অতিপ্রাকৃত

অতিপ্রাকৃত

নাস্তা করার সময় কথাপ্রসঙ্গে রমজান চাচার কাছ থেকে যতটা জানতে পারলাম তা হলো, আমার স্বামী সজল বাড়ির বাইরে যেতে পছন্দ করেন না।অফিসের কাজ গুলো বাসায় বসে করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ভিড় বাট্টা,বাইরের মানুষ একদম এড়িয়ে চলেন । ঢাকায় তাদের বেশ কিছু ছোট বড় ব্যাবসা,দোকান পাট আর গ্রামে প্রচুর জমিজমা রয়েছে।একসময় এই পরিবারের পূর্বপুরুষের জমিদারি ছিল।গ্রামের লোকজন এখনো এ বাড়ির সদস্যদের জমিদারের মত সম্মান দেয়,মান্য করে।

আমার শশুরের শারীরিক অসুস্থ্যতার কারনে এইসব ব্যবসা,হিসাব নিকাশ দেখাশোনার জন্য এখন একজন ম্যানেজার নিয়োগ করা হয়েছে।তিনি প্রীতিদিন সকালে আর সন্ধ্যায় এসে কাজ বুঝিয়ে চলে যায়। এই বাড়িটি ঘিরে এলাকায় অনেক কল্প কাহিনী রয়েছে।আশেপাশের স্থানীয় লোকজন এ বাড়িতে ঢুকতে ভয় পায়।বাইরের লোক বলতে ওই ম্যানেজার আর একজন ফ্যামিলি ডাক্তারের এই বাসায় নিয়মিত আসা যাওয়া আছে। ডাক্তারের পরামর্শে দুপুরে আমার শশুরের জন্য বিশেষ ধরনের খাবার রান্না করতে হয়।চাচা রান্নার প্রস্তুতি নিবেন।আমাকে বলা হলো,আমি যেন নাস্তা শেষ করে নিজের রুমে চলে যাই।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমি বাড়ির সামনের দিকে হাঁটছিলাম।আনুমানিক পনেরো কাঁঠা বা এক বিঘার মত জায়গা নিয়ে এই বাড়িটা।সামনে প্রশস্থ বাগান আর সেই বাগানের মাঝখান দিয়ে সেঁতসেঁতে শেওলা ধরা পাথরের সরু একফালি রাস্তা। এক পাশে একটা ঝং ধরা লোহার দোলনা পাতা।আর এক পাশে একটা বন্ধ হয়ে পরে থাকা পরিত্যক্ত ফোয়ারা। দোলনায় গিয়ে বসলাম।বসার পর মনে হলো কেউ একজন যেন পিছন থেকে দোল দিচ্ছে। ধীরে ধীরে দোলের গতি বাড়তে লাগলো। আমি দোলের সাথে সাথে পা দোলাচ্ছি আর চারপাশটা দেখছি।মনে হলো একজন কেউ খুব কাছে এসে দোলনার খালি অংশটুকুতে বসেছে। কিছুক্ষনপর কে যেন কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো: “বিপদ! সামনে ঘোর বিপদ।” আশেপাশে দেখলাম ,পিছনে ফিরেও কাউকে পেলামনা।

অনুভূতিহীন আমি নিজের মনের ভুল ভাবতে লাগলাম,খোলা হওয়ায় চুল উড়িয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে থাকলাম।হঠাৎ লোহার শিকল খুলে দোলনাটা একপাশে পরে গেল।প্রথমে মনে হলো তেমন কিছু হয়নি,কিন্তু উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পায়ে কিছুটা ব্যথা অনুভব করলাম।মনে হলো কেউ যেন ইচ্ছে করে আমাকে দোলনা থেকে ফেলে দিলো।এইপ্রথম আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো,কেমন যেন একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা এসে গালে লাগলো। বাড়ির পিছনের দিকে চোখ পড়লো।কি যেন একটা চুম্বকীয় আকর্ষণ আমাকে সেদিকে টানতে লাগলো।ধীর পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে গেলাম।মনে হলো ওখানে কারো একটা কবর আছে। কিন্তু কার কবর? নিজের মন কে জিজ্ঞাসা করে কোনো উত্তর পাচ্ছিনা।আরো কাছে গেলাম,লতা পাতা দিয়ে জায়গাটা ঘেরা।মাটি একদম সমান করা।কবরের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই।কিন্তু আমার অবচেতন মন বলছে,ঠিক কবর নয়,এখানে বহু বছর আগে গোপনে কাউকে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল।

পিছনের এই দিকে মূল বাড়ি থেকে আলাদা একটা এক কামড়ার তালাবদ্ধ ঘর দেখলাম।মনে হলো অনেকদিন এদিকে কারো পা পরেনি।চারদিকে আগাছা আর জংলামত ছোট ছোট গাছ।ঘরের দরজা জানলার উপর মাকড়সার জাল আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। স্বভাবগত কারনে আমার কোনো কিছুতে কৌতূহল জাগার কথা না।আজো তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই কবর রহস্যটা জানতে ইচ্ছা করছে না।পৃথিবীতে কিছু জিনিস থাকুক না,জানার বাইরে।

দোতলার বারান্দায় সজল সাহেব কে পায়চারি করতে দেখলাম।এই দিকে তার কোনো রকম ভ্রূক্ষেপ নেই। বিয়ে করা সুন্দরী নতুন বউ কে আলাদা ঘরে রেখে তিনি কি নির্বিকার রাত কাটালেন।মনে হলো তিনি একজন চাবি দেয়া কাঠের পুতুল।কেউ একজন তাকে চাবি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে আর সজল সাহেব তার কথামতো নেচে যাচ্ছেন।ভালোই হলো,আমারো আজ পর্যন্ত পুরুষ মানুষ,সংসার,ঘর,শারীরিক চাহিদা এইসবে আগ্রহ তৈরী হয়নি। জীবনের প্রতি কোনো চাওয়া নেই আমার।

জীবন যখন যেভাবে চলে আমিও তার সাথে তাল মিলাই। বাগান থেকে নিজের ঘরে ফিরে এলাম। দুই তিন দিন ধরে একটা সমস্যা হচ্ছে, প্রয়োজনের সময় বাবা কে আমার আশেপাশে পাচ্ছিনা । অসহায় লাগছে খুব।নতুন কোনো পরিবেশে বাবা কেমন যেন অপরিচিতের মত আচরন করে।তাকে ডাকলেও কাছে পাওয়া যায় না।নিজেকে এমন অসহায় লেগেছিল অনেকবছর আগে একবার।

সেবার ছোটমামার সাথে বড় খালার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম।বড় খালার বাড়ি খুলনায়।বাড়ির পাশেই রূপসা নদী।খালাতো ভাই বোনেরা দল বেঁধে সবাই নদীতে গোসল করতে যায়।তো আমিও গেলাম তাদের সাথে।তারা সবাই পানিতে মজা করছে।আমি সাঁতার জানিনা,এই ব্যপারটা তখন কারো মাথায় ছিল না।হঠাৎ কিভাবে যেন নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে ফেললাম আমি।পায়ের নিচের মাটি আর মাথার উপরের পানি দুটোই নিজের আয়ত্তের বাইরে চলে গেল। হাঁসফাঁস অবস্থা আমার।পানির নিচে আমি বাবা কে খুঁজছি।আমার নিঃস্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।অথচ বাবা কে পাচ্ছিনা।বাবা আমাকে সাহায্য করছে না!যে বাবা সারাক্ষন পাশে পাশে থাকে সে কোথায়? তারপর আর কিছু মনে করতে পারিনি।

জ্ঞান ফিরে জানতে পারলাম,আধা মাইল দূরে নদীর তীরে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় এক জেলে খুঁজে পেয়েছিলেন ।মসজিদের মাইকিং এ নদীতে নিখোঁজ হওয়ার খবরশুনে,সেই জেলে আমাকে খালার বাসায় নিয়ে আসেন।সেদিন এর পর বাবাকে অনেকদিন আমার আশেপাশে পাইনি।ভেবেছিলাম বাবা আমাকে ছেড়ে গেছেন।কিন্তু নানুবাড়ি ফিরে যাওয়ার পর বাবা আবার আসতে লাগলেন আমার কাছে।আবার আগের মত লাইব্রেরী তে আমার সাথে বসে বই পড়তেন তিনি। যাইহোক,এই বাড়িতে আমার তেমন অসুবিধা হচ্ছেনা,বরং ভালোই লাগছে,নতুন থাকার জায়গা হিসেবে মন্দ নয়।এই এক দিনেই ঘুরে ঘুরে সব দেখা হয়ে গেছে,শুধু দোতলার অংশটুকু বাদে।

সবচেয়ে ভালো লেগেছে এখানে প্রচুর বই আছে।বই পড়ার সময় বাবাকে সব সময় আমার পাশে পাই। আক্ষেপ শুধু এতটুকুই,আমি এই বাড়ির বউ অথচ এখানে সেরকম কাজকর্ম কিছুই করার নেই আমার। রাতে খাবার পর একটা বই নিয়ে আধশোয়া অবস্থায় পাতা উল্টাচ্ছি। পুরনোদিনের কোনো বেনামী লেখকের কাব্যিক ধাঁচের লিখা বই।

পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হলো বারান্দায় কেউ একজন হাঁটছে।পায়ের শব্দটা একদম স্পষ্ট।আমি উঠে দরজা খুললাম।আচমকা বাগান থেকে তীর্যক একটা লাইটের আলো এসে আমার চোখে পরলো।তাকাতে পারছিলামনা।মুহূর্তের মধ্যে আলোটা নিভে গেল। হাস্নাহেনার পাগল করা একটা গ্রান ছড়াচ্ছে চারদিকে।তার সাথে চাঁদের আলো মিলেমিশে একাকার। আজ মনে হয় পূর্ণিমা।বারান্দাটা চাঁদের আলোতে ঝক ঝক করছে। আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলামনা। অথচ,শব্দটা এখনো কানে গেঁথে আছে।আমার তো ভুল হওয়ার কথা নয়।ডান বাম ভালো করে দেখে আবার বিছানায় ফিরে এলাম।

ঘরের আলো বন্ধ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।এবার একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম।নিচু গলায় কেউ কাঁদছে।কোনো বাচ্চা মেয়ের বা মহিলার কান্নার আওয়াজ মনে হচ্ছে।ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় ভাবলাম।এই বাড়িতে আমি সহ চার জন মানুষ এখন। যার দুজন থাকেন উপর তলায়। নিচ তলার পিছনের দিকে রান্নাঘরের পাশে রমজান চাচার থাকার ঘর।ঐ দিক থেকে কেউ কাঁদলে এত দূর পর্যন্ত কান্নার আওয়াজ আসার কথা নয়।তাহলে আমার ঘরের দরজার পাশে মেয়েলী গলায় কে কাঁদবে এত রাতে?মিনিট দশেক পর থেমে থেমে কয়েকবার কান্নার শব্দটা শোনা গেল।গা ছমছম করা একটা পরিবেশ।

স্বভাবসুলভ কারনে আমি নির্বিকার রইলাম।এই সব অযাচিত বিষয়ে আমল না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল।রান্নাঘরে রমজান চাচাকে কাজ করতে সাহায্য করতে গেলে তিনি ইশারায় বাঁধা দিলেন।দরজায় হেলান দিয়ে আমি তার নাস্তা বানানো দেখছিলাম। তিনি একটা চায়ের কাপ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ট্রে তে সাজিয়ে কিছু ফল আর ব্ল্যাক কফি নিয়ে উপরে রওয়ানা হলেন।

-চাচা এটা কার নাস্তা?

– বড় সাহেবের নাস্তা।আপনি চা খেতে থাকেন আমি নাস্তা টা উপরে দিয়ে আসছি।

তিনি চলে যাওয়ার পর রান্নাঘরে নাস্তা বানানোর জায়গাটাতে একটা ছোট শিশি দেখতে পেলাম।নাকের কাছে নিতেই বমি এসে গেল।জিনিসটার বিশ্রী রকমের উটকো আর ঝাঁঝালো একটা গন্ধ।এটা কোনো মশলা হতে পারেনা।মনে হচ্ছে কোনো ঔষুধ।কিন্তু বোতলের গায়ে কোনো নাম লিখা নেই। পিছন থেকে রমজান চাচা আচমকা এসে হেঁচকা টানে হাত থেকে দ্রুত শিশিটা কেড়ে নিলেন।হাতের মুঠোয় লুকিয়ে ফেললেন জিনিসটা।

-আম্মা, আপনাকে বলেছিলাম রান্নাঘরে আপনার কোনো কাজ নাই। এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন এখানে ?

রমজান চাচার আচরণ অস্বাভাবিক লাগছে।সহজ বাংলায় তিনি এই বাড়ীর চাকর, কাজের লোক শ্রেণীর মানুষ। অথচ এখানকার সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ তার হাতে।আমাকেও তার হাতের মুঠোয় কাঠের পুতুলের মত দমিয়ে রাখতে চাইছেন। আমি ডাইনিং এ গিয়ে বসলাম।রমজান চাচা নাস্তা দিতে দিতে কয়েকবার কাল রাতে কেমন ঘুম হলো জানতে চাইলেন।আমার সন্দেহ টা এবার সত্যি হবে বলে মনে হচ্ছে।রাতের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলাম। বুঝতে দিলাম না যে কাল রাতে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছিল। বুকসেলফের বই গুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিলাম।রমজান চাচা রান্নার কাজে ব্যস্ত। কেন আমাকে বউ করে এই বাড়িতে নিয়ে আসা হলো মনে মনে সেই হিসেবে মিলাচ্ছিলাম।

হঠাৎ উপর তলা থেকে একটা ঘুঙানির মত অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলাম।রমজান চাচার নির্দেশর তোয়াক্কা না করে উপরে গেলাম।শব্দটা যে দিক থেকে আসছিলো ওই দিকে পা বাড়ালাম।কর্নারের ঘরটার দরজা বাইরে থেকে ভেজানো।হালকা হাতে ধাক্কা দিতে দরজা খুলে গেল।পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকলাম।ঘরে বাইরের আলো আসার কোনো উপায় নেই,জানালা গুলো সব বন্ধ।

অন্ধকার ঘরটাতে ঢুকতেই সকালের সেই ঔষধের শিশির বাজে গন্ধটা নাকে আসলো। দেয়ালের সুইচ বোর্ড হাতড়িয়ে আলো জ্বালালাম। এরপর আমি যা দেখলাম তা দেখার জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিলাম না। একজন পৌঢ়,মাথা ভরা সাদা চুল। অসাড় শরীর নিয়ে বিছানার পাশের মেঝেতে উপুড় হয়ে পরে আছে। তাঁর শরীরের একপাশ মনে হলো প্যারালাইসজড। নড়াচড়া করতে পারছেন না তিনি। সম্ভবত তিনি আমার শশুর। প্রথমে আমি তাকে সোজা করে শোয়ালাম।তাঁর চোখ দুটি বন্ধ ছিল।অনেক কষ্টে তাকে বিছানায় তুললাম।পিঠের নীচে বালিশ দিয়ে তাকে বসিয়ে একটু পানি খেতে দিলাম।

এবার বৃদ্ধ চোখ খুললেন। কি অসহায় তাঁর চাহনি।হাতে ইশারা করে কিছু বলতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না।অস্পষ্ট কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে।টেবিলে রাখা পানির গ্লাস থেকে আর একটু পানি খাইয়ে দিয়ে আমি দ্রুত নিজের ঘরে ফিরে এলাম। আজকের এই ঘটনাটা রমজান চাচার জানার বাইরেই রয়ে গেল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত