মা মারা গেলেই বাবা ঘরে নতুন মা আনেন। আমি আর ইমু অবাক হয়ে যাই। শেষে দেখি মার কথাই সত্যি হলো।মা যেদিন মারা যাবেন সেদিন আকাশ ভরা তারা, কাঁঠাল পাতায় জোছনার আড়ং আর কাগজিলেবুর গাছে সাদা সাদা ফুলের কী ঘ্রাণ!আমরা মা সন্তান বসে ছিলাম উঠোনে বিছানো শীতল পাটির উপর।মা একেবারেই ঘরে থাকতে পারেন না।কী এক রোগ হলো মার,ঘরে গেলেই বলেন দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো।তাই গভীর রাত অব্দি মা বসে থাকেন উঠোনে।আমরা ভাই বোন মার পাশে বসি বাংলা বই নিয়ে।দু’ ভাই- বোন এক ক্লাসে। আমি ফোরে ফেল করে আবার ফোরে থেকে গেছি।ইমু পাশ করে উঠেছে ফোরে।
ওর রোল এক। আমার সেই শেষে।পঁচানব্বই।বাবা বলেন, গাধার গাধা।মা বলেন এবার কিন্তু এক হতে হবে।ইমুকে ডিঙিয়ে যেতে হবে। আমি ডানে মাথা কাঁত করে সায় দেই। সেদিন বাবা বাড়িতে নেই। নেত্রকোনা গেছেন জাল কিনতে।কনোই জাল। পুকুর ভর্তি মাছ।কনোই জালে পুকুরের মাছ ধরতে খুব সুবিধা।বাবা ফিরতে দেরি হবে। রাত বারোটাও বাজতে পারে।বাজারে আড্ডা না দিয়ে তিনি বাড়ি ফিরেন না। মা বললেন,’মিলন,আমি মরে গেলে তোরা থাকতে পারবি নারে?’ আমি চুপ থাকি।কী কঠিন কথা! বুকের ভেতর কেমন যেন ঝড় উঠে।ইমু বলে,’আমি মরে যাবো মা।’ মা ইমুকে কাছে টেনে নেন।বলেন,’আমার মৃত্যুর পর ঘরে তোদের নতুন মা আসবে।তোর বাবা নতুন বিয়ে করবে।লাল টুকটুকে বউ। আমার মতন অসুখ নেই তার।অত পঁচাও না দেখতে। তোরা থাকে মা বলে ডাকবি।’
ইমু ভে ভে করে কেঁদে ফেলে। আমি বলি,’কিছুতেই না।’বলে মার আঁচল টেনে ধরি।মা আমার পিটে হাত বুলিয়ে দেন।ইমু কেঁদে কেঁদে বলে,’আর একবার যদি মরার নাম নেও তবে কিন্তু আমি বাড়ি ছাড়বো!’ বলে আবার কাঁদে ইমু। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে সে মার পাশে। আমি বসে থাকি। আকাশ দেখি।তারা ভরা আকাশ। সবগুলো তারাকেই আমার মা মনে হয়। মনে হয় মা বুঝি সারা পৃথিবীতে আলো ছড়াচ্ছে। একটু পরেই মার শরীর বাড়ে।গলা ছিঁড়ে কাশির সাথে মুখ ভরে লাল রক্ত বেরিয়ে আসে। সবুজ শীতল পাটি মাখামাখি হয়ে যায়।আমরা ভয়ে আঁতকে উঠি।কী করবো ভেবে পাই না। শেষে কেঁদে উঠি।
বাবা ফিরে আসেন আরো পরে। মুখে সিগারেট। ধোঁয়া ছেড়ে উঠোনে পা রাখতেই দেখেন মায়ের মরণ দশা।ও বাড়ির প্রতিবেশীরা এসে ভীড় করেছে পাশে।বাবা সিগারেট ফেলে দিয়ে মার পাশে বসেন। এভাবে কতদিন তিনি মার কাছাকাছি হন না। অসুখ হওয়ার পর মাকে তিনি কেমন এড়িয়ে চলেন।মা কথা বলতে পারেন না। বাবার দিকে ছলছল চোখে তাকান।এই তাকানোই শেষ তাকানো।মা মরে যান। মার মৃত্যুর পর বাবা সত্যি সত্যি বিয়ে করেন।দেখতে কী সুন্দর আমাদের নতুন মা! কিন্তু আমাদের মার মতো মোটেও অত ভালো নয়। নতুন মা আমাদের ভাই বোনকে আদর করেন না।
মা সকাল হলেই আমাদের ভাই বোনকে ডেকে ঘুম থেকে তুলতেন। তারপর প্লেট ভর্তি মুড়ি আর খেজুর গুড়ের টুকরো দিয়ে বলতেন,’তাড়াতাড়ি খেয়ে পড়তে বসো তোমরা।’ নতুন মা আমাদের দুপুর হলেও খেতে ডাকেন না। পেটের ক্ষুধায় কাতরাতে কাতরাতে যদি বলি,’আর থাকতে পারছি না মা।পেট ভেঙে যাচ্ছে একেবারে খিদেয়!’ নতুন মা তখন খেতে দেন। মাঝেমধ্যে বকাঝকাও করেন খুব। প্রতিবেশীর কাছে বলেন,’দুইটা রাক্ষস রাইখা বিদায় হয়ছে এক রাক্ষুসি। সারাদিন খালি খায় খায় করে। খাওয়া ছাড়া কোন গতি নাই!’ প্রতিবেশীরাও সায় দেয়।বলে,’অত লায় দিওনা গো বউ,পরের সন্তানের জন্য অত করেও মন পাবে না।’ কথাগুলো আমরা শুনে ফেলি মাঝেমধ্যে। শুনে কাঁদি।ঘরের পেছনে শিউলি গাছের নিচে মার কবর।কবরের চারদিকে বাঁশ বেতের বেড়া।সেই বেড়ার বাঁশ জড়িয়ে ধরে আমরা ভাই বোন কাঁদি। আমাদের কান্না পৃথিবীর আর কেউ দেখতে আসে না। আমাদের বাবাও না।
ঘর থেকে এক হাজার টাকা নাই হয়ে যায়।কে নিয়েছে কে জানে!মা বলেন,’মিলন,টাকাটা কোথায় রেখেছিস বল?’
আমি অবাক হয়ে বলি,’কিসের টাকা মা?’ ‘কিছুই জানিস না না?এক হাজার টাকা সবটা খেয়ে শেষ করে ফেলেছিস?ইমুকেও ভাগ দিয়েছিস না?’ আমি কেঁদে ফেলি।বলি,’না মা না। আমি টাকা নেইনি।’ ‘তুই ই নিয়েছিস হারামজাদা।শুধু এক হাজার না আরও নিয়েছিস।’ বলে কান টেনে ধরেন তিনি।গালে থাবড় দেন একটানা। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন ঘরের চৌকাঠের উপর। মুখে তিক্ত স্বাদ পেয়ে হাত লাগাই ঠোঁটে। সামনে এনে দেখি লাল টকটকে রক্ত। ঠোঁট কেটে গেছে। খুব ব্যথা।ইমুকেও আস্ত রাখেন না মা। বলেন,’ভাগ পেয়েছিস না?তোরা আমার সব খেয়ে শেষ করে দিতে চাস!’ বলে তার ঘাড় অব্দি লম্বা চুল টেনে ধরেন।ইমু ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে।কাজ হয়না এতে।মা তাকে সহজে ছেড়ে দেন না।
সন্ধ্যা বেলায় বাবা বাড়ি ফিরলে ভাবি মায়ের বিচার হবে।বাবা বুঝি আমাদের সান্ত্বনা দিবেন।আদর করে কাছে টেনে বলবেন,’আর কেউ তোদের ছুঁতে পারবে না।’আমার কেটে যাওয়া ঠোঁটে সেবলন মাখিয়ে দিয়ে বলবেন,’ইশ!অনেকটা কেটে গেছে রে!’ কিন্তু না।বাবা বাড়ি এসে এসবের কিছুই করেন না।মার সব অভিযোগ শুনে তিনি খুব ক্ষেপে যান আমাদের উপর। রাগে আমাদের কাছে এসে বলেন,’চোর হয়েছিস না? মাকে তো খেয়েছিস, এখন আমার সব খেতে চাস?’ আমরা বোবা হয়ে যাই।ভেবে পাই না মা ছাড়া বাবারা এমন হয় কেন?অত পাষাণ? সন্তানের চেয়েও কী আপন কেউ থাকে বাবাদের? আমি বুঝি না। আমাদের সে রাতে খাবার দেয়া হয় না। চুরির শাস্তি।বাবা শেষ বারের মতো শুনিয়ে দেন আরেকবার চুরি করলে বাড়ি ছাড়তে হবে।শুনে আমরা ভাই- বোন সারা রাত ধরে কাঁদি।মার কথা ভাবি।আপন মা ছাড়া পৃথিবীর সব মা পর।পর পর পর!
দিন যায় এভাবেই।মার অত্যাচার বাড়ে।বাবা হন আমাদের পর। পড়াশোনা আর ভালো হয় না।অত অত্যাচারের পর কী করে পড়াশোনা হবে? আমি শুধু ফেল করি। বারবার ফেল করে স্কুল ত্যাগ করি।ইমু পড়ে।কষ্ট করে পড়ে।মার অভিযোগ,সে বাতির কেরসিন সব নষ্ট করে ফেলছে।বাবা আদেশ জারি করেন,রাতে বেশি পড়া যাবে না।দিনে পড়তে হবে। আমি দেখি এভাবে আর হয় না। আমি কাজে নেমে পড়ি। খুব কষ্ট হয় কাজে। কিন্তু বোনকে যে মানুষ করতে হবে। বোন আমার বেড়ে উঠে। ক্লাস এইটে বৃত্তি পায়। নতুন মার মাথা ধরে যায় তখন। নিজের তো সন্তান হয়নি।অন্যের সন্তান অত ভালো করলে তার সহ্য হবে কীভাবে! তিনি এবার উঠে পড়ে লাগেন ইমুর বিয়ে নিয়ে।তার ভাই ছেলের কাছে ইমুর বিয়ে ঠিক করে ফেলেন।ইমু শুনে কেঁদে কেটে একাকার হয়। আমিও কিছুতেই মানতে পারি না। বাবাকে বললে কোন ফল পাওয়া যায় না।
আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। পালিয়ে যাই মামার বাড়ি।ওখানেও থাকা যায় না।মামা বলেন,’তোর বাবা জেনে গেলে এসে এখান থেকে নিয়ে যাবে।তোরা বরং ঢাকায় তোর মামির বোনের বাসায় চলে যা। আমি গিয়ে দিয়ে আসি তোদের।ইমু ওখানে একটা স্কুলে ভর্তি হয়ে যাবে। তুই সেলাই কাজ শিখবি।’ তাই হলো।আমরা চলে গেলাম ঢাকায়।কী মস্ত শহর ঢাকা।ইমু ভর্তি হয়ে গেল ঢাকার একটা গার্লস স্কুলে। আমি সেলাই কাজটা শিখে ফেললাম।বাড়ি ছাড়ার দুঃখ বুকে নিয়ে আমরা বেড়ে উঠতে লাগলাম দিন দিন।
মাধ্যমিকে ইমুর খুব ভালো রেজাল্ট হলো। উচ্চ মাধ্যমিকে আরো ভালো। কদিন পর ভার্সিটিতে চান্স হলো ওর। সাবজেক্ট ভালো।দিন চলে যায় খুব দ্রুত। আমার কষ্টের রোজকারে শেষ হয় বোনের পড়াশোনা।ইমুর চাকরি হয়। সরকারি চাকরি। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা।অত বড় চাকুরি। ইমু আমায় জড়িয়ে ধরে জড়জড় করে কেঁদে উঠে। আমিও কাঁদি। বহুদিন পর বাড়ির কথা মনে পড়ে আমার। ইচ্ছে করে এবার বাড়ির পথ ধরি।
বাড়ি যাওয়ার সময় কত স্মৃতি যে মনে জাপটে ধরে।মার কবরটার কথা মনে পড়ে খুব। মনে পড়ে নতুন মার অত্যাচারের কথা, বাবার এমন পাষাণ হওয়ার কথা।দু’ ভাই- বোন মিলে নতুন মার জন্য শাড়ি কিনি, শীতের চাদর কিনি। বাবার জন্য কিনি চেক শার্ট,ঘিয়ে রঙা পাঞ্জাবি,দামী আতর, জায়নামাজ।ভাবি,বাড়ি গিয়েই বাবাকে জড়িয়ে ধরবো,মার পায়ে পড়ে বলবো,মাফ করে দাও মা। জানি আমাদের দোষ নাই কোন, তবুও আমরা মাফ চাইবো।মা বাবার কাছে সন্তান মাফ চাইলে ছোট হয়ে যায় না।
বাড়ি ফিরে দেখি সবকিছু ওলটপালট।উঠোনের কাগজি লেবুর গাছ আর নাই।মরে গেছে।সারা উঠোন জংলা ঘাসে ভরে আছে।শ্যাওলা পড়েছে। বাবার শরীর ভালো না। অল্পতেই বুড়িয়ে গেছেন।চোখে ছানি পড়েছে। নতুন মার মাথা ধরে গেছে। কাউকে চিনতে পারেন না।শরীর কেমন ভেঙে গেছে। সারাদিন শুধু মরণ মরণ জপেন। বাবাকে গিয়ে আমি জড়িয়ে ধরি।বাবা আমায় ভালো করে দেখতে পান না। কিন্তু চিনতে পারেন।ইমু বাবাকে করমর্দন করে।বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েন। নতুন মা এসে পাশে দাঁড়ান। তিনি আমাদের কাউকে চিনতে পান না। শুধু বলেন,’মরে যাইয়াম,মরে যাইয়াম।আজরাঈল তুই কই রে?আয় আয় আয়।আমারে নিয়া যা।’ নতুন মাকে জড়িয়ে ধরে ইমু। আমি মার গা ঘেঁষে দাঁড়াই। হঠাৎ প্রচন্ড কান্না পায় আমার। আমাদের সব পাওয়ার দিনেও কেন সব পাওয়া হলো না আর?