বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে, একগাদা শপিং ব্যাগ হাতে এক শুশ্রী রমনীর সাথে ধাক্কা খাই। মেয়েটির হাতের শপিং ব্যাগ সব পড়ে যায়। আমি লজ্জিত ভঙ্গিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলি, সরি। মেয়েটি সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলে, ইট’স ওকে। আমি ব্যাগ গুলো তুলে মেয়েটির হাতে দিতে দিতে বলি, ধন্যবাদ। মেয়েটি বলে, আপনি কি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছেন? আমি বলি,
-আপনার কি এরকম মনে হয়েছে?
-মনেহয়নি, কিন্তু আপনাকে আমার কিছুটা পরিচিত মনেহচ্ছে। মনেহয় আপনাকে কোথাও দেখেছি?
আমি মুচকি হেসে বলি, আপনি নীতু? পেশায় নার্স? মেয়েটি অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি আমাকে চিনেন?
-আপনার সাথে দেখা হয়েছিলো দুই বছর আগে হাসপাতালে। ভয়ার্ত আর বিরক্ত চোখে তাকিয়ে ইঞ্জেকশন পুশ করলেন।
-হাহাহা তাই?
-হুম।
-আচ্ছা আপনার নামটা কি?
-শফিক।
-আচ্ছা শফিক সাহেব ভালো থাকেন।
-আপনিও ভালো থাকবেন।
মেয়েটি হাটতে হাটতে চলে যায় আমি তাকিয়ে থাকি তার দিকে। সেবার রিক্সা করে কোথাও যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে জোড়ে একটা সিএনজি এসে রিক্সাকে ধাক্কা দেয়। আমি পড়ে যাই রিক্সা থেকে। সিএনজির একটা চাকা যায় আমার পায়ের ওপর দিয়ে। তারপর যেতে হয় হাসপাতালে। সেখানেই এই মেয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা। হাসপাতালে ছিলাম দশ দিন। এক রাতে ঔষধ খেতে ভুলে যাই। পরদিন মেয়েটা রাগ আর বিরক্তি চোখে তাকিয়ে বলে, আপনারা কী কোনভাবে সিরিয়াস হতে পারেন না? আর আপনার সাথে কোন আত্নীয় স্বজন দেখছিনা?
-জ্বি, ঢাকায় আমার কোন আত্নীয় স্বজন নেই।
-তো খাবার পান কোথা থেকে?
-যে রিক্সায় এক্সিডেন্ট করেছি সে রিক্সাওয়ালা সকালে আর রাতে খাবার দিয়ে যায়। এবার মেয়েটা কিছুটা নরম হয়ে বলে,
-আচ্ছা, আর অনিয়ম করবেন না।
তারপর থেকে মাঝে মাঝেই মেয়েটা আমার খোজ খবর নেয়। নিজে খোজ করে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে যায়। আমার খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে আমার তার হাত ধরে গল্প করতে মন চায়। পরে নিজেই মনে মনে হাসি। যেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরি সেদিন মেয়েটা আমার হাতে একটা ফুলের তোরা ধরিয়ে দিয়ে বলে, রাস্তাঘাটে ভালোভাবে দেখেশুনে চলবেন। আমি বলি, আচ্ছা। তারপর চলে গেছে এক বছর। মেয়েটা হয়তো সবকিছু ভুলে বসে আছে। দুই বছরে কত রোগীর সাথেই তার দেখা হয়েছে, ভোলাটাই স্বাভাবিক।
-এই যে সফিক সাহেব শুনছেন?
শাহবাগ থেকে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছি হেটে হেটে, পেছনে তাকিয়ে দেখি নীতু নামের মেয়েটি রিক্সা থেকে ডাকছে আমাকে। আমি বলি,
-আরে আপনি?
-হুম। যাচ্ছেন কোথায়?
-ফার্মগেট।
-উঠে আসুন আমি ওইদিক যাবো।
-উঠবো?
-সংকোচ আছে নাকি?
-না। আমি রিক্সায় উঠে বলি,
-আপনি চিনলেন আমাকে?
-আমার ব্রেন খুবই ভালো। সহজে কাওকে ভুলিনা।
-আচ্ছা তাই?
-হুম। তারপর কেমন আছেন?
-ভালো।
-সেদিন আপনাকে চিনতে পারিনি, কিছু মনে করেছেন?
-আপনার না চেনাটা অস্বাভাবিক কিছুনা। কাজের ক্ষেত্রে অনেকের সাথেই পরিচয়। সবাইকে মনেরাখা কি সম্ভব?
-হুম ভালো বলেছেন। তবে সেদিন আপনার কথা ভাবতে ভাবতে যখন মনে পড়লো। তখন কেন যেন কিছুটা অপরাধ বোধ কাজ করছিলো।
-হাহাহা। তাই?
-হুম। সফিক সাহেব একটা কথা জানার ছিলো?
-বলুন..
-আপনি হঠাৎ করে গুম গেলেন কারণটা কি জানতে পারি?
-বুঝলাম না?
-আপনার বিষয়টা আমি লক্ষ করেছিলাম। আপনি মাঝে মাঝেই হাসপাতালের সামনে আসতেন কিছুদিন। তারপর হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলেন?
-কই নাতো এমনি। কাজ থাকতো হয়তো কোন , তখন যেতাম দেখেছেন হয়তোবা।
-হতে পারে।
-হুম।
হাসপাতাল থেকে আসার পর নীতুর কথা আমার প্রবল ভাবে মনে পড়তো। ওর হাত ধরে গল্প করতে মন চাইতো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে মন চাইতো। তাই মাঝে মাঝেই ওর হাসপাতালে যেতাম। দূর থেকে ওকে দেখে চলে আসতাম। দুই তিনদিন হঠাৎ করে দেখা হয়ে গিয়েছিলো নীতুর সাথে। আমাকে দেখে বলতো, সফিক সাহেব এখানে কি করছেন? আবার রিক্সার নিচে পড়েছেন নাকি? হাহাহা। আমি মুচকি হাসি দিয়ে বলতাম, না এমনিতে একটা কাজে আসছিলাম এইদিকে। দুইদিন পর নীতুর নাম্বারে ফোন দেই,
-নীতু বলছেন?
-জ্বি। আপনি?
-সফিক।
-ওও। ভালো আছেন?
-হুম। আপনাকে একটা কথা বলার জন্য ফোন দিয়েছি।
-মনেহয় আমি বুঝতে পেরেছি।
-কি?
-আপনি যে সত্যি মাঝে মাঝে হাসপাতালের সামনে আসতেন সেটা জানাতে।
-হুম ঠিক ধরেছেন!
-হুম।
-নিউমার্কেটের সামনে একজনের সাথে আপনাকে রিক্সায় দেখেছিলাম। তার কি খবর?
-এটাই কি আপনার গায়েব হয়ে যাওয়ার কারণ?
-হতে পারে।
-আচ্ছা।
-আজকে রাখি।
-আচ্ছা।
তারপর নীতুর সাথে আমার অনেকদিন কথা হয়নি। হঠাৎ একদিন আমার অফিসে নীতু এসে উপস্হিত। আমি অবাক হয়ে বলি, আপনি চিনলেন কিভাবে?
-সেটা জানা কি জরুরী?
-না। চা খাবেন?
-না। বাইরে চলেন আপনার সাথে কথা আছে। দুজনে রিক্সা করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাই নীতু বলে,
-আপনাকে কিছু জানাতে চাই।
-বলুন..
-নিউমার্কেটের সামনে যার সাথে আমাকে দেখেছিলেন তার নাম নীলয়। ওর সাথে আমার দুই বছরের সম্পর্ক ছিলো। ও এখন স্পেনে আছে, ওখানে এক প্রবাসী মেয়েকে বিয়ে করেছে।
-কি বলছেন?
-হুম। ও চলে যাওয়ার পর অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছিলাম কাউকে আর তেমন মনে করিনি।
-আচ্ছা।
-হুম। তারপর দুজনে চুপ করে বসে থাকি। নীতু বলে,
-তখন, হাসপাতালের সামনে আপনার ঘোড়াঘুড়ির কারণটা কি জানতে পারি?
-হুম।
-কি ?
-আপনার হাত ধরে গল্প করতে মন চাইতো।
-হাহাহা। এখন ধরতে মন চায়না? আমি কিছু বলিনা, হঠাৎ করে নীতুর হাত ধরি। নীতু মুচকি হাসে।