আম্মার পেটে সন্তান। পাঁচ মাস।কী জঘন্য ব্যপার! আমার স্বামী শুনে নাক মুখ লাল করে দিলো। অবশ্য কিছু বললো না। কিন্তু শাশুড়ি আমায় সহজে ছাড়লেন না। সকাল সকাল আমার শ্বশুরের সামনে ডেকে নিয়ে বললেন ,’বসো নিলুফা।’
আমি সোফায় বসতেই দেখলাম আমার শশুর মিটিমিটি হাসছেন। শাশুড়ি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,’ঘটনা কী সত্যি?’ ‘কোন ঘটনা মা?’ ‘তোমার মা যে কনসিভ করছে আবার!’ লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম আমি। চোখ কেমন টলটল করে উঠছিলো জলে।মার প্রতি খুব অভিমানও হচ্ছিল।এক সময় না তাদের শখ ছিল একটা ছেলের। ছেলে যখন আগে হলোই না এখন এই ঢালু বয়সের দিকে এসে তিনি এমন কাজটা কেন করে বসলেন। তিনি কী জানতেন না সমাজের মানুষ হাসাহাসি করবে বিষয়টা নিয়ে? আত্মীয়-স্বজন আছে। নিজের মেয়ের বিয়ে হয়েছে। জামাই আছে।জামাইর বাবা মা আছে। এটা অবশ্যই একটা ভুল কাজ হয়েছে মার। শাশুড়ি এবার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,’কী গো নিলুফা, কিছু জিজ্ঞেস করলাম তো?’
শশুর এবার শব্দ করেই হেসে উঠলেন। আমি কোনমতে নিচ দিকে তাকিয়ে শাড়ির ঘোমটা টা আরো নিচ দিকে টেনে,’ যা শুনেছেন তাই।’বলেই ঘর থেকে দ্রুত পায়ে বের হয়ে আসলাম। আমি চলে আসার পর আমার শশুর- শাশুড়ি দুজন হাসিতে ভেঙে পড়লেন। সারাদিন নাঈম অফিসে ছিল। এই সুযোগে আমি বিছানায় পড়ে থেকে দিনভর কেঁদেছি।আমারও কিন্তু এক সময় শখ ছিল একটা ভাইয়ের। ছোট্ট একটা ভাই।যে কি না আমায় ‘বুবু বুবু’ বলে ডাকবে। কিন্তু তখন তো আর হলো না। এখন যদিও আল্লাহ দিলেন। কিন্তু সমাজ তো আর এসব বোঝে না। আমাদের সমাজ যে খুব ঘাড়ত্যাড়া। সমাজের মানুষের চিন্তা ভাবনার গন্ডিও খুব ছোট।এই গন্ডির বাইরে কিছু ঘটলেই ছিঃ ছিঃ শব্দের হিরিক!
দুপরের পর মাকে ফোন করলাম।মা লজ্জায় ফোন ধরলেন না । বাবাকে তো আমিই আরো লজ্জায় ফোন দিতে পারলাম না। ফোন দিলাম আমার অপর দুই বোনকে।তারাও স্বামীর বাড়িতে এই বিষয় নিয়ে ভীষণ লজ্জিত।কী বলবে না বলবে আমতা আমতা করে আর ভালো করে কথাই বলা হলো না ওদের সাথে। বিকেল কেটে যখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করছে তখন শাশুড়ি মা আর তার অন্য জায়েরা মিলে বেলকনিতে আড্ডায় বসেছিলেন। ওখানে আমায় চা করে নিয়ে যেতে ডাকা হলো।চা নিয়ে গিয়ে কী যে বিপত্তিতে পড়লাম ওখানে। শাশুড়ি মা সবার কাছে বিষয়টা বলে দিয়েছেন।এ নিয়ে ওরা খুব হাসাহাসি করছে।আমায় তো এক চাচী শাশুড়ি বলেই বসলেন,’বৌমা, তোমার বাবার দেখি এখনও তেজ আছে গো!’
আমার শাশুড়ি কথাটা টেনে নিয়ে বললেন,’বিয়াইন সাহেবাও তো এখনও কাঁচা।নইতো কী শুনে গা আমার জ্বলে উঠলো। চা ভর্তি ট্রে টা টেবিলের উপর ঝনাৎ করে রেখেই ওখান থেকে কেটে পড়ি আমি। তারপর সারাদিনের চেয়েও হাজার গুণ মন খারাপ করে কাঁদি।বিছানার বালিশ ভিজিয়ে ফেলি।রাতে নাঈম অফিস থেকে ফিরে এসে দেখে তখনও কাঁদছি আমি। অনেক চেষ্টার পরেও যখন সে আমায় নিভৃত করতে পারলো না তখন সে রেগেই গেল ঈষৎ।বললো,’কে কী বলেছে তোমায় শুনি?’ আমি কথা বলি না। ও আমায় জেরা করে। অবশেষে না বলে পারি না।বলি শশুর শাশুড়ি আর চাচী শাশুড়ির কথা। আবার বলি,’ এটা তো তাদের দোষ না।দোষ তো আমার মায়েরই। নয়তো এই বয়সে এমন কিছু তিনি করেন কেন!’ শুনে নাঈম আমায় একটা ধমক দেয়।বলে,’এই সামান্য ব্যপার নিয়েই অত মন খারাপ। দেখছি আমি।’
বলেই সে আমার শাশুড়িকে ডাকে। পাশেই শশুর ছিলেন।তাকেও ডাকে। তারপর শুরু করে।বলে,’ছিঃ! বুড়ো তো হয়ে গেছো এখনও কী আক্কেল জ্ঞান হয়নি তোমাদের? তোমাদের মন মানসিকতা এতো ছোট কেন?তোমরা না শিক্ষিত!কী শিখেছো আজীবন? এইসব নোংরামো কথা না? আচ্ছা একজন মেয়ে সে তার কোন বয়সে বাচ্চা নিবে এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এখানে তোমাদের নাক গলানোর কী আছে হ্যা? তাছাড়া সে জানে যার শুধু তিন তিনটে মেয়ে আছে কিন্তু ছেলে নাই ঘরে।একটা পরিবারের ছেলের শখ থাকা কী দোষের? আমার শশুর- শাশুড়ির এমন কী বয়স হয়ে গেছে যে তারা এখন সন্তান নিতে পারবেন না?আর সন্তান সন্তুতির বিষয়টা তো মোটেও মানুষের হাতে না,এটা আল্লাহর দান। তিনি যেহেতু চাইছেন একটা মানুষকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে তখন তোমাদের অত সমস্যা কী?’
নাঈমের কথা শুনে আমার শশুর- শাশুড়ি একেবারে কালো মুখ করে চুপচাপ হয়ে গেল। কোন উত্তর দেয়ার মতো কথাও খুঁজে পেলো না।ঘরে ফিরে নাঈম আমার একটা হাত টেনে ধরলো।আর আমায় বুকের সাথে মিশাতে মিশাতে বললো,’এখন তো হয়েছে?’ আমার চোখ কেমন ভিজে উঠেছে।মুখ ভেঙে কান্না এসে গেছে। ভেজা ভেজা গলায় ওর কলার চেপে ধরে বললাম,’অত কিছু বললে কেন তুমি?মা বাবাকে অত কিছু বলতে নেই।’ নাঈম হেসে বলল,’অতকিছু বলিনি তো আমি। শুধু ভুল ভেঙ্গে দিয়েছি তাদের।’ আমি আর কিছু বলতে পারি না তাকে।
পরদিন সকালে আমার শাশুড়ি ঘরে এসে আমার একটা হাত টেনে ধরেন। বলেন,’সরি বৌমা! আমার ভুল হয়ে গেছে।আসলে সমাজে এসব বিষয় আনকমন তো তাই হঠাৎ শুনে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারিনি ব্যপারটার সাথে । কিন্তু কাল রাতে নাঈমের কথা শুনে মনে হয়েছে, তোমার মায়ের এটা ভুল নয়, ভুল আমাদের,যারা এমন ভাবি।
আমি মৃদু হেসে বললাম,’মা আপনি খুব ভালো। সরি বলে আমায় ছোট করবেন না।’ শাশুড়ি বললেন,’মেয়ের কাছে সরি বললে কোন দোষ হয় না মা।’ বলে শাশুড়ি আমার হাতটা আরো শক্ত করে ধরলেন। আমি আনন্দে হেসে ফেললাম।