জীবনসংগ্রাম

জীবনসংগ্রাম

বেলা ৩ টা বাজে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আমাকে টিউশনিতে যেতে হবে। হাতে ছাতা নিলাম যাব বলে। মা পেছন থেকে বললেন, আজ না গেলে হয়না বাবা? বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে যে! আমি হাসিমাখা চেহারায় বললাম, এই টিউশনির টাকাতেই তো মা আমার পড়াশোনা আর তোমার সংসারের খরচপত্র চলে। বাবার ঔষধের খরচও চলে। আজ যেতেই হবে। মা আর কিছু বললেন না। মা দিনমজুরি করেন কিন্তু যে টাকা আয় সে টাকাতে সংসার টাই চলে খুব কষ্টে। তাই চাইনা টিউশনিটা যেন হারিয়ে ফেলি।

ছাতা হাতে রওনা দিলাম ছাত্রের বাসার উদ্দেশ্য। ১০ মিনিটের পথ ৫ মিনিটে শেষ করলাম। হাঁটুর নিচের অংশের প্যান্ট ভিজে একাকার। ভাবলাম আমার এমন অবস্থা দেখে ছাত্রের মা অন্তত বলবেন, বাবা এত বৃষ্টিতে আজ পড়াতে না এলেও পারতে। কিন্তু দশ মিনিট কম পড়ালে যিনি পরেরদিন সেটা গুনিয়ে দিতে ভুল করেন না উনার মুখ থেকে এমন কথা আশা করা বিলাসিতা মাত্র। দরজা খুলতেই ছাতা বন্ধ করে বাইরে টাঙিয়ে ভেতরে গেলাম। মানবতার খাতিরে তো গামছা টা দিয়ে বলতে পারতেন যে, মুখটা মুছে নাও। কিন্তু সভ্য পরিবারের বুঝি এটাই সভ্যতা। অন্তত সন্তানটা তার মায়ের মতো না। আমাকে দেখেই তোয়ালে এনে দিয়ে বলল, স্যার আপনি তো ভিজে গেছেন। এই নিন মুছে নিন। ছাত্রের ব্যবহার দেখে সব দুঃখ, অভিমান নিমিষেই শেষ। হাতমুখ মুছে পড়াতে বসলাম।

পড়ার মাঝখানে ছাত্র অনুমতি নিয়ে গেল রান্নাঘরে। তারপর এসে পড়তে বসল। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় গিয়েছিলা? সে বলল, এমনি স্যার একটু পিপাসা পেয়েছিল। অবাক হলাম উত্তরে। কারণ পানির বোতল আমার সামনেই পড়ার টেবিলে ছিল। ভাবলাম হয়তো ভুলে গেছে। কিন্তু মিনিট পাঁচেক পর বুঝলাম ছাত্র কেন গিয়েছিল রান্নাঘরে। সে রান্নাঘরে গিয়েছিল কাজের মেয়েটাকে বলতে যেন আমাকে গরম গরম আদা মেশানো চা বানিয়ে দেয়। চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, বিপ্লব চায়ে আদা দেয়ার জন্য তুমি বলেছিলে? সে মাথা উঁচিয়ে বলল, স্যার আপনি তো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এসেছেন। গরম চায়ে আদা দিয়ে খেলে উপকার হবে। তার এমন ব্যবহার মনটাকে ছুঁয়ে গেল। মন থেকে অনেক অনেক আশীর্বাদ বের হল তার জন্য। পড়ানোর শেষে আসার সময় বিপ্লবকে বললাম, এভাবেই থেকো বিপ্লব। জীবনে অনেক উন্নতি করবা। সে মুচকি হাসলো আমার দিকে তাকিয়ে।

বৃষ্টি কমে গেছে তাই আর ছাতা ফুটালাম না। বাবার ঔষধও প্রায় শেষ। কঠিন রোগে আক্রান্ত বাবা। সপ্তাহ শেষে আড়াই থেকে তিনশত টাকার ঔষধ খেতে হয়। ফার্মেসি তে গেলাম ঔষধের জন্য। ঔষধ নিলাম। দু’শ টাকা দিয়ে একশ টাকা পরে দিব বলে বাকি লিখিয়ে আসলাম। বাসায় আসতেই মা বললেন, আকাশ তোর বাবার তো ঔষধ শেষ। উনার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি বললাম, ঔষধ নিয়ে এসেছি। মায়ের চোখে নিজের জন্য অনেকটা গর্ব দেখতে পেলাম। ততক্ষণে ছোট বোন রুমি এসে সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বড় করে তাকালো। মনে পড়ে গেল তার কথা। সে বলেছিল আজ তার জন্মদিন তাই তার জন্য যেন সুন্দর একটা হাতঘড়ি এনে দিই। কিন্তু মানিব্যাগে টাকা নেই।

তাই মিথ্যে বাহানা করে বললাম, ভুলে গেছিরে বোন! আজ সন্ধ্যার দিকে ঠিক নিয়ে আসবো। ভীষণ অভিমানে আমার ভালোবাসার বোনটা মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাতে লাগলো। আমি তাকে বুকে নিয়ে কোনোভাবে তার মনটাকে স্বান্তনা দিলাম। কিন্তু টাকা কোত্থেকে আনব, ঘড়ি কিভাবে কিনবো সেটা জানা নেই। মা জিজ্ঞেস করলেন, এখন মাসও হয়নি তোর। টিউশনির টাকাও তো কেউ দেয়নি। কোত্থেকে আনবি ঘড়ি। মাকে বললাম, আরে কে বলল টাকা নেই? আমি আনবো। একটাই তো বোন আমার। রিজাল্ট শেষে যখন সে ফার্স্ট হয় তখন এলাকায় আমারো তো বুক ফুলে যায় গর্বে। আজ আমার একমাত্র বোনের জন্মদিন। তাকে তো কিছু একটা দিতেই হয় তাইনা। মা জানেন আমি মিথ্যা বলছি। কারণ যদি টাকা থাকতো তাহলে তো আমি নিয়েই আসতাম। বাহানা করতাম না।

সাইকেল চালিয়ে এক কিলোমিটার গিয়ে পড়াতে হয়। অন্যদিনের মতো আজও সাইকেল চালিয়ে গেলাম টিউশনে। পড়ানোর মাঝখানে ভাবলাম ছাত্রীর মা’কে ডেকে বলি আজ এই মাসের টাকাটা অগ্রীম দিয়ে দিতে। কিন্তু একরকম লজ্জা কাজ করছিল আমার মাঝে। আগেও এরকম লজ্জায় পড়েছি এবং লজ্জা কাটিয়েও উঠেছি। আজও আমাকে লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে। ছাত্রীর বাসার কাজের মেয়ে চা-নাস্তা নিয়ে আসলে তাকে ছাত্রীর মাকে ডেকে দিতে বলি। ছাত্রীর মা পড়ানোর রুমে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার আকাশ, ছুটি দিবে নাকি? আবার কি ঢাকায় জব-টবের পরীক্ষা দিতে যাবে? আগেও কয়েকবার ঢাকায় পরীক্ষা দিতে যাব বলে আন্টির কাছ থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। উনিও ছুটি দিতে কোনো সংকোচ করেননি। আমি বললাম, না আন্টি এখন আপাতত কোনো পরীক্ষা নেই। কিন্তু।

– কিন্তু কি?

– বলতে কেমন জানি লাগছে..

– কেমন লাগবে আর! বলো কি বলবা..

– আন্টি এই মাসের টাকাটা যদি অগ্রীম দিয়ে দিতেন। মানে টাকার খুব প্রয়োজন তাই আন্টি।

আন্টি মুচকি হেসে বললেন, এটা বলতে এত দ্বিধাবোধ! তুমি তো তোমার প্রাপ্য টাকাই চাইছো তাইনা। আমিতো কখনো কখনো মাস হলে টাকা দিতে দেরি করে ফেলি। আজ নাহয় তোমাকে মাস ফুরানোর আগেই দিয়ে দিলাম। আন্টি ভেতর থেকে পনেরোশো টাকা এনে হাতে দিলেন। আমার চোখে টাকা পাওয়ার খুশিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আসার সময় একটা ঘড়ির দোকান থেকে ভালো ডিজাইনের লেডিস-ওয়াচ কিনলাম।

জানি এই ঘড়িটা দেখে রুমির মুখে অমূল্য হাসি চলে আসবে যা দেখার জন্য সকল ভাইয়েরা জীবনসংগ্রামে লড়াই করে টিকে থাকে। ঘড়ি কেনার পর্ব শেষ করতেই মনে পড়লো জন্মদিন তো কেক ছাড়া সাজসজ্জাহীন বিয়ের সমান। তাই কেক নিলাম। সাধারণ বেকারি কেক আরকি। বাসায় ফিরে যখন রুমিকে ঘড়িটা দিলাম তখন সে এতই উল্লাসিত হল যে ভাইয়া বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার বুকটা তখন আদর-মমতায় আরো ভরে গেল। সব কিছু শেষে যখন পকেট থেকে ফোনটা চার্জ এ লাগাবো ভেবে বের করলাম, দেখি অহনার অনেক মিসডকল। ওহ মাই গড! অহনার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ফোন ব্যাক করলাম। ফোন রিসিভ করেই আমাকে রিমান্ডে নিল সে।

-কই ছিলা?

-টিউশনে।

-টিউশন তো ৭ টার পর শেষ হয়ে যায়। আর আমি ফোন দিয়েছি তার পরে। উঠাওনি কেন?

– টিউশনি থেকে বের হয়ে ছোট বোনটার জন্য কিছু কেনাকাটা করলাম। তার আজ বার্থডে।

-ও সরি। কিন্তু একটা মেসেজ তো করতেই পারবে। আর আজ বোনের বার্থডে বলনি কেন? বলবা ই বা কেন, আমাকে তো ভালোবাসনা।

-হুম….

– কি হুম? তোমার জবের খবর কি?

– জানোই তো। আলাদাভাবে কেন জিজ্ঞেস করছো?

অহনা অসহায়ের মতো করে বলল, আকাশ প্লিজ কিছু একটা করো। প্রস্তাবের উপর প্রস্তাব আসছে বিয়ের জন্য। আর কতটা বিয়ে ভাঙবো বল। এখন বাবাও বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছেন।

– হুম…

– কি হুম? দুইবছর থেকেই তো বলে আসছো কিছু করবা, কিছু করবা। কিন্তু কি করছো? দেখবা একদিন তোমারই চোখের সামনে অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে আমাকে আকাশ! আমি মরে যাব আকাশ…

– হুম চিন্তা করনা তাড়াতাড়িই কিছু একটা করব।

এভাবেই প্রতিবার অহনাকে স্বান্তনা দেই। এখন স্বান্তনা দিতে দিতে অসহ্য হয়ে গেছি। জানিনা আর কতোদিন এভাবে স্বান্তনা দিতে পারবো….

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত