ছোটবেলায় সব সময় দেখতাম বাবা মায়ের মতামতকে কখনোই গুরুত্ব দিতেন না। মা যদি কখনো কোনো বিষয়ে তার মতামত প্রকাশ করতেন বাবা ধমক দিয়ে মাকে চুপ করিয়ে রাখতেন। আমাদের নতুন বাসার যখন কাজ শুরু করে তখন মা বাবাকে বলেছিলো,
“বাথরুমের নিচে টাইলস লাগাইও না। সাবান-পানি পড়ে টাইলস আরো বেশি পিচ্ছিল হয়ে যাবে,পরে গিয়ে দূর্ঘটনা ঘটবে। ” মার কথা শুনে বাবা মাকে ধমক দিয়ে বলেছিলো, ” তোমার এত পন্ডিত গিরি দেখাতে হবে না! ” এর ঠিক ৭ মাস পর বাবা ওয়াশরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছিলো।
বাবা যখন টাকা পয়সার হিসাব করতো তখন মা যদি বাবার পাশে বসতো তাহলে বাবা মাকে ধমক দিয়ে বলতো,
” তুমি মেয়ে মানুষ, টাকার হিসাব জেনে তুমি কি করবে? যাও অন্য রুমে যাও” টুকটাক রাজনীতির সাথে বাবা জড়িত ছিলো। রাজনৈতিক কি একটা ঝামেলার কারণে একবার বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। মা যখন থানায় যায় তখন ওসি সাহেব কোনভাবেই মাকে বাবার সাথে দেখা করতে দেয় নি। মা যখন থানা থেকে বের হয়ে আসবে তখন হাবিলদার বলেছিলো,
“ওসি সাহেবকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে দেন আর আপনার স্বামীকে এখনি ছাড়িয়ে নিয়ে যান।” মা ৫ হাজার টাকা ঘুষ দিতে পারে নি যার ফলে বাবাকে ২১ দিন জেল কাটাতে হয়েছিলো.. জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বাবা বাসায় এসে মাকে বলেছিলো, ” হাবিলদার বললো তুমি ৫ হাজার টাকা দিলেই নাকি পুলিশ আমায় ছেড়ে দিতো। শুধু শুধু তোমার জন্য আমার এত কষ্ট করে ২১টা দিন জেল কাটাতে হলো।” মা তখন বাবার কথার উত্তরে বলেছিলো, ” আমি মেয়ে মানুষ দেখে টাকা কোথায় রাখো না রাখো আমায় কখনো জানাও নি। আমি জানবো কিভাবে তুমি টাকা কোথায় রেখেছো? তাই ওসি সাহেবকে টাকা দিতে পারি নি..”
আমি সবসময় দেখেছি বাবা যখনি মার মতামতকে অবহেলা করেছে তখনি বাবা ধরা খেয়েছে। কিন্তু এত ধরা খাওয়ার পরও বাবার শিক্ষা হয় নি। শিক্ষা হয় নি কারণ বাবা একজন পুরুষ। আর বেশিরভাগ পুরুষ নারীর মতামতকে প্রাধান্য নিতে চায় না। ভার্সিটির ক্যাম্পাসের একটা কোনে চুপচাপ বসে কবিতা লেখার চেষ্টা করছি। আমার কিছুটা সামনে ভার্সিটির কয়েকজন বড় ভাই আর বড় আপু আড্ডা দিচ্ছে। আমি না চাইতেও উনাদের কথা বার্তা সব আমার কানে আসছিলো। তাই বাধ্য হয়ে যখন উঠে অন্য জায়গায় চলে যাবো ঠিক তখন শুনি উনারা নারী- পুরুষ নিয়ে তর্ক করছেন।
একজন আপু বলছেন, ” দেখ তোরা ছেলেরা আজ যা যা পারিস, বর্তমান যুগে আমরা মেয়েরাও ঠিক তাই তাই পারি । তাই মেয়েদের আর অবহেলা করবি না।” আপুর কথা শুনে একটা ভাইয়া উত্তর দিলো, ” আমরা ছেলেরা খালি গায়ে রাস্তায় হাঁটতে পারবো; তোরা মেয়েরা কি তা পারবি? আমরা ছেলেরা রাস্তায় যেখানে সেখানে বসে প্রস্রাব করতে পারবো; তোরা মেয়েরা কি তা পারবি? আমরা ছেলেরা প্রতিবছর অনেকগুলো বাচ্চার জন্ম দিতে পারবো ; কিন্তু তোরা মেয়েরা প্রতি বছর একটার বেশি বাচ্চা জন্ম দিতে পারবি না। তাহলে তোরা কিভাবে বলিস আজকাল ছেলেরা যা পারে, মেয়েরাও তাই তাই পারে?” ভাইয়ার কথা শুনে সব ছেলেরা হাসতে লাগলো। আর যে আপু কথাটা বলেছিলো উনি মাথা নিচু করে রইলো.. কেন জানি আমি ভাইয়ার কথাটা সহ্য করতে পারি নি। আমি হাসতে হাসতে ভাইয়ার কাছে গিয়ে বললাম,
— ভাইয়া, আমার যদি নোবেল দেওয়ার ক্ষমতা থাকতো তাহলে এই যুক্তিটার জন্য আমি আপনাকে নোবেল দিতাম। কিন্তু ভাইয়া আমার কিছু কথা আছে। আর কথাটা হলো; দৈহিক গঠন আর শারিরীক ক্ষমতা দেখিয়ে একজন পুরুষ আর নারীর মাধ্যে পার্থক্য বিবেচনা না করে একটু বিবেক বুদ্ধি দিয়েও তো বিবেচনা করা যায়। পৃথিবীতে এমন কোনো সেক্টর দেখাতে পারবেন যেখানে নারীর পদার্পণ নেই? তবুও আপনারা কেন মানতে চান না একজন নারীও পুরুষের সহিত সমান তালে কাজ করতে পারে? শুধু নোংরা কয়েকটা বিষয় নিয়ে আপনারা নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য খুঁজে বের করেন। যে আপু মাথা নত করে রেখেছিলো সে আপুকে বললাম,
— আপি, এইসব কথা শুনে মাথা নিচু না করে বরং মাথাটা উঁচু করে ঐসব পুরুষদের চেহারাটা মনে রাখুন; যারা নারীদের কাঁধ বরাবর রাখে না। রাখে শুধু পা বরাবর..
আবেগের বসে কথাগুলো বলার পর বুঝতে পারলাম আমি কতবড় ভুল করে ফেললাম । অলরেডি আমার নাক বরাবর কয়েকটা ঘুষি পরে গেছে। মার খেয়ে কোনোরকমে বড় ভাইদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছি। নাক দিয়ে গড়িয়ে পরা রক্ত টিস্যু দিয়ে মুছছি আর ভাবছি, আরে আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম আমি পুরুষ শাসিত সমাজে বসাবাস করি। আমি একা একজন পুরুষ একজন নারীকে যত উপরেই বসাই না কেন বাকি পুরুষগুলো ঠিকই টেনে নিচে নামিয়ে ফেলবে ভর দুপুরের গরমের মধ্যে ১ঘন্টা ধরে জ্যামে আটকে আছি। গরমে এমনিতেই মাথা নষ্ট হয়ে আছে। তারউপর আমার সামনের সিটে বসা একজন ভদ্রলোক আরেকজন ভদ্রলোককে বলছে, ” ভাই, নারী জাতি খুব খারাপ জাতি। এরা খুব লোভী হয়। আজ আপনার টাকা আছে নারীরা আপনার পাশে ভীড় করবে। আর টাকা নাই নারীরা আপনায় ফেলে চলে যাবে! ” কথাটা শুনে আমি ভদ্রলোককে মিষ্টি হেসে বললাম,
— ভাই, আপনি কি কোনো পুরুষের পেটে জন্ম নিয়েছিলেন? ভদ্রলোক আমার কথা শুনে রেগে গিয়ে বললো,
-ঐ মিয়া ফাইজলামি করেন? পুরুষের পেটে জন্ম নিবো কেন? আমি শান্তভাবে ভদ্রলোককে বললাম,
— নারীর পেটে জন্ম নিয়ে নারী জাতিকে নিয়েই এত বাজে মন্তব্য করতে আপনার লজ্জা করছে না? আপনার মা বোনেরও কি টাকার উপর লোভ আছে নাকি? ভদ্রলোক যখন রেগে গিয়ে আমার কাছে আসলো তখন আমি উনাকে ধমক দিয়ে বললাম,
– আপনার মা বোনদের নিয়ে খারাপ মন্তব্য করেছি বলে আপনার এত খারাপ লাগছে কিন্তু আপনি তো ঠিকই অন্যের মা- বোনদের নিয়ে খারাপ মন্তব্য করছেন। নারী/পুরুষ দুই জাতের মাঝেই ভালো -খারাপ আছে। কিছু নারী যেমন আছে অর্থলোভী তেমনি কিছু পুরুষও আছে যারা ‘নারী দেহ লোভী’। আমরা পুরুষরা শুধু নারীর দোষটাই খুঁজি অথচ আমাদের নিজেদের দোষটা আমাদের চোখেই পড়ে না ! শ্রাবণী(আমার স্ত্রী) আর আমি একসাথে বসে টিভি দেখছি। এমন সময় বাবা ফোন দিয়ে বললো তাড়াতাড়ি নিচে আসতে। শ্রাবণী আর আমি তাড়াহুড়ো করে নিচে নামলাম। বাবা আমায় দেখে একটা গাড়ি দেখিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
-আমার বন্ধুর গাড়ি। ২ মাস আগে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলো এখন মাত্র ১৩ লাখ টাকা দিয়েই বিক্রি করে দিবে। চিন্তা করছি আমি গাড়িটা কিনবো। বাবার কথা শুনে শ্রাবণী আমাকে বললো,
~১৩ লাখ টাকা দিয়েই যেহেতু গাড়ি কিনবে তাহলে পুরাতন গাড়ি কেন কিনবে? আর কিছু টাকা দিয়ে নতুন গাড়িই না হয় কিনো। আমার মনে হয় এই গাড়িতে কোনো সমস্যা আছে। তা না হলে কোনো কারণ বাদে শুধু শুধু কেন নতুন গাড়ি বিক্রি করে দিতে চাইবে! শ্রাবণীর কথা শুনে আমি বাবাকে বললাম,
— বাবা, শ্রাবণী ঠিকই বলেছে। গাড়িতে নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা আছে। আমরা নতুন গাড়ি কিনবো। এই গাড়ি বাদ। আমার কথা শুনে বাবা রেগে গিয়ে বললো,
– এখন তো বউয়ের কথাতেই নাচবি। কাপুরুষ কোথাকার বাবা রেগে চলে গেলো। আমি মনে মনে বাবাকে বললাম,
— তুমি যে ভুল করেছো আমি সেই ভুলটা করতে চাই না। আমি আমার স্ত্রীর মতামতের দাম দিতে চাই। আর এতে যদি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমাকে কাপুরুষ হয়ে থাকতে হয় আমি না হয় কাপুরুষ হয়েই থাকবো…