নতুন ভবিষ্যতের আলো

নতুন ভবিষ্যতের আলো

আমার স্বামী মারা যাওয়ার তিন মাস পর প্রতিবেশী আনিস সাহেব আজ আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। ঠিক ভাবে না বললে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা থেকে যায়। আমার থেকে মাত্র কয়েক বছরের বড় আনিস সাহেব নিজেও বিপত্নীক। তার স্ত্রী মারা গেছেন তিন বছর আগে। এ কয় বছর ভদ্রলোক একাই ছিলেন। প্রতিবেশী হিসেবে তার সাথে মাঝে মাঝে কথা হত। আমার স্বামী জামশেদ বেশ কয়েক বছর ধরেই অসুস্থ ছিল। ওর বিভিন্ন প্রয়োজনে আনিস সাহেব কিছুটা সাহায্য করেছেন। সে সুবাদে এ বাসায় আসা যাওয়া ছিল উনার। পাঁচ বছর ক্যান্সারের সাথে লড়ে জামশেদ মারা যায় তিন মাস আগে।

সেদিনের পরে আর আনিস সাহেবের সাথে দেখা বা কথা কোনটাই হয়নি। আমিও বাচ্চার স্কুল আর সংসার গোছানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আজ সকালে আরিয়ান কে স্কুলে পাঠিয়ে বাসায়ই ছিলাম। মাঝখানে আরিয়ান কয়েকদিন অসুস্থ থাকায় অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। ঘরের সোফায় বসে টিভি দেখছিলাম, হঠাৎ দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ পেলাম। দরজার পিপহোল দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আনিস সাহেব দাড়িয়ে আছেন। দৌড়ে পাশের ঘর থেকে ওড়না এনে কাপড় ঠিক করে নিয়ে দরজা খুলে দিলাম। কুশল বিনিময়ের পরে তাকে ভেতরে আসতে বললাম। কিছুটা ইতস্তত করে আনিস সাহেব ঘরে আসলেন। সোফায় বসে হালকা কথা সেরেই তিনি আসল কথা, অর্থাৎ বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।

তার মতে, আমরা দুজনেই যথেষ্ট স্বাবলম্বী, তাই নিজেদের মধ্যে কথা যা হওয়ার সোজাসাপটা হওয়াই উচিৎ। আমরা যদি এখন মৃত স্বামী বা স্ত্রীর স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকি, তাহলে তা নিতান্তই অবিবেচকের মতো কাজ হবে। তাই এই দিকটা তিনি ভেবে দেখতে বললেন। আর আরিয়ানকেও তিনি বেশ আদর করেন। তাই এতে খুব একটা সমস্যা হয়তো হবে না। কেন জানি না, আমার খুবই রাগ হচ্ছিল। খুবই ভদ্র ভাবে আমি তাকে বললাম ভেবে তাকে পরে জানাবো। তিনি চলে যাওয়ার পরে আমি মনে মনে বেশ খানিক্ষন তার উপর রাগ ঝাড়লাম। টেবিলের উপরে রাখা জামশেদের ছবি টা ওড়না দিয়ে মুছে সেটা হাতে নিয়ে বেশ খানিক্ষন কাঁদলাম। এত সহজেই আর এত তাড়াতাড়ি কি সব ভুলে যাওয়া যায়! তাই কি উচিৎ?

পরদিন আবার অফিস শুরু হলে কাজের চাপে আনিস সাহেবের কথা আমি একেবারেই ভুলে যাই। কিন্তু তা ভুলেও আর বেশিদিন থাকা যায় না। প্রায় প্রতিদিনই অফিস থেকে বের হওয়ার আগে বড় স্যাররা এসে আরও বেশ কিছু ফাইল ধরিয়ে দিয়ে যান দেখে দেওয়ার জন্য। সবার সামনে এমন ভাবে বলেন কাজগুলো আজই শেষ করতে, যেন মনে হয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফাইল এগুলো, যা না হলে অফিসই চলবে না। আসল ব্যাপারটা জানি আমি। এই ফাইলগুলোর একটারও কোনো গুরুত্ব নেই।

সবাই চলে যাওয়ার পরেও যেন কাজের চাপে আমি থেকে যাই, এজন্যই এগুলো দেওয়া। অবশ্য এ নতুন কিছু নয়। গত তিন মাস ধরেই বেশিরভাগ দিনেই হয়ে আসছে এমনটা। আজকে রফিক স্যার, কাল বড় স্যার, পরশু হয়তো অন্য কেউ। সবারই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে যায় অফিস শেষের আগে। যে অজুহাতই দেখাক না কেন, আমি জানি তাদের আসল উদ্দেশ্য আমার সাথে কিছুটা খাতির জমানো। বেশ আগেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম বাকি সব বিধবা মেয়েদের মতই আমাকেও এই সমাজের কিছু বোঝা সামলাতে হবে। আর তাই কষ্টে হলেও এই তিন মাস আমি তাদের এই বাড়তি খাতির জমানোর ধান্দা কে এড়িয়ে চলতে পেরেছি।

অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে বিধবা হওয়া একটা সুন্দরী মেয়ের জন্য এ সমাজ যে কতটা নিষ্ঠুর তা আমি টের পেতে শুরু করেছি আগে থেকেই। অফিসের সবাই মোটামুটি জেনে গিয়েছিল। প্রথম দিকে সান্ত্বনা দেওয়ার নামে সবাই এসে অনেক কথা বলত। সেই থেকে যে শুরু! এখনো পর্যন্ত আমি না চাইলেও তারা এসে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে যায়। সেই সাথে খুব সামান্য হলেও বাজে ইংগিত দিয়ে যাবেই। সামাজিকতা রক্ষায় হাসিমুখে তাদের সাথে কথা বললেও মনে মনে কত হাজার বার তাদের মুন্ডুপাত করেছি তা যদি তারা জানতো!

মাত্র তিন মাসও যে সময়ের হিসেবে কতটা বড় তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। অফিসে ঢুকার পর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত আমি ঘড়ির কাটায় সময় গুনি। কখন এতগুলো হায়েনার দৃষ্টির বাইরে যেতে পারব। কখন আমার ছেলেটা তার মা কে কাছে পাবে৷ একটা মুহুর্তের জন্য আমার অফিস ভালো লাগে না। তারপরও সংসার চালানোর জন্য, সমাজে নিজের সম্মানটা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য এই চাকরিটা আমার দরকার৷ তাই হাজার অপমানের পরেও এক বুক ঘৃণা নিয়ে আমি সময়গুলো কাটিয়ে দিচ্ছি। অফিসের প্রতিটি মানুষকে আমি নতুন করে চিনতে শিখেছি। কারও কাছেই আমি তাদের কলিগ না৷ নিতান্তই একটা ভোগ্যপণ্য শুধুই একটা মেয়ে, যার সাথে খাতির করে তাকে বিছানায় নিতে পারলেই বাকি পুরুষগুলোর যেন যুদ্ধ জয় হবে । এমনকি অফিসের সব থেকে গোবেচারা, অফিসের সাতে পাঁচে না থেকে সংসার নিয়ে থাকায় স্ত্রী পাগল বলেই যাকে সবাই চেনে, সেই আজমল সাহেবও মাঝে মাঝে চলে আসেন আমার রুমে। দরদী কন্ঠে বলেন,

-আপনার মতো সুন্দরী আর ভাল মেয়ের সাথে যা হয়েছে তা খুবই অবিচার। পুরুষের চোখের ভাষা পড়ার বিদ্যাটা যে মেয়েরা জন্ম থেকেই পায়, তা জানলে হয়তো আজমল সাহেব কথা বলার সময় আঁড় চোখে বুকের দিকে তাকাতেন না।

শেষ আঘাতটা আসে কিছুদিনের মধ্যেই। অফিসের খারাপ সময়ে কর্মী ছাটাই এর লিস্টে যেন আমার নাম না থাকে এর জন্য অফিসের বড় সাহেব আমাকে সাহায্য করতে চান। বিনিময়ে তিনি চান আমার সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে। আমি আগে থেকেই এটা বুঝতে পেরেছিলাম। তাই অন্য একটা চাকরির চেষ্টা করছিলাম আগে থেকেই। আরেকটা চাকরি পেয়েও যাই। তাই বড় সাহেবের মুখের উপর আমি চাকরি ছেড়ে দেই। কর্মী ছাটাই এর অযুহাতে চাকরি না ছেড়ে সম্মানের সাথেই আমি ছেড়ে আসি চাকরিটা।

সেদিন বাসায় আসতে আসতে আমি অনেক কিছুই ভাবি। আমার কথা, আরিয়ানের কথা। এই অফিসে কাটানো খারাপ সময়গুলো বা নতুন অফিসই বা কেমন হবে এ সব কিছু ভাবিয়ে তুলে আমাকে। আমি বুঝতে পারি, চাইলেও কিছু জিনিস পাল্টানো যায় না৷ আর এর জন্যই কষ্ট হলেও আমার আনিস সাহেবের কথাটা ভেবে দেখতে হবে। আরিয়ানের জন্য হলেও এই সিদ্ধান্তটা আমার নিতে হবে। আমি জানি, এই সমাজের প্রতিটি মানুষ আমার সমালোচনা করবে, আড়ালে কথা বলবে আমাকে নিয়ে। কিন্তু আমি এটাও জানি, এই সিদ্ধান্ত না নিলে এই সমাজই আমাকে ভালো ভাবে সম্মানের সাথে বাঁচতে দিবে না।

বাসায় ফিরে আমি জামশেদের ছবি টা আরেকবার মুছে নেই ওড়না দিয়ে। তিনমাস হয়তো সময়ের হিসাবে কম। কিন্তু এই কম সময়েও নতুন আরেকটা সম্পর্কে জড়ানোতে কোন ভুল আমি দেখি না। সমাজের কথায় কান না দিয়ে নিজের, নিজের পরিবারের জন্য ভালোটাই আমার করতে হবে। আমি ফোনটা তুলে নিয়ে আনিস সাহেবের নাম্বার ডায়াল করি৷ আমার কল পেয়েই হয়তো তিনি আমার সিদ্ধান্ত বুঝতে পারেন। তাই অন্য বারের মতো মিসেস জামশেদ না বলে আমার নিজের নাম ধরেই ডাকেন তিনি। বিয়েতে আমার সম্মতির ব্যাপারটা তাকে জানাই। কিছুটা কষ্ট হলেও একটা নতুন ভবিষ্যতের আলো দেখে আমরা দুজনেই হেসে উঠি ফোনের দুপাশে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত