি শুধু কাছের মানুষদের জন্যই বরাদ্দ?
আমার কাছের মানুষ বলতে দুজন। এক বাবা, আর দ্বিতীয়জন হলো প্রিয়তি। আমি অনেক ছোট থাকতেই মা মারা গেছেন। তাই আত্মীয়ের খাতা থেকে তার নামটা অনেক আগেই কাটা পড়েছে। আচ্ছা মা যখন মারা যায় তখন কি আমি কেঁদেছিলাম? হয়তো কেঁদেছিলাম, হয়তো না। তখন তো আর মৃত্যু শব্দটার মানে বুঝতাম না। অবশ্য বাবা বলে মা মারা যাওয়ার পর নাকি আমি সবসময়ই কাঁদতাম। আমাকে সামাল দিতে বাবার নাকি নাজেহাল অবস্থা হয়ে যেত। হয়তো কান্নাটা তখন শিশুসুলভ আচরণ ছিল। মায়ের মৃত্যুর শোক ঠিক বলা যায় না। আচ্ছা কে মারা গেলে আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবো? বাবা নাকি প্রিয়তি? কথাটা ভাবতেই কেন যেন খুব হাসি পাচ্ছে। কত সহজেই দুজন জলজ্যান্ত মানুষের মরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারছি। একটুও বুক কাঁপছে না অামার? প্রিয়তি ঠিকই বলে আমি দিনদিন পাষাণ হয়ে যাচ্ছি।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। এর মধ্যে প্রিয়তির সাথে তেমনভাবে যোগাযোগ হয়নি। সেদিন জানিয়েছিল ওর পিসীর অসুস্থতার জন্য ও’কে ঢাকা যেতে হচ্ছে। তারপর থেকেই ফোন বন্ধ আসছে। আমি রোজ নিয়ম করে ও’কে কল দিয়ে যাই, কিন্তু বারবার সেই মহিলার একই ভয়েস ছাড়া আর কিছু শুনতে পাই না। অফিস থেকে ফেরার সময় সেই ফুল বিক্রেতা মেয়েটার সাথে প্রায়ই দেখা হয়। এর মধ্যে ওর নামও জেনে নিয়েছি। ওর নাম ফুলি। ভারী সুন্দর কথা বলে। ওর যে দিকটা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তা হলো অল্পতেই অবাক হয়ে যাওয়া। আর ওর অবাক মিশ্রিত মুখটা কেন যেন ভীষণ ভালো লাগে আমার। হয়তো তখন ও’কে প্রিয়তির মতো দেখতে লাগে জন্যই এই ভালো লাগা।
আমি প্রায়ই ওর থেকে ফুল কিনি, যদিও দেওয়ার কোনো মানুষ নেই। সেদিন ফুল কেনার সময় দেখলাম একটা ফুল বেশি দিয়েছে। বেশি দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতেই মুচকি হেসে বলে উঠলো, “আপনে আমার নিয়মিত খদ্দের। তাই ওইটা আইজ আপনের বোনাস।” সকাল হতে না হতেই ডাকপিয়নের আগমনে ঘুম ভাঙলো। গেইট খুলতেই বলে উঠলো, “সাহেব আপনার ঠিকানায় একটা টেলিগ্রাম এসেছে।” আমাকে কেউ চিঠি পাঠিয়েছে শুনে যতটা না অবাক হলাম, তার থেকেও বেশি অবাক হলাম লোকটার মুখে টেলিগ্রাম শব্দটা শুনে। সচারাচর এই শব্দটার কেউ ব্যবহার করে না। চিঠিটা হাতে নিতেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো। প্রেরকের জায়গায় ছোট্ট করে লেখা ‘প্রিয়তি মুখার্জি’। আমি একপ্রকার তড়িঘড়ি করেই চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলাম।
‘প্রিয় আকাশ,
জানি না কী লিখবো। আমার হাতটা ভীষণ কাঁপছে। সব কথা কেমন জানি গুলিয়ে যাচ্ছে। কিছু লিখতে পারছি না। তুমি হয়তো ভাবছো ফোন বন্ধ করে কেন আমি চিঠি লিখছি। এটা আবার কী ধরনের রসিকতা। আসলে বাবা মিথ্যে কথা বলে আমায় ভারত নিয়ে এসেছে। জানি না কীভাবে তোমার সাথে সম্পর্কের কথা জেনে গেছে। তুমি তো জানো আমাদের ধর্ম আলাদা। আমাদের সম্পর্কটা যে কোনোদিন কেউ মেনে নেবে না সেটা আমি জানতাম। কিন্তু এইভাবে মিথ্যাচার করবে সেটা বুঝতে পারিনি।
পিসীর অসুস্থতার কথা বলে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। পরে বলল দেশে নাকি এর চিকিৎসা নেই বলে বিদেশ নিয়ে যেতে হবে। আর এখানে আসার শুনলাম আমরা নাকি আর দেশে ফিরবো না। আমাদের বাড়িটা নাকি বাবা বিক্রি করে দিয়েছে। এখানেই নাকি স্যাটেল হয়ে যাবে। বাবা পুরোটা পরিকল্পনা করে করেছে যেন আমি কিছু জানতে না পারি। তুমি তো জানোই আমার কাকারা সবাই এখানেই থাকে, আর আমার দাদুর বাড়িও আছে এখানে। তাই থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না। এখানে আসার পর আমার থেকে ফোনটাও কেড়ে নিয়েছে যেন তোমার সাথে যোগাযোগ করতে না পারি। বাধ্য হয়ে তাই চিঠি লিখছি। জানি না আমি কী করবো। তোমাকে ছাড়া যে থাকতে পারবো না এতটুকু নিশ্চিত। তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আর এই ঠিকানায় কোনো চিঠি পাঠিও না। আমি খুব শীঘ্রই তোমার কাছে ফিরে যাবো।
ইতি
তোমার প্রিয়তি
বুঝতে পারছি না কী করবো। ওকে ছাড়া কোনোকিছু আমি কল্পনাও করতে পারি না। আমি কীভাবে প্রিয়তিকে ছাড়া থাকবো? এটা কি সম্ভব? এক মুহূর্তে আমার রোদে ঝলমল পৃথিবীটা যেন ভীষণ ঝাপসা মনে হচ্ছে। ভীষণ অসহায় লাগছে নিজেকে। মনের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করছে। কী সেই শূন্যতা? প্রিয়তি? আচ্ছা আমি কি ও’কে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেললাম? কিন্তু ও তো বলেছে ফিরে আসবে আমার কাছে। তাহলে…? আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। শুধু মনের মধ্যে একটা প্রশ্নই উঁকি দিচ্ছে বারবার। প্রিয়তি কি সত্যিই আর কখনো ফিরে আসবে আমার কাছে?