আজ রিহানকে সারপ্রাইজটা অনেক ভালো করে দিবো ভেবেছিলাম।সে সারপ্রাইজটা ঠিক কিভাবে নিবে আমি কল্পনাও করতে পারছিনা।নিশ্চয় শুনে অনেক খুশি হবে যে,আমি মা হতে চলেছি।বিয়ের এক বছরের মাথায় রিহানের বাবা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।
দুপুর বারোটার দিকে ছোট ভাইকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমার শ্বাশুড়ি আম্মাকেও সুখবরটা জানাইনি উনি রিহানকে ফোন করে বলে দিবে বলে।উনারা গ্রামের বাড়িতে থাকেন।রিহানের চাকরির সুবাদে ওর সাথে আমি ঢাকায় থাকি।আমার বাপের বাড়িও ঢাকায়।এরেঞ্জড ম্যারিজ আমাদের।বিয়ের পর ভালোবেসেছি অনেক একজন আরেকজনকে।
দুইদিন আগে কিচ্ছু ভালো লাগছিলনা বলে রিহান আমাকে আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিলেন তিন সপ্তাহের জন্য।সে অফিসে অনেক ব্যস্ত বলে সুযোগ হচ্ছিল না ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার। তাই মাকে ফোন করে বলেছিলেন আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে।সকালে মা-মেয়ে গিয়েছিলাম ডাক্তারের কাছে।ডাক্তার জানালো আমার ভিতরে বাবুর বয়স একমাস তেরো দিন হলো আজ।অথচ আমি বুঝতে পারিনি এতোদিন। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম অন্য কোন বড় অসুখ বলে।
সব ভয় দূর হয়ে খুশিতে কেঁদে ফেললাম।অনুভূতিগুলো কাউকে বুঝানোর মতো নয়।এ যেন অন্য রকম ভালো লাগা। আমি সারপ্রাইজটা রিহানকে কখন দিব তা নিয়ে অস্থির হয়ে পড়লাম।কখন পৌছাবে গাড়ি কখন সন্ধ্যা হবে।এক সেকেন্ড যেন এক ঘন্টার সমান মনে হচ্ছে।রিহান অফিস থেকে দরজা খুলে যখন আমাকে দেখবে কি ভাববে সে।আর আমি তাকে রিপোর্টটা হাতে দিয়ে যখন বলব,এবার তোমাকে নয়,ওকে ভালোবাসবো।তুমি বাধ,আমার ছোট্ট সোনা-ই আমার সব।তখন রিহান কি করবে তা আমার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব।
গাড়ি থেকে নেমে ছোট ভাইকে নিয়ে চার তলায় আমাদের ফ্ল্যাটে এসে একটু থমকে গেলাম। রিহান বাসায় আছ।সারপ্রাইজ আমি নিজেই পাচ্ছি নাকি। সোমবারে সে অফিসে যায়নি কেন ভাবছিলাম তখন।মা তাকে আগে ভাগে বলে দেয়নিতো আমার সারপ্রাইজের কথা?বাইরে থেকেও দরজাটা খোলা।সে কি জেনে গেছে আমি যে চলে এসেছি সেই কথা! নানান জল্পনা-কল্পনা করতে করতে দরজাটা খুললাম হালকা। সে কি করছিলো দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল অনেক।কিন্তু যা দেখলাম তারপর দরজাটা আবার টেনে দিয়ে ভাইয়ের হাত ধরে কোনরকম নিচে নেমে আসলাম।
রিহান তার প্রাক্তনের কোলে মাথা রেখে টিভিতে রোমান্টিক সিনেমা দেখতে ব্যস্ত।মেয়েটা আমার শাড়ি পড়ে বসে আছে।দরজা খোলার শব্দ শুনেও দুজনের চোখ ফিরলনা দরজার দিকে।তারা পুরানো প্রেমে গভীরভাবে ডুবিয়ে আছে এখনো।কাঁদতে ইচ্ছে করেছিলো অনেক।পেটে হাত ভুলিয়ে কাঁদলামো অনেক। আমি না থাকার সুযোগে সে আবার প্রাক্তনের সাথে জড়িয়ে গেলো।বুঝলাম অফিসে এতো ব্যস্ততার অযুহাত।মাঝেমধ্যে রাতে না ফেরার কারণ তাহলে এই।সে তো বলেছিল, মেয়েটা তাকে এখন শুধু বন্ধু ভাবে। আর কিছু না।আজ প্রমাণ ফেলাম তারা আরো অনেক কিছু।ছোট ভাইকে বললাম,ভাই আমার আমি দ্বিতীয়বার সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে পারবনা।তোর দুলাভাই বাসায় আছে।তুই দরজা খুলিস না। কলিং বেল বাজিয়ে তোর দুলাভাই দরজা খুললে তাকে লাগেজ আর রিপোর্টটা হাতে দিয়ে আসিস।আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলিস,হাসপাতালে গিয়েছি।তার কোন স্মৃতি আমি রাখবনা বলে দিস। ভাই তাই করলো।
আমি চাইনি রিহানকে এই পরিস্থিতিতে ছোট ভাই দেখে ফেলুক।তাও দেখে ফেললো সে।ভাইকে নাকি রিহানের গার্লফ্রেন্ড পিজ্জা বয় মনে করে দরজা খুলে দিয়েছিলো।রিহানের শালা শুনে রিহান দৌড়ে আসল।ভাই আমার চেয়ে আরো বেশি কিছু দেখে ফেললো।রিহান বুঝে গিয়েছিল আমিও এসেছি।সে রিপোর্ট হাতে নিয়ে আমার কাছে ছুটে আসল।রিপোর্টটা তার জন্য অনেক খুশির হলেও আমার তখন অন্ধকার নেমেছিলো চারদিকে।সে বলল,পাগলামি না করে বাসায় যেতে,মেয়েটা এখনো তার বান্ধবীর মতো। গেইটের বাইরে দাঁড়িয়েছিল যেন জোর করতে না পারে।রিহানের মাঝেমধ্যে কিছু পাগলামির স্বভাব আছে।আমি রাগ করলে রাস্তায়ও কোলে নিয়ে হাঁটা শুরু করে দেয়।কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে আমি অসুস্থ, হাটতে পারছিলাম না তাই সে কোলে নিয়ে হাঁটছে।তবে আজকে সে তেমনটা করলোনা। ছোট ভাই বড়দের মতো প্রতিবাদ করলো, ওর হাতে আমাকে আর তুলে দিবেন না তারা। রিহান ভাইয়ের গালে থাপ্পড় দিয়ে বলে,যার স্ত্রী তার অধিকার,তুই এখানে কথা বলার কে? রিহানের এই চরিত্রে বিস্মিত হলাম। আমি এটা কোন রিহানকে দেখছি।রিহানের আসল রূপ বেরিয়ে আসতে কি এক বছর সময় লাগলো মাত্র।
ছোট ভাই রাগে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।আমি ওর হাত ধরে বললাম, চল ভাই।যার তার সাথে ঝগড়া করে নিজের সম্মানে আঘাত করিস না।আমরা গাড়ীতে উঠলাম আবার। রিহান যে রিপোর্ট পেয়েও খুশি নয় বুঝলাম, যখন গাড়ি থেকে দেখলাম রিহান রিপোর্টটা পাশের ময়লার স্তূপে পেলে দিয়ে উপরে চলে গেলো।।আমার ছোট্ট সোনার জন্য হলেও শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে মিটমাট করে তার সাথে সংসার করতে চেয়েছিলাম আমি।যদি সে আমাকে একবার সরি বলে আবার কোলে তুলে নিতো।
রিহান তার একটাও করলেন না।খোজ খবর ও নিলেন না।বুঝলাম সে এক বছর ধরে আমার সাথে অভিনয়ের সংসার করে আসছে।অভিনয় যদি নিখুঁত হয়,ফলাফলটাও ততো বিন্যাসের সাথে আসে।আজ তার ফলাফল পেলাম আমি।শুধু বিশ্বাস করেছি তাকে,ধরতে পারিনি কোনদিন তার অভিনয় ।তাও অভিনয় করা সংসারে ফিরতে চেয়েছিলাম।
পরিবারের লোকজনের কথায় বাধ্য হয়েও এবরশন করার আগে একটা মেসেজ দিয়ে জানিয়েছিলাম,তোমার স্মৃতিটুকুও মেরে ফেলতে হচ্ছে।ক্ষমা করিও আমাকে।
রিহানের উত্তরের আসায় ছিলাম অনেক্ষণ।যদি বলে আমাকে ক্ষমা করো।তাহলে আমি আমার সব কষ্ট টেলে দিয়ে বাচ্চার জন্য হলেও যেতাম।কিন্তু উত্তর তা এলোনা। অনেক্ক্ষণ পর উত্তর আসলো, ইট’স ওকেই।আমি আর আমার প্রাক্তন বিয়ে করে নিয়েছি। তারপর আর কারো জন্য অপেক্ষা করা হলোনা।আয়নার সামনে দাড়িয়ে পেটে হাত ভুলিয়ে অনাগত ছোট্ট সোনার কাছে ক্ষমা চেয়ে চলে গেলাম ডাক্তারের রুমে।সংসারের ইতি ঘটানোর আগে ঘটে গেলো একটা প্রাণ হানী।