আরাফের স্বপ্ন

আরাফের স্বপ্ন

আজ আমাদের আরাফের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। সে মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।তার চান্স পাওয়াতে সবচেয়ে খুশি আমার স্বামী।আমার শ্বশুর মশাই পাড়া-পড়শী সবাইকে মিষ্টি বিতরণ শুরু করলেন।আরাফ আমাদের দত্তক নেওয়া সন্তান।বলতে পারি আমার ছাত্র থেকে তাঁকে আমি সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছি।আজ থেকে প্রায় ষোল বছরের ঘটনাটা আমার মনে পড়ছে বারবার। সেদিন স্কুলে আসার পথে আমার ছাত্র আরাফকে দেখলাম,রাস্তার একপাশে একটা ময়লার স্তূপ থেকে হাটু গেড়ে দুই হাতে তন্নতন্ন করে কি যেন খুঁজছে।একটা পলিথিনে মুড়ানো মেয়াদ উত্তীর্ণ পাউরুটির কিছু পিস পেয়ে সে দুই পিস খেয়ে বাকিটা হাতে নিয়ে হাটা শুরু করল।আমাকে দেখে সে দিলো ভূ দৌড়।

প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করছি পাঁচ বছর হলো।এই পাঁচ বছরে অনেক স্টুডেন্ট পেয়েছি,কিন্তু আরাফ ছেলেটার মতো এ পর্যন্ত কাউকে পাইনি।ছেলেটা ক্লাস থ্রিতে পড়ে সবেমাত্র। তার স্বভাব চরিত্র যেমন অগোছালো তেমন একদম সাদামাটা।তেমন কারো সাথে মিশেনা।বলতে পারি,ওর সাথে তেমন কেউ মিশতে চায়না।অনেক বার স্কুল ছুটির পর বাসায় চলে যাওয়ার সময় শুনেছি, ইশ,আরাফ গোসল করিসনা কয়দিন হলোরে?তোর গা থেকে মানুষ মরা গন্ধ আসছে কেন রে?

আরাফ কোন উত্তর দেয়নি কোনোদিন, তবে বুঝতে পারি সে ওদের কথায় অনেক লজ্জিত।ওর চোখে মুখে শিক্ষক সহপাঠী সবার প্রতি ঘৃণার রেখা ফুটে উঠেছে।ক্লাসে শিক্ষকরা তার এই স্বভাবের কারণে প্রায় অপমান করে। পড়াশোনায় ও তেমন ভালোনা।বোঝতে পারি ছেলেটা বাসায় গিয়ে বই ধরার সু্যোগ-ই পায়না।আরাফের মনে কোন এক অজানা চাপা কষ্ট বিরাজ করছে তা তার চেহারার দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায়।আমার তাই ওর সম্পর্কে জানতে ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টার কমতি ছিলোনা।মাঝেমধ্যে ওর গায়ের দুর্গন্ধ অপেক্ষা করেও ওকে একটা কাজ দিতাম।সে বাধ্য ছেলের মতো সেই কাজ অনেক গুছিয়ে করে করে দিতো।কিন্তু তাও ওর মুখে হাসি ফোটাতে পারিনি।

সে আজ অনেকদিন পর স্কুলে এসেছে। তবে যতো সম্ভব আমাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিল।টিফিনের ছুটিতে সব স্টুডেন্ট যখন খাওয়া খেলাতে ব্যস্ত আরাফ তখন চুপচাপ ছাদে গিয়ে পা দুটো ঝুলিয়ে বসে তাকে।আজ দেখলাম ক্লাস থেকে বেরোচ্ছেনা।আগের চেয়ে দুর্বল দুর্বল লাগছিল তাঁকে।বেঞ্চে মাথা গুঁজে দিয়ে কান্না করছিলো সে।আমি মাথায় হাত রাখতে সে চমকে আমার দিকে তাকালো।চোখ মুছে উঠে দাঁড়াতে আমি আবার বসিয়ে দিলাম।সে মাথা নিচু করে বসে পড়লো।প্রশ্ন করলাম,সকালে খেয়ে এসেছিস? সে ডানে বামে মাথা নাড়ালো। তোর বাসায় আর কে কে আছেরে?

–আমি আর দাদি। দাদি থেকেও তুই এরকম দুর্গন্ধ যুক্ত কাপড় নিয়ে স্কুলে আসিস?
–ম্যাম সময় পাইনা।রাস্তায় বেরোতে হয়।তারপর স্কুলের সময় হলে স্কুলে আসতে হয়।
–তোর দাদি কি করেরে?

কিচ্ছু না,অসুখ ছিলো দুইদিন আগে মারা গেলো। ছেলেটার কষ্ট বুঝলাম, কেন সে কাঁদছে তাও বুঝলাম। বললাম, তোর বাবা-মা কোথায়? জানিনা ম্যাম,আমার দাদি আমাকে ভিক্ষা করার সময় পেয়েছিল।তারপর বড় হলে স্কুলে পড়াশোনা করে ডাক্তার হওয়ার জন্য। এতোদিনের ধাঁধা পরিস্কার হলো।আরাফ ছেলেটা জারজ।বললাম, এরকম না খেয়ে পড়াশোনা না করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলে ডাক্তার হতে পারবি?

তার দুই চোখের পানি টপ করে আমার হাতের উপর পড়লো। এতোদিনে ওকে না জেনে কতো অপমান করেছি আমিও।সত্যি কতো অপরাধী আমরা।নিজের পরিচয় না জানা একটা ছেলে স্কুলে ভর্তি হলো ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। তাকে আমরা শিক্ষিত হয়েও শিক্ষা না দিয়ে তার পোশাকের গন্ধের কারণে ক্লাস থেকে বের করে দিই।আরাফেরতো ভাগ্য ভালো সৃষ্টিকর্তা তাঁকে একজন ভালো মানুষের হাতে ফেলেছিলেন।অথচ কতো আরাফ যে স্বপ্ন দেখে যত্ন না পেয়ে অকালে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।খাওয়ার জোটাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে,না পেলে আবার চুরি ডাকাতিও করে।

নিজের বিবেকের গন্ধে আরাফের গন্ধটা আজ আমার কিচ্ছু মনে হয়নি।উদ্ভট একটা গন্ধ পেলাম নিজেই নিজের শরীরে।আরাফের ময়লা হাত ধরে বললাম শুধু আরাফ বাবা আমায় তুই মাফ করে দে। আরাফ আমার দিকে ফ্যালফেল চোখে তাকিয়ে বলল,কেন ম্যাম আপনি কি করেছেন? তুই আরেকটু বড় হলে পড়াশোনা করলে বুঝবি বাপ,আমরা কতো বড় অপরাধী ছিলাম। আরাফ ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাম আমিতো আর পড়লেখা করতে পারবনা।আমি যেখানে থেকে পড়াশোনা করতাম বাসাটা দাদির আত্মীয়রা কেঁড়ে নিয়েছে কাল।তখন থেকে না খেয়ে আছি।আমার বাবা-মাকে খুঁজেছি শুধু।

আমার চোখেমুখে পাষবিক চিত্র ফোটে উঠলো।জারজ বলেই নাকি তার হয়ে লড়ার মতো কেউ নাই বলে সে ধিক্কার নিয়ে বড় হচ্ছে।আর কিছু না বলে বললাম, তোর বাবা-মাকে আমি খোঁজে দিব।ততোদিন তুই আমাকে মা ডাক।
আরাফ রাজি হয়েগেলো।আমাকে ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলো অনেক্ষণ। আমার স্বামী এবং শ্বশুর শাশুড়িও আরাফকে দত্তক নিতে আপত্তি করেনি।আমার স্বামীকে বললেন, ছলেটা ডাক্তার হতে চাই,তোরা কিছুর আশা করিসনা। ওরে আমাদের নাতির মতোই মানুষ কর। আরাফ কাঁদে তার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে, আর আমি কাঁদি তাঁকে আমি সত্যি মানুষ করতে পারবতো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত