ব্যস্ত শহর, ব্যস্ত রাস্তা। হঠাতই বিকট আওয়াজ। কিছুক্ষণের জন্য যেন মনে হলো সবকিছু থমকে দাড়িয়েছে । পড়ে থাকা বাইকটার পাশের রক্তাক্ত দেহটাকে ঘিরে জড়ো হয়েছে অনেক মানুষ। বাইকের চাকাটা এখনও ধীর গতিতে ঘুরছে। ছেলেটাকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না। সারা শরীর রক্তে মাখামাখি। হাডবির্টটা এখনো চলছে। তবে সেটাও প্রায় থেমে থেমে। এই যেন বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে। মিনিট দশেক সময় লাগলো ঘটনাটা পরিস্কার হতে। ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ কানে আসলো। রক্তাক্ত দেহটা অ্যাম্বুলেন্সে তোলার পর ভিড়টা হালকা কমে গেল। বাইকটা এখনো রাস্তার ধারে ঠিক তেমন ভাবেই পড়ে আছে। যেন সেটা দেখেও কেউ দেখছে না।
আইসিও তে যে ছেলেটাকে এই মাত্র রক্তাক্ত অবস্থায় ঢুকানো হলো ওর নাম নীল। গ্রামের ছেলে শহরে এসেছে মূলত কাজের তাগিতেই। আসার পরই একটা কাজও জুটে যায়। ভালো মাইনে তাছাড়া যাতায়াতের জন্য বাইক আর থাকার জন্য ছোট্ট একটা চিলেকোঠা। ঢাকা শহরে এই বা কম কিসে? গ্রামের ছেলে শহরে এসে বাঁচতে শিখলো নতুন করে। এই ইট কংক্রিটের শহরে কেউ কারও নয়। সবাই চলে নিজ তাগিদে। দরকার আছে তো সঙ্গ দিবে, যখন দরকার ফুরিয়ে যাবে তখন শুরু করে কাজের অজুহাত। দেখতে দেখতে অচেনা হয়ে যায় চিরচেনা সেই মানুষটাও। কিন্তু নীলু মেয়েটা কেমন জানি সবার থেকে আলাদা। না সেই যে সবার থেকে ভালো সেটা বলছি না। একেকজনের কাছে একেকজন ভালো। কিন্তু নীলের চোখে এই নীলুই যেন আর সবার থেকে আলাদা। নেই কোনো চাহিদা, কেউ কোনো অজুহাত। আর ব্যস্ততা ? এই দুনিয়ায় যে ব্যস্ততা নামক একটা শব্দ আছে সেটা বোধহয় নীলু জানেই না।
নীলের বাসা থেকে ঠিক চারটা বাসা পর যে বাসা আছে সেই বাসার দু’তলাতে মেয়েটা থাকে। ছোট থেকে এই শহরে বড় হলেও শহরের ছোয়া যেন ওর শরীরে লাগেনি। মেয়েটা মাথায় তেল দিয়ে মাঝখানে সিঁথি করে চুল আচড়ায়। কলেজে যাওয়ার সময় গ্রামের মেয়েদের মত চুলটা বিনুনি করে। পরনে থাকে সাদা ড্রেস। নীল যখন ওর বাইকটা নিয়ে অফিসে যায় তখন মেয়েটার বাসার সামনে এসে দাড়ায়। তারপর টংঙের দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরায়। আড় চোখে দুই তলার বারান্দায় উঁকি দেয়। রোজ মেয়েটা এই সময় ভেজা চুলে দাড়িয়ে থাকে। কখনো কখনো দুইজনার চোখাচোখি হয়ে যায়। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় মেয়েটা। চোখের ফাক দিয়ে এবড়ো থেবড়ো দাঁতের পাটির কিছুটা বেরিয়ে আসে মৃদু হাসিতে।
অফিস থেকে ফেরার সময় গল্পটা অন্য রকম। কখনো কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেলতে দুলতে একা আবার কখনো দুই একটা বান্ধবীদের সাথে হাসতে হাসতে। যখন একা থাকে তখন বাইকের গতিটা কমিয়ে দেয় নীল। কথা বলার একটা ইচ্ছে জাগে নীলের মনে, কিন্তু সাহসটা ঠিক কুলিয়ে উঠতে পারে না। এমনই একদিনের কথা। আজ মেয়েটা একা। বাইকের গতি কমিয়ে দিলো নীল। এই রাস্তায় লোকজনের খুব একটা চলাফেরা নেই। মাঝে মাঝে দুই একটা রিকশা টুং টুং করে বেল বাজিয়ে পাশ কেটে চলে যায়।
-এই দাড়ান তো। কথাটা শুনেই নীলের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। অজানা একটা ভয় বাসা বাঁধতে শুরু করেছে মনের কোণে।
– কী হলো দাড়াবেন না? তবে কি আমি দৌড়াতে দৌড়াতে আপনার সাথে কথা বলবো?
নীলের বাইকের ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে যায়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। আগে পিছে একবার তাকালো সে।
– জ্বী বলুন। ধরা গলায় বললো কথাটা।
– নীলু আমার নাম। আপনার?
– জ্বী নীল।
– ওমনি নীল হয়ে গেল? কথাটা শুনেই একটু চমকে উঠলো নীল।
– এটাই তো নাম আমার।
– এবার থেকে বেশি করে সময় নিয়ে আসবেন সকালে, আর একটার জায়গায় দুইটা সিগারেট খাবেন। মনে থাকবে? নীল মাথা নাড়ায়।
– মুখে কোনো কথা নেই নাকি? মুখে বলেন।
– জ্বী থাকবে।
– হুম এবার হয়েছে।
– যাই এবার?
– হুমম যান। বাইকের ইঞ্জিনটা চালু হতেই মেয়েটা আবার বললো,
– বসবো? কথাটা শোনার জন্য নীল একটুও প্রস্তুত ছিলো না। উত্তরে কী বলা উচিত সেটা ভাবতেই উপলব্ধি করলো পিছনে কেউ বসলো।
– চলবে তো? নাকি মাঝপথে থেমে যাবে? যদিও রাস্তা বেশি দূরের নয়।
আসলেই চলবে তো? শরীরে এক অদ্ভুত কম্পন শুরু হয়েছে। ভয়ে নাকি অন্য কিছুতে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না সে। মিনিট দুই তিন কোনো কথা হলো না। আপন মনে বাইকটা চলছে। মাঝে মাঝে উচু নিচুতে খুব সাবধানে চললেও মেয়েটা নিজের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পরে ঢলে পড়ছে নীলের গায়ে। প্রতিবারই যেন বিদ্যুৎ চমক দিয়ে উঠছে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
রাতটা যেন কাটতে চায় না। ঘড়ির কাটা থেমে থেমে চলছে কী? প্রশ্নটা দুই একবার উঁকি দিলো নীলের মনে। অবশেষে রাতের আধারকে ভেদ করে দিনের আলো ফুটতে শুরু করলো। মাঝরাতে একটু ঘুম এসেছিলো দুইচোখে কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়িত্ব পায়নি। এমনিতে প্রতিদিন নয়টায় বাসা থেকে বের হলেও আজ একটু আগেই বের হলো। প্রতিদিনের মত বাইকটা সেই দোকানের সামনে এসে দাড় করালো। একটা সিগারেট ধরিয়ে বেঞ্চের এক কোণে বসে পড়লো নীল। মাঝে মাঝে দুইটা চোখ উঁকি দিচ্ছে দু’তলার বারান্দায়। মেয়েটা এসেছে। চুলগুলো আজ ভেজা নয়। বাতাসের তালে তালে উড়ছে। ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠলো। মেয়েটা হাসে। ঠোঁটের ফাক দিয়ে এবড়ো থেবড়ো দাঁতগুলো বেরিয়ে আসে। হাতের জলন্ত সিগারেটটাতে আর টান দেওয়া হয় না, নিজ গতিতে ফুরিয়ে আসে। হাতে আঁচ লাগতেই মৃদু কেঁপে উঠে নীল। এই বুঝি ভালোবাসা, এর নামই বোঁধহয় প্রেম। মাথা নিচু করে ফেলে নীল।
দিন তো কাটে হেলে দুলে রাত তো কাটে না। অবশেষে সেই প্রতিক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে আবার দিনের আলো ফোটে। দিন যায় ভালোবাসা বাড়ে। সময়ের সাথে বদলে যায় সব কিছু। রাস্তায় দেখা চলে আসে কলেজ ক্যাম্পাসে। খুঁনসুটি আর প্রনয় কোনোটারই যেন কমতি নেই এই ভালোবাসায়।
– এই ছেলে এইদিকে আসো তো।
সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছে নীল। ডাক শুনে পিছনে ঘুরে তাকাতেই শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল। এই লোকটা সে চিনে, নীলুর বাবা। তাড়াহুড়ো করে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে সামনে এগিয়ে আসলো।
– নীলু আমাকে সব বলেছে। আমি চাই তুমি আর ওর সামনে যাবে না। এইটুকুই বলার ছিলো।
– কিন্তু আংকেল…..
– আহ, যা বললাম তাই করো। আর না হলে আমরাই বাধ্য হবো এখন থেকে চলে যেতে। নীল চুপ থাকে। যেন কথাগুলো গলায় মাঝখানটায় জট বেঁধে আছে, বেরিয়ে আসছে না।
– জ্বী, তবে সামনে ওর জন্মদিন। শুধু একবার ওর সাথে দেখা করতে চাই।
– শুধু একবারই। মনে থাকে যেন।
নীলুর বাবা চলে যায়। নীলের পা পাথরের মত জমে গেছে। বুকটা একবার হুহু করে উঠলো ঠিকই কিন্তু শব্দ হলো না। হৃদয়ের চিৎকার কেউ শোনে না। দুই দিন পরের ঘটনা। রাস্তা তিন চার ছেলে বাইক থামিয়ে দিলো। সাথে বেশ ভালো মতো সমাদরও চললো। নীল আর দোকানে বাইক দাড় করায় না, একটানে চলে যায়। অফিস থেকেও দেরি করে ফিরে। মাঝে মাঝে দুতলার বারান্দায় আড় চোখে দেখে। কাউকে দেখতে পায় না। দিন কাটে সময় বয়ে যায় সাথে স্বপ্নগুলোও উড়াল দেয়।
আজ নীলুর জন্মদিন। গতকালই নীল একটা উপহার এনেছিলো। নীলুর খুব পছন্দের এটা। নীল কথা দিয়েছিলো কিনে দিবে। বাইকটা ধীর গতিতে চলছে। একটু আগে অফিস ছুটি হলো। হাতে ছোট্ট একটা বক্স। একদিন হুট করেই নীলু এমনটাই বায়না ধরেছিলো। সেইদিন দিতে পারেনি। কিন্তু আজ দিবে। মনে ভেসে উঠছে নানান কথা। একটু অন্যমনস্কই হয়ে পড়েছিলো নীল। কিন্তু সামনে যখন তাকালো ঠিক তখনই লক্ষ করলো একটা ছোট্ট বাচ্চা সামনে। বাইকটা একটু ঘুরিয়ে নিতেই একটা দ্রুতগামী ট্রাক এসে ধাক্কা দেয়। থেমে যায় সব কিছু।
ছেলেটাকে নিয়ে যাওয়া হলো। স্থানীয় পুলিশ এসে বাইকটা নিয়ে গেল। আস্তে আস্তে মানুষের ভীড় কমতে শুরু করেছে। এক সময় সবাই চলে গেল। একজন লোকের হঠাৎ করেই কিছু একটা চোখে পড়তেই থেমে গেল। আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে বক্সটা তুলে নিলো। খুব ছোট একটা বক্স। আশেপাশে একবার তাকালো লোকটা। তারপর বক্সটা খুলে ফেললো।একটা খুব সাধারণ পুতুল,সাথে একটা ছোট্ট কাগজ। লোকটা চোখের সামনে কাগজটা মেলে ধরলো। আর চোখে ভেসে উঠলো খুব সুন্দর আর গোটাগোটা অক্ষরে লেখা, “শিরোনামে তুমি”।