প্রথমা

প্রথমা

মা ছিলেন আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী।শুনেছি বাবা নাকি তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে ;যদিও সে ভালোবাসার লেশমাত্র আমার চোখে পড়েনি।আমার বাবার প্রথম স্ত্রী ছিলেন দুই সন্তানের জননী।তিনি অত্যন্ত স্নেহ সুলভ ও যত্নশীলা ছিলেন।এসব অবস্য আমার শোনা কথা।কারণ ,আমার জন্মের আগেই তিনি এ বাড়ি ছেড়েছিলেন।উনি খুব ধনী পরিবারের মেয়ে ছিলেন।আমার বাবা তাদের ব্যাবসার হিসাবরক্ষক ছিলেন।অত:পর প্রেম ,বিয়ে।যদিও এসব আমার বড়মা পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েই করেছে।বাবার জন্য সে নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করেছে।আমার বাবার জীবনের চড়াই-উৎরাই গুলোতে বাবাকে সঙ্গ দিয়েছেন।বড়মাকে বিয়ের পর বাবার কোনো চাকরি ছিলো না।তখন নিজের গয়না -গাটি বিক্রি করে বড়মা-ই সংসার চালাতেন।

ধনীর দুলালী হওয়া সত্ত্বেও আমার মধ্যবিত্ত বাবার সংসার চালাতে তিনি লোকের বাড়ি কাজ পর্যন্ত করেছেন।এরপর বাবা একটা স্কুলে পার্ট টাইম চাকরি পায়।এর বেশ কিছুদিন পর বড়মার কোল আলো করে আসে আমার নবনী আপু।আর নবনী আপুর দুবছর পর শ্রাবন ভাইয়া।উনারা বেশ সুখেই ছিলো।এরপর বড়মার পরিবারও সবটা মেনে নেয়।মেয়ে ও মেয়ে জামাইয়ের সাচ্ছন্দ্যের জন্য অনেক গুলো টাকা পাঠায় বড়মায়ের বাবা।সমস্ত কাজ নিজ হাতে করেও নাকি বড়মায়ের মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকতো। এরপর এ সংসারে আসেন আমার মা।আমার মাকে যখন বাবা বিয়ে করে তখন তার বয়স ছিলো সবে পনেরো।বাবার ছাত্রী ছিলো তিনি।আমার মা অসম্ভব রূপবতী ছিলেন।তাই,হয়তো বাবা তার প্রেমে পরেছিলো।মাকে বিয়ে করে যখন বাবা প্রথম ঘরে ওঠে তখনও নাকি বড়মায়ের মুখ থেকে হাসি সরেনি।

বরং একরাশ হাসি নিয়েই বলেছিলো,”বাহ! দারুন সুন্দর মেয়ে তো।” এরপর রাতে ভালো খাবার-দাবার রান্না করে আমার মাকে খাইয়েছিলো তিনি।হাসি মুখে গল্প করেছিলো,বলেছিলো ,এই সংসার এখন থেকে তোমার।আমার ছেলে -মেয়ে দুটো ভীষণ শান্ত।তোমাকে একটুও জ্বালাবে না।তুমি ওদের খেয়াল রেখো।আর ওদের বাবারও। এরপর তিনি নবনী আপু আর শ্রাবন ভাইয়াকেও সারা রাত ধরে বুঝিয়েছেন ,মা গো তোমাদের মা এখন পুরাণো হয়ে গেছে।কোনো জিনিশ পুরানো হলে তো তোমরা নতুন জিনিস আনো তাই না?এখন দেখো তোমাদের নতুন মা এসেছে।তোমরা তার সঙ্গে থাকবে কেমন?আমার জন্য মন খারাপ করবে না।

এসব কথা নবনী আপুই বলেছে আমাকে। যাহোক,পাড়াশুদ্ধু সবাই বড়মা কে পাগল বলছিলো কারণ তিনি থাকতেও বাবা আরেকটা বিয়ে করলো অথচ তিনি প্রতিবাদ করলেন না। তিনি তখনও হেসেছেন।বলেছেন,অনেক আগলেছি সংসারটাকে,উনাকে এখন না চাইতেও ছুটি দিয়ে দিলে আমি কি করবো?জোর করে অধিকার পাবো ; স্বামীর ভালোবাসা আর আগের মতো পাবো না। এরপর দিন ভোরে তিনি তার বাপের বাড়ি চলে যান।কাউকে কিছু না বলে। শুনেছি বিভিন্ন আত্মিয়দের দ্বারা নবনী আপুদের খোঁজ নিতেন ।উনাদের স্কুলে গিয়ে দেখা করতেন কিন্তু এ বাড়িতে আর দ্বিতীয় বার আসেননি।

আমার মা অল্প বয়সী ছিলো।এ ভরা সংসার সামলাতে গিয়ে ভীষন হিমশিম খেতো এটাই স্বাভাবিক।আবার কেউই তাকে সেরকম পছন্দ করতো না।এমন সময় আমি হই।বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখছি বাবা কেমন যেনো।কারো সঙ্গে ভালো করে কথা বলতো না।নেশা-টেশা করতো।সবার সাথে চেঁচামেচি করতো।আর রাত হলে একা একা কাঁদতো।হয়তো ,বড়মাকে মিস করতো।রূপের মোহ একসময় কেটে যায়।বাবারও তাই হয়েছিলো।তার দুঃসময়ের সঙ্গীকে মনে পড়তো।এমন সঙ্গী যে চলে যাওয়ার পরও তার কোনো ক্ষতি করেনি। আমার মাকে তিনি দুচোখে দেখতে পারতেন না। স্বামীর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই মনে হয় আমার মা অন্য কারো হাত ধরে চলে গিয়েছিলেন।যাওটা অস্বাভাবিক নয়।তবে আমি খালি ভাবি যাওয়ার আগে কি তিনি আমার ঘুমন্ত মুখটার দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন?মনে হয় তাকায়নি।তাকালে কি যেতে পারতেন?আচ্ছা,উনি কি ভাবে নি যে সকাল হলেই তো আমি প্রথমে উনাকে খুঁজবো।

আমার দিনগুলো তখন কাটতো চরম বিষাদগ্রস্ততায়।নবনী আপু ,শ্রাবন ভাইয়া কেউ আমাকে সেরকম পছন্দ করতো না।খুব কষ্ট পেতাম আমি। এর কিছুদিন পর বাবাও মারা যান।তখন আমার বড় মা জানান শ্রাবণ ভাইয়া আর নবনী আপুকে তিনি নিতে আসবেন।একা এখানে কিভাবে থাকবে তাই? আমার এতো মন খারাপ হলো!আমার মাও যদি আমাকে নিতে আসতো এ বিষাদপুরী থেকে যেদিন বড়মা নবনী আপুদের নিতে এলো আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। চলে যাওয়ার সময় হঠাৎই উনি পিছন ফিরে বললেন,আরে তোর কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।আয় মামণি।
আমি অবাক হলাম।আমাকেই বলছে তো?

এরপর উনি নিজেই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।হাসি দিয়ে বললেন,রাগ করেছিস মা?আয় আমাদের সাথে আয়।তোদের কবেই নিয়ে যেতাম।তাহলে তোদের বাবাকে দেখতো কে? বড়মার চোখ ভিজে গেলো। এরপর আমরা চলে এলাম।আমার কখনো মনেই হয় নি আমি উনার সন্তান নই। বরং,আপু আর ভাইয়া যখন বিদেশ চলে গেলো পড়তে তখন আমিই ছিলাম উনার সর্বক্ষণের সঙ্গী।আমি জিজ্ঞেস করতাম,তোমার আমার মায়ের উপর অনেক রাগ তাই না? উনি হেসে বলতেন,নারে বোকা মেয়ে। আমি বলতাম,আমার কিন্তু অনেক রাগ। উনি বলতেন,ছি: এসব বলতে হয় না।

কখনো জিজ্ঞেস করতাম,ও বাড়িতে কেনো কখনো যাওনি? হেসে উত্তর দিতো,যেখান থেকে চলে এসেছি সেখানে যাবো কিভাবে?ও বাড়িতে গেলেই তো মন খারাপ হবে।কষ্ট হবে।তবে,তোদের খারাপ কখনো চাইনি বিশ্বাস কর। আমি উনার দিকে তাকিয়ে ভাবতাম,মানুষ এমনও হয়! একদিন উনি বললেন,আজ অবধি আমাকে মা বললি না তুই?আমি কি এখনো মা হয়ে উঠতে পারিনি? আচ্ছা মা ডাকতে না পারিস বড়মা ,প্রথম মা কিছু তো একটা বল। আমি বললাম,প্রথমা। উনি হাসলেন। আমি মনে মনে বললাম,তুমি প্রথমাই…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত